রাজনীতিতে নারী নেতৃত্বের ভবিষ্যৎ

তহমিনা ইয়াসমিন, শিক্ষার্থী, নৃবিজ্ঞান বিভাগ

প্রকাশ : ২৬ নভেম্বর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

বিশ্ব সভ্যতার ইতিহাস বলছে, যেখানে সমাজ এগিয়েছে, সেখানে নারী নেতৃত্বের পথও ধীরে ধীরে উন্মুক্ত হয়েছে। একসময় রাজনীতি ও রাষ্ট্র পরিচালনার মঞ্চ প্রায় সম্পূর্ণই পুরুষ নিয়ন্ত্রিত ছিল। নারীর ভূমিকা সীমাবদ্ধ ছিল ভোটার বা আন্দোলনের সহযোদ্ধায়। কিন্তু শিক্ষা বিস্তার, প্রযুক্তি, সংস্কার আন্দোলন, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা এবং বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় নীতি সবকিছু মিলে গত কয়েক দশকে নারী নেতৃত্বের জন্য একটি দৃশ্যমান ভিত্তি তৈরি করেছে। আজকে নারী আর শুধু রাজনীতির দর্শক নন; তিনি সিদ্ধান্ত গ্রহণের গুরুত্বপূর্ণ অংশ, নীতি-প্রণয়নকারী, জনপ্রতিনিধি, কূটনীতিক এবং ভবিষ্যতের রাষ্ট্রদর্শন নির্মাতা।

বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়ায় নারী নেতৃত্বের দীর্ঘ ইতিহাস আছে। সংসদ, মন্ত্রিসভা, স্থানীয় সরকার, এমনকি আন্তর্জাতিক ফোরামেও তারা সক্ষমতার উদাহরণ স্থাপন করেছেন। কিন্তু ভবিষ্যতের প্রেক্ষাপট আরও বড়, কারণ আগামী দিনের রাজনৈতিক পরিবেশ আর পুরোনো কাঠামোতে আটকে নেই; তা দ্রুত বদলে যাচ্ছে। নতুন প্রজন্মের মেয়েরা আগের তুলনায় অনেক বেশি শিক্ষিত, সামাজিকভাবে আত্মবিশ্বাসী, ডিজিটালভাবে সংযুক্ত এবং রাজনৈতিক সংকট বিশ্লেষণে সক্ষম। তারা তথ্যভিত্তিক চিন্তা করে, যুক্তি বিশ্লেষণে আগ্রহী এবং সামাজিক বৈষম্য সম্পর্কে গভীরভাবে সচেতন।

এই বোধ থেকেই জন্ম নেয় নতুন নেতৃত্বের শক্তি যা ব্যক্তিবাদ বা ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতির চেয়ে বেশি মানবিক, সমতাভিত্তিক ও বাস্তবসম্মত। ডিজিটাল যুগ নারী নেতৃত্বকে আরও সহজ করেছে। ইন্টারনেট, সোশ্যাল মিডিয়া, অনলাইন প্ল্যাটফর্ম এখন রাজনৈতিক যোগাযোগের বড় শক্তি।

যেসব মেয়েরা পরিবার, কর্মজীবন ও শিক্ষা এই তিন ভারসাম্য সামলান, তারাও আজ নিজেদের মতো, উদ্যোগ ও চিন্তাভাবনা রাজনীতির পরিসরে তুলে ধরতে পারেন। মাঠপর্যায়ের বাধা যাদের সামনে বেশি, তারা অনলাইনে সংগঠিত হতে পারেন, মত প্রকাশ করতে পারেন, সমালোচনা ও নীতি প্রস্তাব দিতে পারেন। ফলে আগামী দিনের রাজনীতি শুধু মিটিং-মিছিলের রাজনীতি থাকবে না থাকবে অনলাইন জনমত, গবেষণানির্ভর আলোচনা, সচেতনতা আন্দোলন ও ভার্চুয়াল সংগঠনের শক্তি। এই জায়গায় নারীর উপস্থিতি আগামী দিনের রাজনৈতিক কাঠামোকে আরও গণতান্ত্রিক ও সমান অংশগ্রহণনির্ভর করে তুলবে।

তবে বাস্তবতার মাটিতে চ্যালেঞ্জ এখনও রয়ে গেছে। রাজনৈতিক দলের অভ্যন্তরীণ কাঠামো এখনও পুরুষ-প্রধান, গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণে নারীর সংখ্যা কম এবং মাঠের রাজনীতিতে নারীদের নিরাপত্তা ও সামাজিক স্বীকৃতি বড় প্রতিবন্ধকতা। অনেক সময় নারী নেতৃত্বকে প্রতীকী বা আনুষ্ঠানিক জায়গায় আটকে রাখা হয় যা দীর্ঘমেয়াদে নেতৃত্ব বিকাশের পথে বড় বাধা। এর সমাধান শুধু আইন দিয়ে হবে না; প্রয়োজন রাজনৈতিক সংস্কৃতি বদলানো। দলগুলোকে নারী নেতাদের জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ, নেতৃত্ব বিকাশ কর্মসূচি, গবেষণাভিত্তিক নীতি বোঝার সুযোগ এবং বাস্তবে ক্ষমতার অবস্থান তৈরি করতে হবে। পাশাপাশি পরিবার ও সমাজকেও বুঝতে হবে নারীর রাজনীতিতে অংশগ্রহণ কোনো ‘সাহস’ বা ‘ব্যতিক্রম’ নয়, এটি জাতির অগ্রগতির অন্যতম শর্ত।

ভবিষ্যতের বিশ্ব যে ধরনের নেতৃত্ব চাইবে সহানুভূতিশীল, তথ্যনির্ভর, সমন্বয়কারী, শান্তিনির্মাতা, এবং সংকট মোকাবিলায় কৌশলী সে সব গুণে নারীরা দীর্ঘদিন ধরেই সক্ষমতার প্রমাণ দিয়েছেন। জলবায়ু পরিবর্তন, খাদ্যনিরাপত্তা, স্বাস্থ্যনীতি, নারী ও শিশুর অধিকার, শিক্ষা, প্রযুক্তির নৈতিক ব্যবহার এসব জটিল বিষয়ে নারী নেতৃত্ব নতুন আলোচনার পথ খুলে দিতে পারে।

দেশের গ্রাম থেকে শহর সব স্তরে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়লে সিদ্ধান্ত গ্রহণ আরও বাস্তবসম্মত এবং সমতাণ্ডনির্ভর হবে। স্থানীয় সরকারে নারীদের ব্যাপক অংশগ্রহণ এরইমধ্যে দেখিয়েছে যে নারীরা উন্নয়নকে শুধু প্রকল্প নয়, মানবিক দায়িত্ব হিসেবে দেখেন। ফলে সামনে জাতীয় পর্যায়ে তাদের ক্ষমতাপ্রাপ্তি দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক কাঠামোয় দৃশ্যমান পরিবর্তন আনবে।

সব মিলিয়ে, নারী নেতৃত্বের ভবিষ্যৎ শুধু সম্ভাবনার গল্প নয়; এটি সমাজের যৌক্তিক অগ্রগতির স্বাভাবিক ধাপ। নতুন প্রজন্মের মেয়েরা শুধু রাজনীতিকে পরিবর্তন করবে না তারা বদলে দেবে নেতৃত্বের অর্থ, নেতৃত্বের ভাষা, এবং নেতৃত্বের চরিত্র। রাজনীতি হবে আরও মানবিক, আরও যুক্তিনির্ভর, আরও সম্প্রীতিময়।

আর হয়তো খুব বেশি সময় লাগবে না যে দিন সমাজ বুঝে যাবে, নারী নেতৃত্ব কোনো বিশেষ সৌন্দর্য নয়, কোনো আলাদা অধ্যায়ও নয় এটি একটি দেশ ও জাতির পূর্ণতার জন্য প্রয়োজনীয়, অবিচ্ছেদ্য এবং অত্যন্ত স্বাভাবিক সত্য। সেই দিনই রাজনীতি সত্যিকারের সমতার রূপ পাবে যেখানে নেতৃত্বের মাপকাঠি হবে শুধু একটাই: যোগ্যতা, আর অন্য কিছু নয়।