গণমাধ্যমের ম্যাজিক বুলেট ও দ্বিধাপ প্রবাহ তত্ত্ব

আব্দুল কাদের জীবন, শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়

প্রকাশ : ২৫ নভেম্বর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

গণমাধ্যম, এই শব্দটি শুধু সংবাদ পরিবেশনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; এটি আধুনিক সমাজ ও রাষ্ট্রের শিরা-উপশিরা হিসেবে কাজ করে। এটি আমাদের চিন্তা, বিশ্বাস এবং প্রতিক্রিয়ার ওপর এক নিরন্তর প্রভাব বিস্তার করে চলেছে শতাব্দীর পর শতাব্দী। একটা সময় ছিল যখন মনে করা হতো, গণমাধ্যমের বার্তা দর্শকের হৃদয়ে সরাসরি এবং অভ্রান্তভাবে আঘাত হানে ‘ম্যাজিক বুলেট’ এর মতো। এই বুলেট তত্ত্বটি গণমাধ্যমের প্রভাবকে এতই শক্তিশালী মনে করত যে, তারা যা দেখছে বা শুনছে, সাধারণ মানুষ কোনো প্রকার যাচাই-বাছাই ছাড়াই তা বিশ্বাস করে প্রভাবিত হবে এবং সেই অনুযায়ী প্রতিক্রিয়া দেখাবে। গঠিত হবে জনমত।

আমাদের সাংস্কৃতিক ইতিহাসে এর বহু দৃষ্টান্ত আছে। আমাদের বাবা-মা বা পূর্বপুরুষরা যখন নাটক বা চলচ্চিত্র দেখতেন, তখন তাদের চোখে জল আসা ছিল খুব সাধারণ একটি দৃশ্য। তথ্যগুলো যেন তাদের হৃদয়ে সরাসরি আঘাত হানত। এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ সম্ভবত হুমায়ূন আহমেদের কালজয়ী নাটক ‘কোথাও কেউ নেই’-এর ‘বাকের ভাই’ চরিত্রটির ফাঁসির দৃশ্য। ওই একটি কাল্পনিক চরিত্রের পরিণতিতে সাধারণ মানুষ এতটাই বিক্ষুব্ধ ও প্রভাবিত হয়েছিল যে, তারা রাস্তায় নেমে এসে বাস্তব প্রতিবাদের ঢেউ তুলেছিল। এই ঘটনা প্রমাণ করে, একসময় গণমাধ্যমের বার্তা সত্যিই একটি ‘ম্যাজিক বুলেটের’ মতোই কাজ করত, যা সহজেই জনমত তৈরি করতে পারত।

খুব সাম্প্রতিক সময়ের দিকে তাকালেও আমরা এমন ঘটনার তীব্রতা উপলব্ধি করতে পারি। সর্বশেষ জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় প্রথম শহিদ আবু সাইদের মর্মান্তিক ভিডিও যখন গণমাধ্যমে এবং বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ল, তখন তার প্রভাব ছিল তাৎক্ষণিক ও বিস্ফোরক। মুহূর্তের মধ্যে সারা দেশের ছাত্র-জনতা আরও বেশি ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে।

এই আঘাত ছিল যেন একটি বুলেটের আঘাত, যা আন্দোলনকে কোটা সংস্কারের গণ্ডি পেরিয়ে সরকার পতনের দিকে মোড় নিতে সহায়তা করেছিল। এই বিশেষ পরিস্থিতিতে ‘ম্যাজিক বুলেট’ তত্ত্বের কার্যকারিতা অত্যন্ত প্রকটভাবে দৃশ্যমান হয়েছিল, যেখানে গণমাধ্যম একটি জনতাকে মুহূর্তের মধ্যে ঐক্যবদ্ধ ও উত্তেজিত করে তুলেছিল।

তবে আধুনিক সময়ে এসে, বিশেষত প্রযুক্তির প্রসারে, গণমাধ্যমের প্রভাবের গতিপথ কিছুটা জটিল হয়েছে। ‘ম্যাজিক বুলেট’ তত্ত্বের সরলতা এখনকার বহুমুখী তথ্য প্রবাহের ক্ষেত্রে প্রায়োগিক দিক থেকে অনেক ক্ষেত্রে ফিকে হয়ে আসছে। এর বিপরীতে, গণযোগাযোগের ক্ষেত্রে এখন যে তত্ত্বটি বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে, তা হলো- ‘দ্বি-ধাপ প্রবাহ তত্ত্ব’।

এই তত্ত্ব অনুসারে, গণমাধ্যমের বার্তা জনসাধারণের কাছে সরাসরি পৌঁছায় না, বিশেষ করে প্রান্তিক সমাজের ক্ষেত্রে, যেখানে সাক্ষরতা বা তথ্য বিশ্লেষণের পর্যাপ্ত জ্ঞান নেই। বরং বার্তাটি প্রথমে পৌঁছায় ‘মতামত নেতা’ বা সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের কাছে। এই মতামত নেতারা- যেমন শিক্ষক, স্থানীয় রাজনীতিবিদ, জনপ্রতিনিধি বা মসজিদের ইমাম- প্রথমে গণমাধ্যমের সংবাদটি গ্রহণ করেন, তারপর তারা নিজেদের ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে এটিকে সমাজের সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেন।

ধরুন, গ্রামের চায়ের দোকানে বসে যখন প্রান্তিক মানুষ খবর দেখেন, তখন গণমাধ্যমের জটিল তথ্যগুলো হয়তো তারা পুরোপুরি বুঝতে পারেন না। এক্ষেত্রে পাশে থাকা কোনো শিক্ষক বা স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তি যখন সংবাদটি সহজভাবে ব্যাখ্যা করেন, তখনই এটি তাদের কাছে বিশ্বাসযোগ্য ও বোধগম্য হয়ে ওঠে। জনমত গঠনে গণমাধ্যমের সরাসরি প্রভাবের চেয়ে এই আন্তঃব্যক্তিক মিথস্ক্রিয়া এবং সামাজিক যোগাযোগ অনেক বেশি শক্তিশালী ভূমিকা পালন করে। এই কারণে, আধুনিক জনমত গঠনে ‘দ্বি-ধাপ তত্ত্ব’ অধিক কার্যকরী বলে বিবেচিত হচ্ছে।

বর্তমানে, সোশ্যাল মিডিয়া এক শক্তিশালী গণমাধ্যম হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। এটি তথ্যের প্রবাহকে আরও দ্রুত ও নিয়ন্ত্রণহীন করে তুলেছে। দুর্ভাগ্যবশত, এই গতি প্রান্তিক জনপদকে সহজেই গুজবের শিকার করছে। বহুক্ষেত্রে মানুষ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারিত এআই-নির্মিত বা বিকৃত কন্টেন্ট দেখে দ্রুত বিশ্বাস করে ফেলছে। যেহেতু প্রান্তিক মানুষের মধ্যে সত্য-মিথ্যা যাচাইয়ের পর্যাপ্ত জ্ঞান বা সক্ষমতা নেই, তাই তারা সহজেই মিথ্যা প্রচারণার ফাঁদে পা দিচ্ছেন।

বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী মহল ভুয়া ফটোকার্ড বা বিকৃত সংবাদ ছাপিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করে চলেছে।

এই পরিস্থিতি প্রমাণ করে, যদিও সামগ্রিকভাবে ‘ম্যাজিক বুলেট’ তত্ত্বের সরাসরি প্রভাব কমেছে, কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়ার মতো প্ল্যাটফর্মে অজ্ঞতা এবং আবেগকে কাজে লাগিয়ে এখনো দ্রুত জনমতকে প্রভাবিত করা সম্ভব হচ্ছে। ফলস্বরূপ, সরকার আগামী জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে এআই ও গুজব প্রতিরোধে কাজ করে যাচ্ছে দৃঢ়তার সঙ্গে।

সংক্ষেপে বলা যায়, গণমাধ্যমের প্রভাব সময়, স্থান ও প্রযুক্তির সঙ্গে বিবর্তিত হয়েছে। আমরা ‘ম্যাজিক বুলেটের’ সরল যুগ পেরিয়ে এসেছি এবং এখন ‘দ্বি-ধাপ তত্ত্বের’ জটিল প্রবাহে বাস করছি।

তবে উভয় তত্ত্বই একটি মৌলিক সত্যকে প্রতিষ্ঠা করে: গণমাধ্যম জনমত গঠনে অপরিহার্য, কিন্তু এর প্রভাব এখন আরও বেশি মধ্যস্থতাকারী এবং সামাজিক আলোচনার ওপর নির্ভরশীল। সুস্থ গণতন্ত্রের জন্য, মতামত নেতাদের যেমন দায়িত্বশীল হতে হবে, তেমনি সাধারণ জনগণের মধ্যেও সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনা এবং তথ্য যাচাইয়ের অভ্যাস গড়ে তোলা আবশ্যক।