শিক্ষা নয়, সার্টিফিকেটের দৌড় : আমরা আসলে কী হারাচ্ছি

হেনা শিকদার

প্রকাশ : ২২ নভেম্বর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

আমাদের সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে একটি অলিখিত প্রতিযোগিতা চলছে। এটি ম্যারাথন নয়, যেন এক উন্মত্ত স্প্রিন্ট; যেখানে শেষ প্রান্তে পৌঁছানোই একমাত্র লক্ষ্য, দৌড়ের আনন্দ বা পথচলার অভিজ্ঞতা নয়। এই দৌড়ের নাম ‘সার্টিফিকেট অর্জন’। শিক্ষা নামক মহৎ ধারণাটি কখন যে এই কাগজের টুকরোর কাছে জিম্মি হয়ে পড়ল, তা আমরা হয়তো টেরও পাইনি। আজ আমরা এমন এক বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে আছি, যেখানে ‘কতটুকু শিখলে’ তার চেয়ে ‘কত নম্বর পেলে’ বা ‘কোন গ্রেড পেলে’ তা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

কিন্তু এই যে শ্রেষ্ঠত্বের অসুস্থ দৌড়, এই যে জ্ঞানকে বাদ দিয়ে সনদের পেছনে ছোটা-এর বিনিময়ে আমরা আসলে কী হারাচ্ছি? এর তালিকাটি দীর্ঘ এবং সম্ভবত আমাদের কল্পনার চেয়েও ভয়াবহ।

শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হলো- শিক্ষার্থীর কৌতূহলকে উসকে দেওয়া, তার ভেতরকার সুপ্ত প্রতিভাকে বিকশিত করা এবং তাকে একজন স্বয়ংসম্পূর্ণ চিন্তাশীল মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা। কিন্তু আমাদের বর্তমান ব্যবস্থা কৌতূহলকে পুরস্কৃত করে না, করে মুখস্থবিদ্যাকে।

যে শিক্ষার্থী ক্লাসে পাঠ্যবইয়ের বাইরের কোনো প্রশ্ন করত, যে নতুন কিছু আবিষ্কারের আনন্দে মেতে উঠত, সিস্টেম তাকে বলছে- থামো! ওটা পরীক্ষায় আসবে না। ফলে, জন্ম নিচ্ছে একদল দক্ষ ‘পরীক্ষার্থী’, যারা জানে কীভাবে নির্দিষ্ট সিলেবাসের মধ্যে থেকে সর্বোচ্চ নম্বর বের করে আনতে হয়। কিন্তু এই প্রক্রিয়ায় নীরবে মৃত্যু ঘটছে সেই কৌতূহলী ‘শিক্ষার্থীর’, যার হওয়ার কথা ছিল ভবিষ্যতের উদ্ভাবক বা দার্শনিক। আমরা জিপিএ-৫ পাচ্ছি, কিন্তু সৃজনশীলতা হারাচ্ছি।

যখন মূল লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায় একটি ভালো গ্রেড, তখন শেখার প্রক্রিয়াটি হয়ে পড়ে সংক্ষিপ্ত এবং নির্বাচনমূলক। শিক্ষার্থীরা ‘জ্ঞান’ অর্জন করে না, তারা পরীক্ষার জন্য ‘তথ্য’ সংগ্রহ করে। ফলে, কোনো একটি বিষয় গভীরভাবে বোঝা, বিভিন্ন বিষয়ের মধ্যে আন্তঃসংযোগ স্থাপন করা বা কোনো ঘটনার জটিল বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা তৈরি হচ্ছে না।

আমরা এমন একটি প্রজন্ম তৈরি করছি, যারা হয়তো জটিল গাণিতিক সূত্র মুখস্থ বলতে পারে; কিন্তু সেই সূত্রটি বাস্তব জীবনে কোথায় বা কেন প্রয়োগ করা হচ্ছে, তা তারা জানে না। তারা হয়তো ইতিহাস পরীক্ষার সাল-তারিখ নির্ভুল লেখে; কিন্তু সেই ঐতিহাসিক ঘটনার প্রেক্ষাপট বা সুদূরপ্রসারী প্রভাব নিয়ে দুই মিনিট কথা বলার ক্ষমতা রাখে না। আমরা হারাচ্ছি সেই প্রজ্ঞা, যা শুধু তথ্য নয়, তথ্যের পেছনের ‘কেন’ এবং ‘কীভাবে’-কে প্রশ্ন করতে শেখায়।

সার্টিফিকেটের এই দৌড়ের সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি সম্ভবত কর্মক্ষেত্রে গিয়ে উন্মোচিত হয়। প্রতি বছর আমরা হাজার হাজার গ্র্যাজুয়েট তৈরি করছি, যাদের হাতে প্রথমশ্রেণির ডিগ্রি আছে; কিন্তু সেই ডিগ্রির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ দক্ষতা নেই।

চাকরির বাজার চায় সমস্যা সমাধানের দক্ষতা, চায় নেতৃত্বগুণ, চায় প্রায়োগিক জ্ঞান। আর আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা উপহার দেয় একগুচ্ছ সনদ। ফলাফল? ‘শিক্ষিত’ বেকারের এক দীর্ঘ মিছিল, যারা তাদের অর্জিত সার্টিফিকেটের ওজন বহন করতে গিয়ে ক্লান্ত, কিন্তু সেই সার্টিফিকেটকে কাজে লাগানোর মতো দক্ষতা তাদের নেই। এটি শুধু ব্যক্তিগত হতাশা তৈরি করছে না, এটি জাতীয় অর্থনীতির ওপরও একটি প্রকাণ্ড বোঝা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। আমরা কর্মক্ষম জনশক্তি হারাচ্ছি, বিনিময়ে পাচ্ছি একদল সনদসর্বস্ব হতাশ যুবক।

যখন লক্ষ্য যে কোনো মূল্যে সার্টিফিকেট অর্জন, তখন ‘পথ’টি গৌণ হয়ে যায়, ‘গন্তব্য’ই মুখ্য হয়ে ওঠে। এই মানসিকতা থেকেই জন্ম নেয় পরীক্ষার হলে অসদুপায় অবলম্বন, প্রশ্নপত্র ফাঁসের মতো অনৈতিক চর্চা। যে শিক্ষার্থী বুঝতে শেখে যে, না পড়েও ‘সিস্টেমকে ম্যানেজ’ করে ভালো ফল করা সম্ভব, সে তার জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই সেই সংক্ষিপ্ত ও অসৎ পথটিই খুঁজবে।

শিক্ষা শুধু দক্ষতা দেয় না, শিক্ষা মানুষকে নৈতিকতা ও মূল্যবোধ শেখায়। কিন্তু যখন শিক্ষার মূল দর্শনই হয়ে দাঁড়ায় ‘প্রতিযোগিতায় জেতা’, তখন সততা, সহানুভূতি, সহযোগিতা- এই মানবিক গুণগুলো আর বিকশিত হওয়ার সুযোগ পায় না। আমরা হারাচ্ছি একটি সৎ ও মূল্যবোধসম্পন্ন সমাজ গড়ার কারিগর। জ্ঞানার্জন একটি আনন্দের প্রক্রিয়া। নতুন কিছু জানা, কোনো রহস্য উন্মোচন করা, নিজের সক্ষমতাকে আবিষ্কার করার মধ্যে যে অপার আনন্দ আছে, আমাদের বর্তমান ব্যবস্থা সেই আনন্দকে পদ্ধতিগতভাবে হত্যা করেছে।

শিশুদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া বইয়ের বোঝা, কোচিং সেন্টারের অমানবিক রুটিন এবং দিনরাত শুধু ‘ভালো ফলে’র জন্য অভিভাবকদের চাপ- এই সবকিছু মিলিয়ে শিক্ষা নামক সুন্দর প্রক্রিয়াটি পরিণত হয়েছে এক বিভীষিকায়। শিক্ষার্থীরা স্কুল-কলেজকে ভালোবাসছে না, তারা একে একটি কারাগার ভাবছে, যেখান থেকে একটি ‘সার্টিফিকেট’ পেলেই মুক্তি। আমরা একটি প্রজন্মকে শেখাচ্ছি যে, শেখা কোনো আনন্দের বিষয় নয়, এটি একটি যন্ত্রণাদায়ক দায়িত্ব মাত্র।

সংক্ষেপে বললে, আমরা ‘মানুষ’ গড়ার কারখানাকে ‘রোবট’ তৈরির কারখানায় পরিণত করেছি। আমরা এমন একদল মানুষ তৈরি করছি, যারা শিক্ষিত কিন্তু স্বশিক্ষিত নয়; যারা তথ্য জানে কিন্তু প্রজ্ঞাবান নয়; যারা সনদপ্রাপ্ত কিন্তু দক্ষ নয়।

আমরা হারাচ্ছি আমাদের ভবিষ্যতের উদ্ভাবক, আমাদের নীতিবান নেতা, আমাদের চিন্তাশীল নাগরিক। আমরা হারাচ্ছি সেই সোনালি সম্ভাবনা, যা একটি জাতিকে সত্যিকার অর্থে উন্নত করতে পারত। এই সার্টিফিকেটের দৌড় আমাদের হয়তো কিছু চকচকে গ্রেড দিচ্ছে; কিন্তু কেড়ে নিচ্ছে আমাদের জাতির আত্মাকে। সময় এসেছে এই আত্মঘাতী দৌড় থামানোর; সনদ নয়, সত্যিকার শিক্ষার পেছনে ছোটার।