ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে রাজধানী, প্রতিরক্ষার উপায়
আসাদুজ্জামান খান মুকুল, শিক্ষক, কবি, লেখক ও প্রাবন্ধিক
প্রকাশ : ২৫ নভেম্বর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

ঢাকা শহর কি সত্যিই আজ মানুষের জন্য এক অবধারিত মরণফাঁদে পরিণত হয়েছে? নিত্যদিনের অসংখ্য সমস্যায় জর্জরিত রাজধানী। তার ওপর যোগ হয়েছে ভূমিকম্পের বাড়তি আতঙ্ক। ‘ভূমিকম্প’ নামটা মাত্র চার অক্ষরের। কিন্তু এই শব্দটি শুনলেই বুকের ভেতর অকারণে কেঁপে ওঠে। ঠিক যেন হঠাৎ মাটি নড়ে উঠলে শরীর যেভাবে আঁতকে ওঠে, তেমনই।
কিন্তু দুর্ভাগ্য এই যে, বিষয়টি আর কোনো দূর-আকাশের আশঙ্কা নয়; এটি আজ আমাদের ঘুম ভাঙার, কিংবা রাতের দিকে চোখ বন্ধ করার সময়ের অদৃশ্য সঙ্গী। প্রকৃতি যে কখন কোন রূপ নেবে, তার ওপর আমাদের হাত নেই। এটা আমরা জানি। কিন্তু যখন আশঙ্কাটির ছায়া ঘনিয়ে আসে নিজের শহর, নিজের নির্মাণ, নিজের ভবিষ্যৎকে ঘিরে তখন বিষয়টা নিছক অনুভূতি নয়, রক্তের ভেতরেই এক অস্বস্তিকর স্পন্দন তৈরি করে।
বাংলাদেশের ভূ-গাঠনিক অবস্থান নিয়ে কথা বলতে গেলে আমি মনে করি, ‘যদি’ বা ‘হয়তো’ দিয়ে ঝুঁকি ঢেকে রাখার কোনো সুযোগ নেই। হিমালয় অঞ্চলের উত্তেজিত টেকটোনিক চাপ আর পূর্ব দিকের ইন্দো-বার্মা প্লেটের নিরবচ্ছিন্ন ধাক্কা, এই দুই শক্তির ঠিক মাঝখানে বসে আছে আমাদের দেশ। নরম পলিমাটিতে দাঁড়িয়ে থাকা এক উঁচু জনপদ। বছরের পর বছর ধরে জমতে থাকা এই চাপের কথা ভূতত্ত্ববিদরা বহুবার সতর্ক করে বলেছেন। রিখটার স্কেলে ৭ কিংবা তার বেশি মাত্রার একটি বড় ভূমিকম্প যেকোনো সময় ঘটতে পারে। এটা আর কোনো ‘তত্ত্ব’ নয়; এটি নগরবাসীর জীবনের জন্য সরাসরি একটি দৈত্যাকার হুমকি।
কিন্তু প্রকৃতির নিয়মের চেয়েও আমাকে বেশি ভাবায় আমাদের নিজেদের দুর্বলতা। প্রশ্নটা বড় সহজ। ঢাকা আসলে এত ঝুঁকিতে কেন? কারণ শহরটি দাঁড়িয়ে আছে ভরাট করা আলগা, নরম মাটির ওপর যা ভূকম্পনের শক্তিকে বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। শহরের চারিদিকে তাকালে মনে হয়, যেন অসংখ্য ভবন তড়িঘড়ি করে, নিয়মণ্ডনীতিকে উপেক্ষা করে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। কোথাও কোনো নিরাপত্তার নিশ্চয়তা নেই। মনে হয়, বিশাল এক উল্টো পিরামিড তৈরি করে আমরা তার তলাটা কাদামাটির ওপর দাঁড় করিয়ে রেখেছি।
তারপরও প্রশ্নটা সবার মাথায় ঘুরপাক খায় ৭ মাত্রার একটি ভূমিকম্প হলে কী হবে? আমি যখন চোখ বন্ধ করে কল্পনা করি, তখন দেখি দুর্বল রড, নিম্নমানের সিমেন্ট আর অপরিকল্পিত নকশায় তৈরি অসংখ্য দালান বালির বাঁধের মতো গুঁড়িয়ে পড়ছে। একটি ভবন ধসে পড়লেই যে শুধু তার ভেতরে থাকা মানুষেরা ঝুঁকিতে পড়বে তা নয়, শহরের সরু অলিগলিতে ও ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় দাঁড়িয়ে থাকা পাশের ভবনগুলোও টেনে নামাবে। ঢাকার অনেক অংশ যে আজ সত্যিই বিপর্যয়ের সীমান্তে দাঁড়িয়ে এটা আর অস্বীকার করার কিছু নেই।
সমস্যার গোড়াটা কোথায়? আমার দৃঢ ধারণা, এর মূলে রয়েছে বহু বছরের সমষ্টিগত অবহেলা। কতজন বাড়িওয়ালা নতুন ভবন নির্মাণের আগে সঠিক ‘মাটি পরীক্ষা’ করেছেন? চারতলার অনুমোদন নিয়ে ছয়তলা বানানো, নকশা বদলে ফেলা, নিম্নমানের বালু-সিমেন্ট ব্যবহার করা, এসব যেন এখন প্রকাশ্য রহস্য। নিয়ম ভাঙার সংস্কৃতি এমনভাবে রক্তে ঢুকে গেছে যে, ভুলগুলোর দাম দিতে হতে পারে হাজারো প্রাণ দিয়ে।
কিন্তু আমার সবচেয়ে বড় ভয় কেবল ভবন ধসে পড়ার দৃশ্য নিয়ে নয়। আরও ভয়াবহ হলো-তারপর কী হবে? বিশেষজ্ঞদের বহুবার বলা সেই সতর্কতা একটি বড় ভূমিকম্পে ঢাকার এক-তৃতীয়াংশ ভবন ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। এটা ভাবলেই শিউরে উঠতে হয়।
গুলশান, বারিধারা, বসুন্ধরার ঝকঝকে চেহারা যে মুহূর্তেই ম্লান হয়ে যাবে। পুরান ঢাকার কথাই বা বাদ দিই কীভাবে? সরু গলি, বিপজ্জনক ভবন, গ্যাসলাইন, পুরোনো বৈদ্যুতিক ব্যবস্থায় কোনো উদ্ধারকারী দল কি সেখানে দ্রুত পৌঁছাতে পারবে? ভূমিকম্পের পর পানি-বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্নতা আর গ্যাসলাইন বিস্ফোরণের আশঙ্কা যোগ হলে পরিস্থিতি যেন এক বাস্তব নরককুণ্ডে পরিণত হতে পারে।
এই অবস্থায় প্রশ্নটা খুবই সহজ। আমরা কি সত্যিই অসহায়? নাকি প্রস্তুতির মাধ্যমে ক্ষতি অনেকটাই কমাতে পারি? আমার বিশ্বাস, আমরা চাইলে অবশ্যই পারি। সবকিছু সরকারের ওপর ছেড়ে দিয়ে বসে থাকা এক ধরনের আত্মসমর্পণ। নিজের জীবন রক্ষার দায়িত্ব প্রথমত নিজেরই। প্রথম কাজ হওয়া উচিত নিজের বাড়িকে নিরাপদ করা। ভবনের প্রকৃত শক্তি সম্পর্কে অনেকেই নিশ্চিত নন। তাই একটি নিরপেক্ষ প্রকৌশলীর মাধ্যমে কাঠামো পরীক্ষা করা জরুরি। প্রয়োজন হলে ‘রেট্রোফিটিং’ করে ভবনকে শক্তিশালী করতেই হবে। এটা খরচ নয়, জীবনরক্ষা। নতুন নির্মাণ হলে অবশ্যই বাংলাদেশ জাতীয় ইমারত বিধি পূর্ণভাবে অনুসরণ করতে হবে। কোনো ব্যতিক্রম নয়।
পরবর্তী কাজ অনুশীলন। ভূমিকম্পের সময় কী করতে হবে, এই মৌলিক জ্ঞান অনেকেই জানেন না। ‘নুইয়ে পড়া, শক্ত কোনো জিনিসের নিচে আশ্রয় নেওয়া এবং সেটিকে শক্তভাবে ধরে থাকা।’ এগুলো নিয়মিত অনুশীলন করা উচিত। স্কুল-কলেজ-অফিসে জরুরি মহড়া চালু থাকা অপরিহার্য। তারপর জরুরি কিট। প্রতিটি বাড়িতে থাকা উচিত এক ব্যাগ যাতে থাকবে পানি, খাবার, টর্চ, গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র, হুইসেল, কিছু ওষুধ, যা অন্তত ২৪ ঘণ্টা টিকে থাকার সামান্য হলেও নিশ্চয়তা দেবে। সরকারের ভূমিকাও এখানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ঝুঁকিপূর্ণ ভবন চিহ্নিত করে সংস্কার বা উচ্ছেদের টাইমলাইন নির্ধারণ করা, উদ্ধারকারী দলকে আধুনিক সরঞ্জাম দেওয়া, খোলা জায়গা চিহ্নিত করে প্রস্তুত রাখা।এসব এখন আর বিলম্ব করার বিষয় নয়। স্কুল-কলেজ পর্যায়ে দুর্যোগ শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা সময়ের দাবি।
সবশেষে, কমিউনিটির শক্তি। বড় বিপর্যয়ে পেশাদার উদ্ধারকারী দল সব সময় দ্রুত পৌঁছাতে পারে না। তখন কাজ করবে প্রতিবেশীর দল। প্রতিটি ওয়ার্ডে প্রাথমিক উদ্ধার প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত স্বেচ্ছাসেবী দল গড়ে তোলা উচিত। কারণ বিপদের প্রথম মুহূর্তগুলোতে তারাই বহু জীবন বাঁচাতে পারে। ভূমিকম্প আমরা থামাতে পারব না, কিন্তু প্রস্তুতি নিতে পারি। সচেতন হতে পারি। পরিবারকে প্রস্তুত করতে পারি। আমরা যদি ভবনকে শক্তিশালী করি, নিয়ম মানি, কমিউনিটিকে প্রশিক্ষিত করি, তাহলে ঢাকাকে অন্তত মৃত্যুফাঁদ থেকে অনেকটাই নিরাপদ করা সম্ভব।
