পড়াশোনা ছেড়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় ক্যারিয়ার গড়া ঝুঁকিপূর্ণ

ইব্রাহীম খলিল (সবুজ)

প্রকাশ : ২৪ নভেম্বর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

আমরা ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি- শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মনে হচ্ছে এই কথার গুরুত্ব যেন কমে যাচ্ছে। আজকের অনেক তরুণ আর আগের মতো পড়াশোনাকে জীবনের মূল ভিত্তি মনে করছেন না। তারা ভাবছেন, চার-পাঁচ বছর পড়াশোনা করে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ঝুঁকে থাকার বদলে, এখনই সোশ্যাল মিডিয়ায় কাজ শুরু করলে দ্রুত আয় হবে, দ্রুত পরিচিতি পাওয়া যাবে। যেন জীবনটা খুব সহজ- একটি ভিডিও ভাইরাল হবে, আর তার পরেই সাফল্যের দরজা খুলে যাবে।

এই চিন্তা কেন জন্ম নিচ্ছে, তার কারণও পরিষ্কার। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা থেকে শুরু করে চাকরির প্রিলি, লিখিত, ভাইভা- প্রতিটি ধাপই অসীম প্রতিযোগিতায় ভরা। প্রতিযোগিতা এত বেশি যে, কেউ কেউ বছরের পর বছর ধরে প্রস্তুতি নিয়েও সুযোগ পান না। একদিকে তীব্র প্রতিযোগিতা, অন্যদিকে আয়হীন দীর্ঘ প্রস্তুতির চাপ। পরিবার, সমাজ এবং নিজের প্রত্যাশা- সব মিলিয়ে অনেক তরুণ মনে করেন, ‘প্রচলিত পথে চললে ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত।’ তাই তারা সেই পথ থেকে সরে এসে হাঁটছেন সোশ্যাল মিডিয়ার শর্টকাট পথে।

কিন্তু যে বাস্তবতা বাইরে থেকে খুব আকর্ষণীয় দেখায়, তার ভেতরে লুকিয়ে থাকে অনেক অদৃশ্য ঝুঁকি। সোশ্যাল মিডিয়া এমন এক জায়গা যেখানে যত দ্রুত ভাইরাল হওয়া যায়, তত দ্রুতই হারিয়ে যাওয়া। আজ যিনি আলোচনায় আছেন, কাল তিনি আলোচনায় নাও থাকতে পারেন। এখানে অ্যালগরিদম বদলায়, মানুষের পছন্দ বদলায়, ট্রেন্ড বদলায়। যেই ভিডিও গত সপ্তাহে লাখ ভিউ পেয়েছিল, আজ সেটি ধীরে ধীরে হারিয়ে যায় নতুন কনটেন্টের ভিড়ে। ফলে যে আয় ছিল, তাও কমে আসে। অনেকেই ভাবে, ‘একবার ভাইরাল হলেই চলবে।’ কিন্তু সত্য হলো- ভাইরাল হওয়া কোনো মজবুত ভিত্তি নয়; এটি শুধুই একটি সাময়িক ঘটনা। কেউ দুই মাস ভালো করে, তিন মাস পর তাকে আর খুঁজে পাওয়া যায় না।

কেউ এক মাস আয় করে, চার মাস আর আয় নেই। রোলারকোস্টারের মতো এই ওঠানামা তার ওপর মানসিক চাপ তৈরি করে। সবচেয়ে বড় সমস্যা হয় তখন, যখন পুরোপুরি পড়াশোনা ছেড়ে সোশ্যাল মিডিয়ার ওপর নির্ভর করা তরুণটি অনুভব করে যে তার হাতে নেই কোনো ডিগ্রি, নেই কোনো স্থায়ী দক্ষতা, নেই কোনো বিকল্প পথ। তখন সে বুঝতে পারে যে একটি অস্থির ভিত্তির ওপর ভবিষ্যৎ গড়তে চাওয়া ছিল একটি ভুল সিদ্ধান্ত। আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো- সোশ্যাল মিডিয়ার ক্যারিয়ার আসলে যতটা সহজ মনে হয়, বাস্তবে তা নয়। একটি ভিডিও বানানোর পেছনে থাকে স্ক্রিপ্ট লেখা, ক্যামেরার আলো-ছায়া বোঝা, এডিটিং জানা, অডিয়েন্সের মনস্তত্ত্ব বোঝা, নেতিবাচক মন্তব্য হজম করা, নিজের ব্র্যান্ড তৈরি করা এবং মার্কেটিং।

এগুলো কোনোটি খেলাচ্ছলে শেখা যায় না। এগুলো শেখার জন্য লাগে শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, সময় এবং ধারাবাহিক পরিশ্রম। যারা শুধু ‘সহজে আয়’ করার চিন্তা নিয়ে আসেন, তারা দ্রুতই হাল ছেড়ে দেন, কারণ পরিশ্রম ছাড়া এই প্ল্যাটফর্মে টিকে থাকা যায় না। একটি কথা ভুলে গেলে চলবে না- সোশ্যাল মিডিয়াও খুব প্রতিযোগিতাপূর্ণ। প্রতিদিন হাজার হাজার নতুন কনটেন্ট ক্রিয়েটর এই দুনিয়ায় ঢুকছে। সবাই চায় জনপ্রিয় হতে, সবাই চায় আয় করতে। ফলে টিকে থাকার প্রতিযোগিতা আরও কঠিন হয়ে উঠছে। যে ক্রিয়েটর প্রতিদিন নতুনত্ব আনতে পারে না, সে খুব দ্রুতই পিছিয়ে পড়বে। এই পরিস্থিতিতে যারা পড়াশোনা ছেড়ে পুরোপুরি সোশ্যাল মিডিয়া ক্যারিয়ারে ঝাঁপ দেয়, তারা আসলে ভবিষ্যতের একটি বড় নিরাপত্তা হারান।

কারণ পড়াশোনা শুধু চাকরির জন্য নয়- এটি মানুষকে স্থিরভাবে চিন্তা করতে শেখায়, আত্মবিশ্বাস দেয়, বিভিন্ন দক্ষতা তৈরি করে এবং কঠিন সময়েও টিকে থাকতে সাহায্য করে। একজন মানুষ যখন শিক্ষিত হয়, তখন তার সামনে অনেক দরজা খোলা থাকে। সে শুধু সোশ্যাল মিডিয়ার ওপর নির্ভরশীল থাকে না; সে চাইলে চাকরি করতে পারে, ব্যবসা করতে পারে, অন্য ক্যারিয়ার বেছে নিতে পারে। এর ফলে তার ভবিষ্যৎ এক জায়গায় আটকে থাকে না। অন্যদিকে যারা পড়াশোনা না করে শুধুই সোশ্যাল মিডিয়ার ওপর নির্ভর করেন, তাদের সামনে থাকে মাত্র একটাই দরজা। আর সেই দরজাও বন্ধ হয়ে যেতে পারে যেকোনো দিন, যেকোনো মুহূর্তে।

সোশ্যাল মিডিয়া ক্যারিয়ার খারাপ নয়। বরং এটি একটি সম্ভাবনাময় দুনিয়া। কিন্তু এটি একমাত্র ক্যারিয়ার পথ নয়। এবং এটি কখনোই শিক্ষার বিকল্প নয়। বরং শিক্ষা হলো সেই শক্ত ভিত, যার ওপর দাঁড়িয়ে একজন ক্রিয়েটর নিরাপদে নিজের স্বপ্ন পূরণ করতে পারেন। সোশ্যাল মিডিয়া ক্যারিয়ারকে বেছে নিতে চাইলে পড়াশোনা বাদ দেওয়ার কোনো দরকার নেই। বরং পড়াশোনাই একজন ক্রিয়েটরকে অন্যদের থেকে আলাদা করে। পড়াশোনা মানুষকে যুক্তি শেখায়, তথ্য যাচাই করতে শেখায়, ভাষা সুন্দরভাবে ব্যবহার করতে সাহায্য করে, যার ফলে তার কনটেন্টও শক্তিশালী হয়। যারা পড়াশোনার পাশাপাশি কনটেন্ট তৈরি করেন, তারা দীর্ঘমেয়াদে সফল হন বেশি- কারণ তাদের আছে জ্ঞান, দক্ষতা, আর টিকে থাকার শক্তি। যে তরুণ পড়াশোনা করে সোশ্যাল মিডিয়ায় কাজ করেন, তার কনটেন্ট হয় বেশি শক্তিশালী, বেশি গভীর, বেশি বিশ্বাসযোগ্য। তিনি বুঝতে পারেন কীভাবে তথ্য যাচাই করতে হয়, কীভাবে মানুষের প্রয়োজন বুঝে কনটেন্ট বানাতে হয়, কীভাবে নিজের চিন্তাকে পরিষ্কারভাবে প্রকাশ করতে হয়। অন্যদিকে যারা পড়াশোনা ছাড়াই আসেন, তারা শুরুতে হয়তো এগিয়ে থাকেন, কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পিছিয়ে পড়েন। কারণ তাদের শেখার ভিত্তি দুর্বল থাকে। তারা ফলোয়ার বাড়ানোর খেলা বোঝেন; কিন্তু টিকে থাকার বিজ্ঞান বোঝেন না। ফলে তারা একসময় ক্লান্ত হয়ে পড়েন। অনেকেই তখন মনে করেন- ‘পড়াশোনা না করাটা ছিল সবচেয়ে বড় ভুল।’

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সোশ্যাল মিডিয়া আরও বড় হবে, আরও সম্ভাবনা তৈরি করবে। কিন্তু এই সম্ভাবনা ধরতে হলে তরুণদের প্রয়োজন প্রস্তুতি। আর সেই প্রস্তুতি আসে পড়াশোনা থেকেই। আজকের এই প্ল্যাটফর্মে টিকে থাকতে জ্ঞানই সবচেয়ে বড় শক্তি। তাই শিক্ষা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া কখনোই বুদ্ধিমানের কাজ নয়। স্বপ্ন থাকা ভালো, স্বপ্ন বাস্তবায়নও সম্ভব; কিন্তু সেই স্বপ্নকে টেকসই করতে হলে দরকার শক্ত ভিত্তি, আর সেই ভিত্তির নামই শিক্ষা। তরুণরা যদি সত্যিই নিজের ভবিষ্যৎকে উজ্জ্বল করতে চান, তবে দ্রুত সাফল্যের প্রলোভনে নয়- দীর্ঘমেয়াদি নিরাপত্তা ও স্থায়িত্বের কথা ভাবতে হবে। সোশ্যাল মিডিয়ায় ক্যারিয়ার গড়তে চাইলে করুন; কিন্তু শিক্ষাকে বাদ দিয়ে নয়। কারণ দিনের শেষে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হওয়া একদিনের ব্যাপার; কিন্তু জীবনের পথ দীর্ঘ- এ পথ পাড়ি দিতে হলে দরকার স্থিরতা, দক্ষতা এবং শিক্ষার শক্তভিত্তি।

ইব্রাহীম খলিল (সবুজ)

শিক্ষার্থী, আইন ও ভূমি প্রশাসন অনুষদ, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়