ভূমিকম্পের ভয়াবহতা আমাদের শিখিয়ে দিল প্রকৃতির কাছে কতটা অসহায় আমরা
ড. মো. আনোয়ার হোসেন
প্রকাশ : ২৩ নভেম্বর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

হঠাৎ করেই আমার ঘরের ভেতরকার জিনিসপত্র কাঁপতে শুরু করে। প্রথমে ভেবেছিলাম, হয়তো কোনো বড় গাড়ি যাচ্ছে। কিন্তু কিছুক্ষণ পর ঘরের দেয়ালও কাঁপতে শুরু করে। তখন বুঝলাম, এটা ভূমিকম্প। ভূমিকম্পের সময় চারপাশের সবকিছুও কাঁপছিল। প্রথমে মনে হচ্ছিল যেন কোনো দৈত্য বাড়িঘর ধরে ঝাঁকাচ্ছে। কাঁচের জিনিসপত্র ভেঙে পড়ছিল, আসবাবপত্র পড়ে যাচ্ছিল, আর মানুষজন ভয়ে চিৎকার করছিল। আমার মা আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করছিল। আমিও দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে আসি।
কিছুক্ষণ পর যখন কম্পন থেমে যায়, তখন চারপাশ শান্ত হয়ে আসে। কিন্তু সবার মনে তখন ভয়। সবাই একে অপরের দিকে তাকিয়ে আছে। রাস্তায় প্রচুর মানুষ জড়ো হয়েছে, কেউ বাড়ির ভেতর ঢুকতে সাহস পাচ্ছে না। ভূমিকম্পের পর, মানুষ আতঙ্কিত হলেও কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। সবাই একে অন্যকে সাহস জোগাচ্ছিল। গতকাল শুক্রবার, ২১ নভেম্বর ২০২৫, সকালে রাজধানী ঢাকাসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে একটি ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। প্রাথমিক তথ্য অনুযায়ী, এর মাত্রা ছিল ৫.৫ বা ৫.২ রিখটার স্কেল এবং উৎপত্তিস্থল ছিল নরসিংদীর ঘোড়াশালের কাছাকাছি এলাকা। সকাল ১০টা ৩৮ মিনিট থেকে ১০টা ৩৯ মিনিটের মধ্যে। মাত্রা (প্রাথমিক) ৫.৫ বা ৫.২ রিখটার স্কেল। ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ঘোড়াশালের নিকটবর্তী এলাকা (নরসিংদী) ভূমিকম্পের সময় রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দারা আতঙ্কে ঘর থেকে রাস্তায় বেরিয়ে আসেন। নরসিংদীতে তীব্র ভূমিকম্পের প্রভাবে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে ১০ জনে দাঁড়িয়েছে। ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থল নরসিংদীতে পাঁচজন নিহত হয়েছেন, ঢাকায় চার ও নারায়ণগঞ্জে একজন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। এখন পর্যন্ত আহতের সংখ্যা ৪৫০। গত শুক্রবার সন্ধ্যায় এ তথ্য জানিয়েছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের পরিবীক্ষণ ও তথ্য ব্যবস্থাপনা অনুবিভাগ।
ভূমিকম্পের ভয়াবহতার ইতিহাস জুড়ে এমন বেশ কিছু ঘটনা রয়েছে যা বিপুল সংখ্যক মানুষের মৃত্যু এবং ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ ঘটিয়েছে। এগুলি মানব ইতিহাসের সবচেয়ে মারাত্মক প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলোর মধ্যে অন্যতম। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য এবং মারাত্মক কয়েকটি ভূমিকম্প নিচে উল্লেখ করা হলো : ১৫৫৬ সালের শানসি ভূমিকম্প (চীন)-এটি ইতিহাসের সবচেয়ে মারাত্মক নথিভুক্ত ভূমিকম্প। আনুমানিক ৮,৩০,০০০ মানুষের মৃত্যু হয়েছিল এই ঘটনায়। এই অঞ্চলের বেশিরভাগ মানুষ নরম শিলায় খোদাই করা গুহায় বাস করত, যা ভূমিকম্পের সময় ধসে পড়েছিল। ১৯৭৬ সালের তাংশান ভূমিকম্প (চীন)-এই ভূমিকম্পে আনুমানিক ২,৫৫,০০০ জন মারা গিয়েছিল, যদিও কিছু হিসাবে মৃতের সংখ্যা ৬,৫৫,০০০ পর্যন্ত অনুমান করা হয়। এটি আধুনিক ইতিহাসের অন্যতম ভয়াবহ ভূমিকম্প। ১১৪১ সালের আলেপ্পো ভূমিকম্প (সিরিয়া)-এই প্রাচীন ভূমিকম্পে প্রায় ২,৩০,০০০ মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। ২০১০ সালের হাইতি ভূমিকম্প- সাম্প্রতিক ইতিহাসের অন্যতম ভয়াবহ দুর্যোগ এটি, যেখানে মৃতের সংখ্যা প্রায় ৩,১৬,০০০ জন ছিল। যদিও ভূমিকম্পে মৃত্যুর সংখ্যা সবসময় মাত্রার সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত নয়, তবে সর্বোচ্চ মাত্রার কয়েকটি ভূমিকম্প হলো: ১৯৬০ সালের ভালদিভিয়া ভূমিকম্প (চিলি)- ৯.৫ মাত্রার এই ভূমিকম্পটি যন্ত্র দ্বারা রেকর্ড করা সবচেয়ে শক্তিশালী ভূমিকম্প। এটি প্রায় ১,৬৫৫ জনের প্রাণহানি ঘটায় এবং সুনামির সৃষ্টি করে যা প্রশান্ত মহাসাগর জুড়ে প্রভাব ফেলেছিল। ১৯৬৪ সালের গ্রেট আলাস্কা ভূমিকম্প (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র)-এটি ৯.২ মাত্রার ছিল এবং একটি বড় সুনামি তৈরি করেছিল। তুলনামূলকভাবে কম জনবসতিপূর্ণ এলাকা হওয়ায় প্রায় ১২৮ জনের মৃত্যু হয়েছিল। ২০০৪ সালের ভারত মহাসাগরের ভূমিকম্প ও সুনামি (ইন্দোনেশিয়া): ৯.১ থেকে ৯.৩ মাত্রার এই ভূমিকম্পটি ভারত মহাসাগরে একটি বিশাল সুনামি সৃষ্টি করে, যার ফলে এক ডজনেরও বেশি দেশে প্রায় ২,৩০,০০০ মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। এটি আধুনিক ইতিহাসের অন্যতম বৃহৎ মানবিক বিপর্যয়। ২০১১ সালের তোহোকু ভূমিকম্প ও সুনামি (জাপান): ৯.১ মাত্রার এই ভূমিকম্পের ফলে সৃষ্ট সুনামি প্রায় ১৮,৫০০ মানুষের জীবন কেড়ে নেয় এবং ফুকুশিমা পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে বিপর্যয় ঘটায়।
বাংলাদেশে ভূমিকম্পের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ ঘটনা হলো ১৭৬২ সালের আরাকান ভূমিকম্প, যার মাত্রা ছিল প্রায় ৮.৫৮ থেকে ৮.৮৮। এছাড়াও, ১৮৯৭ সালের আসামণ্ডমেঘালয় (বাংলাদেশ-সীমানার কাছাকাছি) ভূমিকম্প (৮.১৮মাত্রার) এবং শ্রীমঙ্গলের ১৯১৮ সালের (৭.৬৭ মাত্রার) ভূমিকম্পও বেশ বিধ্বংসী ছিল। এই ভূমিকম্পগুলো ব্যাপক প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতির কারণ হয়েছিল এবং এর ফলে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার উপকূলে ভূমি ডুবে যাওয়া এবং জলোচ্ছ্বাস সৃষ্টি হয়েছিল। উল্লেখযোগ্য ভূমিকম্পগুলো : ১৭৬২ সালের আরাকান ভূমিকম্প- এটি বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে শক্তিশালী ভূমিকম্প হিসেবে বিবেচিত, যার মাত্রা ছিল প্রায় ৮.৫৮থেকে ৮.৮৮। এর প্রভাবে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার উপকূলে ভূমি ডুবে যায় এবং জলোচ্ছ্বস হয়, যার ফলে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ ঘটে। ১৮৯৭ সালের আসামণ্ডমেঘালয় ভূমিকম্প-এর মাত্রা ছিল ৮.১৮এবং এটি বাংলাদেশের কাছাকাছি অঞ্চলে আঘাত হেনেছিল, যার ফলে বিপুল সংখ্যক মানুষের মৃত্যু হয় ও সম্পদহানি ঘটে। ১৯১৮ সালের শ্রীমঙ্গল ভূমিকম্প-এটি একটি বিধ্বংসী ভূমিকম্প ছিল যার মাত্রা ছিল ৭.৬৭। এর কেন্দ্রস্থল ছিল শ্রীমঙ্গলের বালিসেরা উপত্যকায়। ১৯৯৭ সালের চট্টগ্রাম ভূমিকম্প-এই ভূমিকম্পে ২৩ জন নিহত ও ২০০ জন আহত হয়েছিল। বাংলাদেশ ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে থাকা একটি দেশ, এবং বিশেষজ্ঞরা মনে করেন ভবিষ্যতে এখানে ৮.২৮ থেকে ৯.০৯ মাত্রার একটি বড় ভূমিকম্প হতে পারে। বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন যে, বড় ধরনের ভূমিকম্পের জন্য বাংলাদেশ এখনও পুরোপুরি প্রস্তুত নয়, বিশেষ করে অপরিকল্পিত নগরায়নের কারণে ঝুঁকি আরও বাড়ছে। ভূমিকম্পের ভয়াবহতা শুধুমাত্র এর মাত্রার ওপর নির্ভর করে না, বরং আঘাত হানা এলাকার জনসংখ্যার ঘনত্ব, অবকাঠামোর ধরন এবং পরবর্তী সুনামি বা ভূমিধসের মতো দুর্যোগের ওপরও নির্ভর করে।
ভূমিকম্প প্রতিরোধে বিভিন্ন ধর্মীয় নির্দেশনা, যেমন ইসলামে ভূমিকম্পকে আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি সতর্কবার্তা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এর প্রতিক্রিয়ায়, মুসলিমদের উচিত পাপ কাজ ত্যাগ করে আল্লাহর কাছে তওবা করা এবং ক্ষমা প্রার্থনা করা। এই সময় আল্লাহর কুদরতের কথা স্মরণ করা এবং তাকে বেশি বেশি স্মরণ করার উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। অন্যান্য ধর্মীয় বিশ্বাসেও প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় বিপদে পড়া মানুষের পাশে দাঁড়ানো, একে অন্যকে সাহায্য করা এবং আধ্যাত্মিক চর্চার মাধ্যমে শান্তি খুঁজে নেওয়ার উপর জোর দেওয়া হয়। সাধারণভাবে যেকোনো ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে একে অপরের প্রতি সহমর্মিতা এবং সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া উচিত।
এ ধাপে ঢাকায় ভয়াবহ ভূমিকম্প হলে কি হতে পারে, সচেতনতার লক্ষ্যে এমন একটি কাল্পনিক গল্প ধ্বংসযজ্ঞ যোগ করা হলো: একদিন ভোরের আলো ফুটতেই ঢাকার আকাশে এক কালো ছায়া নেমে এলো। প্রথমে হালকা ঝাঁকুনি, তারপর হঠাৎ এক ভয়াবহ কম্পন। লাখো মানুষ ঘুম থেকে জেগে ওঠার আগেই তাদের ঘরবাড়ি, কর্মস্থল, প্রিয় সবকিছু চোখের পলকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হতে শুরু করলো। পুরোনো বাড়িগুলো ধসে পড়ল, রাস্তাঘাট ফেটে গেল। চারদিকে কেবল আর্তনাদ আর কান্নার রোল। ঢাকা শহরের বেশিরভাগ ভবনই ভূমিকম্প-প্রতিরোধী নয়। একটি বড় ভূমিকম্পে শত শত ভবন ধসে পড়ল।
ভূমিকম্পে রাস্তাঘাট ভেঙে যাওয়ায় অ্যাম্বুলেন্স, ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি এবং উদ্ধারকারী দল দুর্গত এলাকায় পৌঁছাতে পারেনি। বহু মানুষ চাপা পড়ে আছে, উদ্ধারকারী দলের অভাবে তাদের বাঁচার আশা ক্ষীণ হয়ে আসছে। অনেকেই আহত অবস্থায় খোলা আকাশের নিচে আশ্রয় নিয়েছে, তাদের জন্য খাদ্য, পানি ও চিকিৎসার ব্যবস্থা নেই। বিদ্যুৎ, গ্যাস এবং পানির লাইন ছিঁড়ে গেছে। মোবাইল এবং ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। শহরটি সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া ঢাকা শহরকে আবার আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা প্রায় অসম্ভব। এই ধ্বংসযজ্ঞের কারণে ঢাকা শহর এক ভয়াবহ মানবিক এবং অর্থনৈতিক সংকটের মুখোমুখি হয়েছে।
ভূমিকম্প পুরোপুরি প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়, তবে ক্ষয়ক্ষতি কমাতে সরকার কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে : নতুন ভবন নির্মাণের জন্য কঠোর বিল্ডিং কোড এবং বিধিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা। বিদ্যমান ভবনগুলোর (বিশেষ করে পুরনো ও ঝুঁকিপূর্ণ ভবন) নির্মাণ-কৌশল উন্নত করতে তাদের শক্তিশালীকরণের জন্য বাধ্য করা। ভূমিকম্প-প্রবণ অঞ্চলে বড় ধরনের ভবন নির্মাণের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করা। ভূমিকম্পের সময় নিরাপদ আশ্রয়স্থল হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে এমন খোলা জায়গাগুলো চিহ্নিত করা ও রক্ষা করা। ভূমিকম্পের সময় করণীয় সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করার জন্য নিয়মিত প্রচার ও প্রশিক্ষণ কর্মসূচির আয়োজন করা। স্কুল, কলেজ এবং কর্মক্ষেত্রে ভূমিকম্প-প্রতিরোধী আচরণ সম্পর্কে শিক্ষা প্রদান করা। জরুরি সাড়াদান ব্যবস্থা- ভূমিকম্পের পর উদ্ধার ও ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনার জন্য জরুরি সাড়াদানকারী দল এবং সরঞ্জাম প্রস্তুত রাখা। বিদ্যুৎ, গ্যাস এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা, যেমন- টেলিফোন লাইন, ভূমিকম্পের সময় যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সে বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া। ভূমিকম্পের কারণ এবং ঝুঁকির মাত্রা বোঝার জন্য গবেষণা ও পূর্বাভাস ব্যবস্থার উন্নয়ন করা।
আজকের এই ভূমিকম্প আমাদের শিখিয়ে দিল, আমাদের প্রকৃতির সামনে কতটা অসহায়।
ড. মো. আনোয়ার হোসেন
প্রাবন্ধিক ও কথা সাহিত্যিক
