নিদ্রাহীন মানুষ : অদৃশ্য এক অবসাদ

আরশী আক্তার সানী

প্রকাশ : ২৪ নভেম্বর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

শহর আসলে জন্ম থেকেই ব্যস্ত। কিন্তু একসময় এই ব্যস্ততারও সীমা ছিল। সন্ধ্যার পর রাস্তায় নরম নরম বাতাস বয়ে যেত, দোকানপাটের শাটার অল্প অল্প করে নেমে আসত, আর মানুষ নিজেদের ছুটোছুটি গুটিয়ে নিয়ে পরিবার, গল্প, খাবার আর ঘুমের দিকে ফিরত। তখন রাত ছিল বিশ্রামের, শান্তির, নিজের ভেতরটা শুনে নেওয়ার সময়। শহর যেন দিনের শেষে নিজেকেও একটু থামতে দিত, মানুষের মতোই। আজকের শহর আর সেই শহর নেই। এখন রাতও একটি আলাদা দিন আরো বড়, আরো চঞ্চল, আরো শব্দে ভরা এক দিন। শহরের আলো যেমন নিভে না, তেমনি মানুষের চোখও যেন আর পুরোপুরি বন্ধ হয় না। মোড়ের চায়ের দোকানে রাত একটা বাজলেও ভিড় থাকে, রাইডার ছুটে চলে, অর্ডার ডেলিভারি হয়, মানুষের পদচারণা শোনা যায়। মনে হয়, শহর যেন নিজের জীবনীশক্তির এক নতুন মানচিত্র তৈরি করেছে, যেখানে বিশ্রামের জায়গা খুবই ছোট।

দিনের কাজ শেষে মানুষ বাড়ি ফিরে; কিন্তু মাথা ফের ব্যস্ত হয়ে যায়। কে কত বেশি কাজ করছে, কার কাজের ডেডলাইন কবে, কার প্রেজেন্টেশন তৈরি হয়নি- এসব ছোট-বড় দুশ্চিন্তা মাথার ভেতর গাদাগাদি করে। কেউ বিছানায় শুয়েও ফোন স্ক্রল করতে থাকে। চোখ ক্লান্ত, শরীর অবসন্ন তবুও মন থামে না। রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগেও মানুষ যেন নিজের ভেতরের তাল মিলাতে পারে না।

এই তাল-মিলনহীন জীবনই মানুষকে আরও নিদ্রাহীন করে। অনেকেই ভাবে কিছু হয়নি, কাল ঘুমিয়ে নিব। কিন্তু সেই ‘কাল’ আর আসে না। প্রতিদিন এক নতুন ব্যস্ততা এসে দাঁড়ায়। প্রতিদিন রাতে মানুষ ভাবে এবার একটু বাড়তি বিশ্রাম নেব। কিন্তু বাস্তবে হয় উল্টো। ফোনের আলো, নোটিফিকেশনের টিং টিং শব্দ, মনের অনিশ্চয়তা সব মিলিয়ে ঘুম যেন মানুষের কাছে দূরের কোনো স্বপ্ন হয়ে যায়।

রাতের শহরে তাকালে বোঝা যায় কেউ যেন থামতে চায় না। হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্স ঠিক ততটাই ব্যস্ত থাকে রাতে, যতটা দিনে থাকে। ফাস্টফুড দোকানে কাস্টমার কমে না, ক্যাফেগুলো রাত ২টা পর্যন্ত খোলা থাকে, রাস্তার মোড়ে রিকশা চালকদের লাইট জ্বলে থাকে। যেন শহর নিজেকে প্রমাণ করতে চায় আমি এখন ২৪ ঘণ্টার। আর মানুষও যেন অজান্তেই সেই চক্রে আটকে গেছে। এই রাতজাগা অভ্যাস শুধু শরীরকে ক্লান্ত করে না। এটা মনকেও অদ্ভুতভাবে নিঃশেষ করে দেয়।

ঘুম কম হলে মন ভারী হয়ে যায়, সহজে উত্তেজিত হয়, হালকা হতাশা জমে থাকে। সকালে ঘুম থেকে উঠে মনে হয় কিছু যেন ঠিক হয়নি। শরীর ঠিকঠাক কাজ করে; কিন্তু মন করে না। কেউ বলে মুড অফ কেউ বলে আজকে একটু বিরক্ত লাগছে। কিন্তু এইসবই আসলে সেই অদৃশ্য অবসাদের প্রভাব। যেটা দেখা যায় না; কিন্তু মানুষের ভেতরটাকে ধীরে ধীরে খেয়ে ফেলে। একসময় মানুষ নিজের মনের কথাও শুনতে ভুলে যায় ব্যস্ততার মাঝে মন চিৎকার করে বলে একটু থামো। কিন্তু সেটা কেউ শোনে না। আর তখনই শুরু হয় নিদ্রাহীনতার যাত্রা যা ধীরে ধীরে দৈনন্দিন জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে দাঁড়ায়। মানুষ ভাবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সত্য হলো- এটা আদৌ স্বাভাবিক নয়। দিনের পরে দিন এই ক্লান্তি জমতে থাকে। হালকা মাথাব্যথা, ছোটখাটো ভুল, কাজে মন না বসা, একটুখানি কথাতেও বিরক্তি এগুলো সবই সেই হারিয়ে যাওয়া ঘুমের হিসাব।

মানুষ ভাবে, একটু পর ঘুমাবো। কিন্তু সেই একটু পর কখন যেন রাত ৩টা হয়ে যায়। কিন্তু শহর যেমন থামবে না, মানুষকেও তেমনি থামতে শিখতে হবে। কারণ শহরের গতি মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে না মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে তার অভ্যন্তরের শান্তি, তার বিশ্রাম, তার ঘুম। নিজেকে সময় দেওয়া, ফোন বন্ধ করে রাখা, নিজের চিন্তাগুলোকে সাজানো, রাতকে রাতের মতো ব্যবহার করা, এসব ছোট ছোট অভ্যাসই মানুষকে সেই অদৃশ্য অবসাদ থেকে দূরে নিতে পারে। নিজের ভেতরের মানুষটাকে ভালো রাখতে হলে, কিছুটা সময় তাকে নিঃশব্দে থাকতে দিতে হয়। মনকে বোঝা প্রয়োজন, শরীরকে বিশ্রাম দেওয়া প্রয়োজন। কারণ ঘুম মানে শুধু চোখ বন্ধ করা নয়, ঘুম মানে নিজেকে আবার ঠিক করে নেওয়া।

আরশী আক্তার সানী

গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ