নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে বিনিয়োগের ভবিষ্যৎ

জান্নাতুল ফেরদাউস অহনা

প্রকাশ : ২৩ নভেম্বর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

বিশ্ব আজ খুব দ্রুত বদলে যাচ্ছে। দশ বছর আগেও নবায়নযোগ্য জ্বালানি অনেকের কাছে ছিল ভবিষ্যতের কোনো দূরস্বপ্নের মতো। আগে মানুষ মূলত কয়লা, গ্যাস ও তেল- এই জীবাশ্ম জ্বালানির ওপরই নির্ভর করত। কিন্তু এসব জ্বালানি সীমিত, দাম ওঠানামা করে, আর পরিবেশের জন্যও ক্ষতিকর। তাই এখন দেশগুলো এমন উৎসের দিকে ঝুঁকছে যা শেষ হয়ে যাবে না, পরিবেশ দূষণ করবে না এবং দীর্ঘমেয়াদে সাশ্রয়ী হবে। এই কারণেই নবায়নযোগ্য জ্বালানির গুরুত্ব দিন দিন বাড়ছে।

বিশ্বে নবায়নযোগ্য জ্বালানির উত্থান ঘটছে-

গত এক দশকে সৌরবিদ্যুৎ ও বায়ুশক্তির ব্যবহার বিশ্বব্যাপী কয়েকগুণ বেড়েছে। সৌর প্যানেলের দাম কমে যাওয়ায় অনেকে বাড়ি-বাড়ি ছাদে প্যানেল বসাচ্ছে। বড় বড় কোম্পানি ও শিল্পকারখানাও এখন নবায়নযোগ্য শক্তিকে ভবিষ্যতের নিরাপদ বিনিয়োগ হিসেবে দেখছে। কারণ এই শক্তি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে খরচ কম, রক্ষণাবেক্ষণ সহজ, আর জ্বালানির দাম আন্তর্জাতিক বাজারের ওঠানামার উপর নির্ভর করে না।

অনেক দেশ তাদের জাতীয় বাজেটেই নবায়নযোগ্য খাতকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে। কেউ কেউ আবার জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর কর বাড়িয়ে নবায়নযোগ্য উৎসে বিনিয়োগকারীদের প্রণোদনা দিচ্ছে। ফলে একদিকে পরিবেশ বাঁচছে, অন্যদিকে দেশের জ্বালানি নিরাপত্তাও নিশ্চিত হচ্ছে।

বাংলাদেশের সম্ভাবনা এবং বাস্তবতার দিকে তাকালে দেখতে পাই-

বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার এখনও খুব বেশি নয়, তবে সম্ভাবনা বিশাল। বাংলাদেশে বিদ্যুতের চাহিদা প্রতি বছর বাড়ছে। শিল্পকারখানার প্রসার, জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং প্রযুক্তি ব্যবহারের বিস্তার, সব মিলিয়ে বিদ্যুৎ এখন জীবনের অপরিহার্য অংশ। কিন্তু বিদ্যুৎ উৎপাদনে আমরা এখনও গ্যাস, কয়লা ও আমদানি করা জ্বালানির ওপর বেশি নির্ভরশীল। এসব উৎসের সীমাবদ্ধতাও আছে-

গ্যাসের মজুত কমে আসছে। জ্বালানি আমদানি করতে বৈদেশিক মুদ্রা খরচ হয়। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির দাম ওঠাণ্ডনামা করে। কয়লা ও তেল পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। এই কারণে বাংলাদেশের সামনে নবায়নযোগ্য জ্বালানি এখন শুধু ‘ইচ্ছা’ নয়, বরং গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজন।

সৌরবিদ্যুৎ, আমাদের সবচেয়ে বড় সম্ভাবনা হয়ে দাঁড়িয়েছে-

বাংলাদেশে রোদ প্রচুর। বছরের অধিকাংশ সময় আকাশ পরিষ্কার থাকে। ফলে সৌরবিদ্যুৎ দেশের জন্য সবচেয়ে উপযোগী উৎস হতে পারে। শহরের বাড়ি, অফিস ও স্কুলের ছাদ ব্যবহার করা গেলে বিপুল পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব। শিল্পকারখানায় সৌরবিদ্যুতের ব্যবহার বাড়ালে জাতীয় গ্রিডের ওপর চাপ কমবে। গ্রামাঞ্চলে সৌর হোম সিস্টেম বহু পরিবারকে আলোর মুখ দেখিয়েছে, এটি ভবিষ্যতে আরও বিস্তৃত করা যেতে পারে। বায়ুশক্তি, উপকূলীয় এলাকার এক মূল্যবান সম্পদ : সাতক্ষীরা, কক্সবাজার, কুতুবদিয়া, পায়রা, এগুলো এমন অঞ্চল যেখানে বাতাসের গতি বায়ুশক্তি উৎপাদনের জন্য উপযোগী। যদি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নেওয়া হয়, তাহলে উপকূলীয় এলাকায় বড় বায়ু টারবাইন বসানো সম্ভব, যা দেশের বিদ্যুৎ চাহিদার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ যোগান দিতে পারে।

বায়োমাস এবং বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন-

কৃষিজ বর্জ্য, পশুর গোবর, মিল-কারখানার বর্জ্য,এসব থেকেই বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব। একদিকে বর্জ্য কমবে, অন্যদিকে সাশ্রয়ী বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে। কৃষিভিত্তিক বাংলাদেশের জন্য এটি একটি বাস্তবসম্মত পথ।

কেন বিনিয়োগ জরুরি? নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে বিনিয়োগ শুধু পরিবেশ রক্ষার জন্য নয়, এটি অর্থনৈতিকভাবেও লাভজনক। প্রযুক্তির খরচ কমে যাওয়ায় সৌর ও বায়ুশক্তি থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ এখন অনেক দেশে জীবাশ্ম জ্বালানির বিদ্যুতের চেয়েও সস্তা। দীর্ঘমেয়াদে এটি দেশের অর্থনীতি ও জনগণের আর্থসামাজিক অবস্থার উপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।

বাংলাদেশের জন্যও এই বিনিয়োগ অত্যন্ত প্রয়োজন। বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য আমরা গ্যাস, কয়লা ও আমদানি করা জ্বালানির ওপর অনেক বেশি নির্ভরশীল। বৈশ্বিক বাজারে এসব পণ্যের দাম বাড়লে দেশের অর্থনীতি চাপের মুখে পড়ে। কিন্তু সৌর বা বায়ু- এই শক্তিগুলো আমাদের নিজস্ব, বিনামূল্যের প্রাকৃতিক সম্পদ। এতে বিনিয়োগ করলে দেশের ওপর বাইরের নির্ভরতা কমে।

নবায়নযোগ্য জ্বালানি শুধু ভবিষ্যতের প্রয়োজন নয়- এটি দেশের উন্নয়নের অপরিহার্য অংশ। নতুন শিল্প গড়ে উঠবে, কর্মসংস্থান বাড়বে, বিদ্যুৎ সংকট কমবে এবং পরিবেশ থাকবে পরিচ্ছন্ন। ভবিষ্যতে যে দেশগুলো এই খাতে বিনিয়োগ বাড়াবে, তারা হবে অর্থনৈতিকভাবে আরও শক্তিশালী ও টেকসই।

বাংলাদেশের সামনে সুযোগ এখনই। সঠিক সিদ্ধান্ত ও পরিকল্পনা নিলে নবায়নযোগ্য জ্বালানিই হতে পারে আমাদের শক্তিশালী আগামী দিনের ভিত্তি।

জান্নাতুল ফেরদাউস অহনা

শিক্ষার্থী, লোকপ্রশাসন বিভাগ