ঢাকা শনিবার, ০৬ ডিসেম্বর ২০২৫, ২১ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি মূল্যস্ফীতি বোঝাপড়া

সৈয়দ আবুল বাশার
স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি মূল্যস্ফীতি বোঝাপড়া

নিত্যপণ্যের বাজারচিত্রের সঙ্গে মূল্যস্ফীতির সরকারি পরিসংখ্যানের কদাচিৎ মিল পাওয়া যায়। বিশেষত খাদ্যপণ্য কিনতে গেলে মূল্যস্ফীতির প্রকৃত পরিস্থিতি ভালোভাবে টের পাওয়া যায়। অর্থাৎ অর্থনৈতিক পরিসংখ্যানে বাস্তব অভিজ্ঞতার প্রতিফলন ঘটেনি।

নিত্যপণ্যের বাজারচিত্রের সঙ্গে মূল্যস্ফীতির সরকারি পরিসংখ্যানের কদাচিৎ মিল পাওয়া যায়। বিশেষত খাদ্যপণ্য কিনতে গেলে মূল্যস্ফীতির প্রকৃত পরিস্থিতি ভালোভাবে টের পাওয়া যায়। অর্থাৎ অর্থনৈতিক পরিসংখ্যানে বাস্তব অভিজ্ঞতার প্রতিফলন ঘটেনি। পরিসংখ্যানের ক্ষেত্রে এমনটি প্রায় হয়ে থাকে। মানুষের জীবনযাপনের অভিজ্ঞতা উঠে আসে না। সত্য হলো, বছরের পর বছর ধরে দেশের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ক্রমেই কমেছে। সরকারি পরিসংখ্যান ও জনসাধারণের বাস্তব অভিজ্ঞতার মধ্যের এ পার্থক্য মূল্যস্ফীতির পরিমাপের পদ্ধতিগত সীমাবদ্ধতাকে নির্দেশ করছে। নীতিনির্ধারকরা সাধারণত বছরভিত্তিক মূল্যস্ফীতির হারকে বিবেচনায় নেন, যা বর্তমানে ৮-৯ শতাংশের কাছাকাছি। কিন্তু বছরের পর বছর কীভাবে মূল্যস্তর স্ফীত হয়েছে, সেদিকে তেমন মনোযোগ দেওয়া হয় না। যদিও এ হার দীর্ঘমেয়াদি দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। কেননা, এটি পরিবার, ব্যবসা এবং নীতি প্রণয়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

গত দুই দশকে মূল্যস্তরে কতটা পরিবর্তন ঘটেছে তা জানতে আমরা ২০০০-০১ অর্থবছর থেকে চলতি অর্থবছরের ক্রমসঞ্চিত মূল্যস্ফীতির তথ্য বিশ্লেষণ করেছি। বিশ্লেষণের মাধ্যমে গত ২৫ বছরে দ্রব্যমূল্যের গতিপ্রকৃতি তুলে ধরা হয়েছে। এ সময় বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ভোক্তা মূল্য সূচকের (সিপিআই) ভিত্তি বছর তিনবার পরিবর্তন করেছে ১৯৯৫-৯৬, ২০০৫-০৬ ও সর্বশেষ ২০২১-২২। আমরা মূল্যস্তরের তুলনামূলক বিশ্লেষণের জন্য ২০২১-২২ অর্থবছরকে ভিত্তি বছর হিসেবে নিয়েছি, যাতে বিশ্লেষণটি প্রাসঙ্গিক ও অর্থবহ হয়। সেই সঙ্গে বিভিন্ন সময়ের মূল্য পরিবর্তনের চিত্র সঠিকভাবে তুলে ধরা যায়। এ বিশ্লেষণ থেকে গত ২৫ বছরে মূল্যস্ফীতি কীভাবে সাধারণ পরিবারগুলোকে প্রভাবিত করে আসছে তার একটি পূর্ণাঙ্গ চিত্র পাওয়া যায়।

আমাদের গবেষণায় দেখা গেছে, ২০০০-০১ থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছর পর্যন্ত মূল্যস্তর (সাধারণ সিপিআই) বেড়েছে ৩৫৩ শতাংশ। এর অর্থ হলো, জীবনযাত্রার সামগ্রিক ব্যয় এ সময়ের মধ্যে সাড়ে চার গুণেরও বেশি বেড়েছে। সহজভাবে বললে, ২০০০-০১ সালে যে পণ্য বা পরিষেবা কিনতে মানুষকে ১০০ টাকা ব্যয় করতে হতো, এখন তা কিনতে ৪৫৩ টাকারও বেশি ব্যয় করতে হচ্ছে। অর্থাৎ ১০০ টাকার সঙ্গে ৩৫৩ টাকা যোগ হয়েছে। এর সূত্র হলো মূল দাম + (ক্রমসঞ্চিত মূল্যস্ফীতি দ্ধ মূল দাম)।

নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি খাদ্যের দাম বেড়েছে, যার হার ৪০১ দশমিক ৫ শতাংশ। নিম্ন ও নির্দিষ্ট আয়ের মানুষের আর্থিক চাপের পেছনে এটিই সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলেছে। কারণ তাদের বাজেটের বড় একটি অংশই খরচ হয় খাদ্য সংস্থানে। ভাত, ডাল, সবজিসহ অন্যান্য মৌলিক খাদ্যপণ্য যেগুলো ২০০০-০১ সালে তুলনামূলক মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে ছিল, বর্তমানে সেগুলোর পেছনে আয়ের একটি বড় অংশ ব্যয় হচ্ছে। এ কারণে আয় বৃদ্ধির পরও পরিবারগুলো আর্থিক টানাপড়েনের মধ্যে রয়েছে।

অন্যদিকে পোশাক, আবাসন, পরিবহনসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের দাম বেড়েছে ২৮৮ দশমিক ৭ শতাংশ। তবে এসব পণ্যের মধ্যেও কিছু পণ্যের দাম আরও দ্রুত ঊর্ধ্বমুখী হয়েছে। আসবাবপত্র এবং গৃহসজ্জা সামগ্রীর দাম বেড়েছে ৩৬৫ দশমিক ২ শতাংশ। অথচ এগুলো ২০০০-০১ অর্থবছরে ১ হাজার টাকায় কেনা যেত, বর্তমানে যা কিনতে ৪ হাজার ৬৩২ টাকারও বেশি খরচ করতে হচ্ছে। পরিবহন ও যোগাযোগ খাতে মানুষের ব্যয় বেড়েছে ৩৯৬ দশমিক ১ শতাংশ। পোশাক ও জুতার মূল্য বেড়েছে ৩২৫ দশমিক ১ শতাংশ। চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসেবায় ব্যয় বেড়েছে ২৩৪ দশমিক ৮ শতাংশ। এর বাইরে ব্যক্তিগত পর্যায় থেকে শুরু করে শিক্ষা ক্ষেত্রে বিভিন্ন পণ্য ও পরিষেবার দাম বেড়েছে ৩৬৯ দশমিক ১ শতাংশ। শুধু বিনোদন এবং শিক্ষা খাতে তুলনামূলক ব্যয় বাড়েনি, যার হার ১৭০ দশমিক ৩ শতাংশ। যদিও এ বৃদ্ধির হারও প্রায় তিন গুণের কাছাকাছি।

২৫ বছরের মতো দীর্ঘ সময়ের তথ্য মনে রাখা কঠিন। তাই ২০১০-১১ অর্থবছর থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছর পর্যন্ত- ১৩ বছরে ক্রমসঞ্চিত মূল্যস্ফীতির মধ্যমেয়াদি প্রবণতা দেখা যাক। এ সময়ে সাধারণ পণ্যের দাম বেড়েছে ১৩৮ দশমিক ২ শতাংশ। খাদ্যের দাম বেড়েছে আরও বেশি, যার হার ১৪৩ দশমিক ৮ শতাংশ। অর্থাৎ ২০১০-১১ অর্থবছরে যে পণ্যের দাম ১০০ টাকা ছিল, এখন তার মূল্য ২৩৮ টাকা এবং ১ হাজার টাকার খাদ্যপণ্যের জন্য এখন ২ হাজার ৪০০ টাকারও বেশি ব্যয় হচ্ছে। খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের মূল্য বেড়েছে ১৩১ দশমিক ৮ শতাংশ। এ থেকে এটিই প্রতীয়মান হয় যে মূল্যস্ফীতির চাপ এক দশকেরও বেশি সময় ধরে পারিবারিক বাজেটের প্রতিটি খাতকে প্রভাবিত করেছে।

কভিড মহামারি শুরুর পর, ২০২০-২১ অর্থবছর থেকে মাত্র তিন বছরে সাধারণ মূল্য ২৬ শতাংশ বেড়েছে। বছরে গড়ে ৯ শতাংশের কাছাকাছি দাম বেড়েছে। এ সময় খাদ্যপণ্যের দাম বেড়েছে ২৬ দশমিক ৭ শতাংশ। অর্থাৎ মহামারির সময় যে খাদ্যপণ্যের দাম ছিল ১০০০ টাকা তার দাম বর্তমানে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ২৬৭ টাকা। মধ্যমেয়াদি ও মহামারি-পরবর্তী সময়ের তথ্যগুলো প্রমাণ করে যে মূল্যস্ফীতি সাম্প্রতিক কোনো ঘটনা নয়। বহু বছর ধরেই মূল্যস্তরের ঊর্ধ্বমুখীপ্রবণতা বজায় আছে।

পরিসংখ্যান প্রণয়নকারী প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতি বছর হালনাগাদ তথ্য প্রকাশ করে। এটি নানা দিক থেকে ভালো। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, মানুষ সব সময় একই পণ্য কেনে না। একসময় মানুষ ক্যাসেটের ফিতা কিনত। কিন্তু বর্তমানে এর প্রচলন নেই বললেই চলে। তবে বর্তমানে অন্য অনেক পণ্য মানুষকে কিনতে হচ্ছে, যেমন ইন্টারনেট, স্মার্টফোন, রাইডশেয়ার ইত্যাদি যেগুলো ২০০১-০২ অর্থবছরে ছিল না। এছাড়া সময়ের পরিক্রমায় অনেক পণ্যের গুণগত মান পরিবর্তন হয়েছে। বিষয়টি শুধু মোবাইল ফোনের মডেলের পরিবর্তন লক্ষ করলেই বোঝা যায়। এসব পরিবর্তন লিপিবদ্ধ করতে পরিসংখ্যান প্রণয়নকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রতি বছর নির্দিষ্ট সময় অন্তর তথ্য হালনাগাদ করতে হয়।

কিন্তু এও সত্য যে ভিত্তি বছর পরিবর্তন করার কারণে ক্রমসঞ্চিত মূল্যস্ফীতির প্রভাব অনেকটাই আড়ালে থেকে যায়। যখন উচ্চমূল্যের সময়ে আমরা বেজলাইন ১০০ সেট করি, তখন পরবর্তী মূল্যস্ফীতি উপাত্তগুলো আপাতদৃষ্টিতে কম মনে হয়।

উদাহরণস্বরূপ, ওই বেজলাইন ধরার পর ৭ শতাংশ মূল্যস্ফীতি কম মনে হতে পারে। কিন্তু এটি ২০০১-০২-এর মূল্যস্ফীতির পরিপ্রেক্ষিতে ২৭১ শতাংশ বৃদ্ধি নির্দেশ করছে। এখানে আমার উদ্দেশ্য কারো ওপর দোষ চাপানো বা পরিসংখ্যান পদ্ধতিকে চ্যালেঞ্জ করা নয়, বরং অর্থনৈতিক তথ্য যেন সম্পূর্ণ তথ্য প্রদানের মাধ্যমে জনসাধারণের কাজে আসে তা নিশ্চিত করা।

এ সংখ্যাগুলো জীবনযাত্রার মানের ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তনকে নির্দেশ করে। ২০০০-০১ অর্থবছরে যে মধ্যবিত্ত পরিবার মাসে ৫০ হাজার টাকা আয় দিয়ে যে জীবন নির্বাহ করত সে মানের জীবন নির্বাহে বর্তমানে প্রায় ২ লাখ ২৭ হাজার টাকা প্রয়োজন। এ সংখ্যা ন্যূনতম মজুরি, সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি এবং দারিদ্র্য পরিস্থিতি নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় নীতিনির্ধারকদের কাছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, সরকারি মজুরি তথ্য দেখায় যে ২০১০-১১ অর্থবছর থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সাধারণ মূল্যস্ফীতি বেড়েছে ১৩৮ দশমিক ২ শতাংশ, যেখানে মজুরি বেড়েছে মাত্র ১১১ দশমিক ৭ শতাংশ। প্রকৃত অর্থে শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি বাড়লেও ক্রয়ক্ষমতা কমেছে। মজুরি-মূল্যস্ফীতির এ ব্যবধান পুরো দেশেই রয়েছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, তীব্র খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় থাকা মানুষের সংখ্যা ১ দশমিক ৬৫ কোটি থেকে বেড়ে ২ দশমিক ৩৬ কোটিতে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশের অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রমবাজারের প্রায় ৮৫ শতাংশ মানুষ কর্মরত থাকায় বেশির ভাগেরই ক্রয়ক্ষমতা ?সুরক্ষিত না।

ক্রয়ক্ষমতা ক্রমাগত হ্রাসের একটি বৃহত্তর অর্থনৈতিক প্রভাব রয়েছে। মূল্যবৃদ্ধি সাধারণত বিনিয়োগ এবং নতুন ব্যবসাকে আকৃষ্ট করে বলে ধারণা করা হয়। তবে বাংলাদেশে দীর্ঘস্থায়ী উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিপরীত ফল বয়ে এনেছে। ভবিষ্যতের ব্যয় নিয়ে অনিশ্চয়তা, ভোক্তাদের প্রকৃত ক্রয়ক্ষমতা কমে চাহিদা হ্রাস এবং উৎপাদনের বাড়তি ব্যয়ের কারণে লাভের মার্জিন কমে যাওয়া- এসব উৎপাদনশীল বিনিয়োগকে নিরুৎসাহিত করছে। প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করার পরিবর্তে দীর্ঘস্থায়ী মূল্যস্ফীতি অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করেছে। এতে বাজারে পণ্য সরবরাহ বৃদ্ধি এবং বাজারদর স্থিতিশীল রাখার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবসায়িক কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

সর্বোপরি এটাই বলা যায়, মূল্যস্ফীতির হালানাগাদকৃত তথ্য আমাদের প্রয়োজন আছে। তেমনি ক্রমসঞ্চিত মূল্যস্ফীতিও বিবেচনায় নিতে হবে। কার্যকরভাবে এগোনোর একটি বাস্তব উপায় হলো নিয়মিত হালনাগাদ করা ওজনসহ চেইন-ওয়েটেড সিপিআই পদ্ধতি গ্রহণ করা। এ পদ্ধতি পরিবর্তিত ব্যয়ধারার প্রতিফলন তো ঘটায়ই, পাশাপাশি অতীতের সঙ্গে তুলনাযোগ্যতাও ধরে রাখে- এমনভাবে, যা পরিবারের বাস্তবে অনুভূত ক্রমবর্ধমান মূল্যচাপকে আড়াল করে না।

সৈয়দ আবুল বাশার

অর্থনীতিবিদ ও গবেষক

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত