ওষুধের দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা : বিপন্ন জনস্বাস্থ্য

ইব্রাহীম খলিল (সবুজ)

প্রকাশ : ২২ নভেম্বর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

হাসপাতালের একটি সাধারণ ওয়ার্ডে শয্যায় শুয়ে থাকা অসুস্থ মানুষটি নার্সের হাতে থাকা ওষুধের দিকে তাকিয়ে থাকেন ভয়ার্ত চোখে। কারণ রোগের চেয়ে বড় উদ্বেগ এখন ওষুধের দাম। পরের মাসে এই ওষুধ কিনতে পারবেন কিনা এই আশঙ্কায় তার নিঃশ্বাসে ভয়, চোখে অনিশ্চয়তা। একজন ডায়াবেটিস রোগী প্রতিদিন ভোরে ইনসুলিন নেন। কিন্তু এখন তার সবচেয়ে বড় দুশ্চিন্তা- রক্তে চিনি নয়, পরবর্তী ইনসুলিনের দাম। যেন শ্বাস নিতে গেলেও এখন তার আগে হিসাব কষতে হয় আরেক প্যাকেট ইনসুলিন কি তিনি কিনতে পারবেন? এই চিত্র শুধু একজনের নয়; বাংলাদেশের লাখো মানুষের প্রতিদিনকার সার্বিক বাস্তবতা।

স্বাস্থ্যসেবা মানুষের সাংবিধানিক মৌলিক অধিকার। অথচ সেই অধিকার আজ সবচেয়ে বেশি হুমকির মুখে পড়েছে ওষুধের লাগামহীন দাম বৃদ্ধির কারণে। নিত্যপ্রয়োজনে ব্যবহৃত প্যারাসিটামল, গ্যাস্ট্রিকের ওমিপ্রাজল-ইসোমিপ্রাজল, অ্যাসপিরিন, সাধারণ সংক্রমণের আমোক্সিসিলিন, এলার্জির লেভোসেটিরিজিন, ক্যালসিয়াম, ইনসুলিন- এসব যেসব ওষুধ মানুষের জীবন বাঁচায়, সেগুলোরই দাম বেড়েছে ২০% থেকে ১৪০% পর্যন্ত। যেসব রোগে প্রতিদিন নিয়মিত ওষুধ প্রয়োজন- ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ সেসব রোগীরাই সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়েছেন। দামের চাপে অনেকেই বাধ্য হয়ে ওষুধের ডোজ কমিয়ে দিচ্ছেন বা বন্ধ করে দিচ্ছেন। এতে সাধারণ অসুস্থতা জটিল হয়ে স্ট্রোক, হার্ট অ্যাটাক, কিডনি ফেইলিওরের মতো ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি করছে। অ্যান্টিবায়োটিকের কোর্স অসমাপ্ত রাখার কারণে বাড়ছে অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স (AMR), যা ভবিষ্যতে সাধারণ সংক্রমণকেও জীবননাশের ঝুঁকিতে পরিণত করবে।

স্বাস্থ্যগত সংকটের মতোই ভয়াবহ এর অর্থনৈতিক প্রভাব। বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যয়ের প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষকে ব্যক্তিগতভাবে বহন করতে হয়, আর ওষুধই সেই ব্যয়ের বড় অংশ। ফলে সাধারণ পরিবারগুলো খাবার, বস্ত্র, শিক্ষা বা বাসস্থানের মতো মৌলিক প্রয়োজন থেকেও কাটছাঁট করছে শুধু ওষুধ কেনার জন্য। অনেকে আবার ঋণে জড়িয়ে পড়ছেন নিয়মিত চিকিৎসা চালিয়ে যেতে গিয়ে। নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো তাই দ্রুত দারিদ্র্যের ঝুঁকিতে পড়ছে। উপরন্তু বাড়ছে মানসিক চাপ ও হতাশা।

এই সংকটের মূল কারণ নিয়ন্ত্রক কাঠামোর দুর্বলতা। ১৯৯৪ সালের গেজেট অনুযায়ী সরকার মাত্র ১১৭টি জেনেরিক ওষুধের দাম নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। ফলে অন্যান্য ওষুধের দাম নির্ধারণে কোম্পানিগুলোর ইচ্ছামতো সিদ্ধান্তই কার্যত চূড়ান্ত হয়ে যাচ্ছে। সম্প্রতি সরকার ২৬০টি ওষুধের দাম বেঁধে দিলেও, এই তালিকা আরও বিস্তৃত করা জরুরি। এজন্য পুরোনো গেজেট সংশোধন করে নতুনভাবে প্রয়োজনীয় ওষুধের তালিকা নির্ধারণ করা প্রয়োজন। সঙ্গে লাগবে একটি কোম্পানি-প্রভাবমুক্ত স্বাধীন বিশেষজ্ঞ কমিশন, যারা ওষুধের প্রকৃত উৎপাদন ব্যয় ও বাজার বাস্তবতা বিবেচনা করে ন্যায্য দাম নির্ধারণ করতে পারবে। বিদেশনির্ভরতা কমাতে কাঁচামালের স্থানীয় উৎপাদন বাড়ানো জরুরি।

চিকিৎসকদের জেনেরিক নামে ওষুধ লেখার বাধ্যবাধকতা এবং ভোক্তাদের সচেতনতা বৃদ্ধিও প্রয়োজন। আমাদের বুঝতে হবে, স্বাস্থ্যসেবা কোনো বিলাসিতা নয়, এটি সংবিধান প্রদত্ত মৌলিক অধিকার। একটি সমাজ কতটা মানবিক, তা বোঝা যায় অসুস্থ মানুষের প্রতি তার আচরণে। ওষুধ যদি মানুষের হাতের নাগালের বাইরে চলে যায়, তবে রাষ্ট্রের মানবিকতার ভিত্তিই নড়বড়ে হয়ে যায়। তাই এখনই প্রয়োজন শক্তিশালী, কার্যকর ও জরুরি পদক্ষেপ যাতে জীবনরক্ষাকারী ওষুধ মানুষের নাগালের মধ্যে ফিরে আসে। একটি ট্যাবলেট যা মানুষের জীবনের ভার বহন করে- তার দামও যেন মানুষের বহনসাধ্য হয়। এটাই এখন সময়ের সবচেয়ে জরুরি, সবচেয়ে মানবিক দাবি।

ইব্রাহীম খলিল (সবুজ)

শিক্ষার্থী, আইন ও ভূমি প্রশাসন অনুষদ পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়