শীতে হাঁপানি থেকে বাঁচতে চাই, সচেতনতা ও সঠিক যত্ন

ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ, কলাম লেখক ও জনস্বাস্থ্য বিশ্লেষক, প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি

প্রকাশ : ২৭ নভেম্বর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

শীতকাল বাংলাদেশের মানুষের কাছে আনন্দের ঋতু-কুয়াশা, মোলায়েম রোদ, নবান্ন, পিকনিক, ভ্রমণ- সব মিলিয়ে প্রাণবন্ত সময়। কিন্তু হাঁপানি বা অ্যাজমা রোগীদের জন্য এই ঋতুর মানে ভিন্ন। ঠান্ডা বাতাস, শুষ্ক আবহাওয়া, ধুলাবালির আধিক্য, ভাইরাস সংক্রমণ এবং ঘরের বদ্ধ পরিবেশ- সব মিলে এই মৌসুমে তাদের শ্বাসকষ্ট বেড়ে যায়। বিশেষ করে শিশু, বয়স্ক, অ্যালার্জিপ্রবণ ব্যক্তি এবং যাদের ফুসফুস আগে থেকেই দুর্বল- তারা বেশি ভুগে থাকেন। হাঁপানি একটি দীর্ঘস্থায়ী শ্বাসতন্ত্রের রোগ, যেখানে শ্বাসনালী অতিসংবেদনশীল হয়ে পড়ে। সামান্য উত্তেজক কারণেই সেখানে প্রদাহ ও সংকোচন তৈরি হয়। এর ফলে শ্বাস নিতে কষ্ট, কাশি, বুকে চাপ এবং শোঁ-শোঁ শব্দের মতো উপসর্গ দেখা দেয়। রাত গভীর হলে শরীর ঠান্ডা হয়ে যাওয়ায় এসময় উপসর্গ আরও তীব্র হয়।

কেন শীতকালে হাঁপানি বাড়ে?

ঠান্ডা ও শুষ্ক বাতাস : শীতকালের ঠান্ডা ও শুষ্ক বাতাস সরাসরি শ্বাসনালীকে উত্তেজিত করে। এতে শ্বাসনালীর টিস্যু সংকুচিত হয়ে পড়ে এবং শ্বাস নিতে অস্বস্তি বাড়ে। এমনকি সুস্থ মানুষেরও দ্রুত দৌড়ালে শ্বাস আটকে আসতে পারে, হাঁপানি রোগীদের ক্ষেত্রে ঝুঁকি আরও বেশি।

ধুলাবালির আধিক্য : শীতে বাতাসে ধুলার পরিমাণ বেড়ে যায়। ঘরের কার্পেট, পর্দা, বিছানা ও সোফায় জমে থাকা ধুলা ও মাইট হাঁপানির বড় ট্রিগার। অনেক ক্ষেত্রে ঘরের অদৃশ্য ছত্রাকের স্পোরও সমস্যা বাড়ায়।

ভাইরাস সংক্রমণ বৃদ্ধি : সর্দিকাশি ও ফ্লুজাতীয় সংক্রমণ শীতে বেশি হয়। এসব ভাইরাস শ্বাসনালীতে প্রদাহ বাড়িয়ে হাঁপানির উপসর্গকে তীব্র করে তোলে, বিশেষ করে শিশুদের ক্ষেত্রে।

ঘরের বদ্ধ পরিবেশ : শীতে মানুষ দীর্ঘসময় ঘরে থাকে এবং জানালা-দরজা কম খোলা হয়। ফলে ঘরের ভেতর ধুলা, রান্নার ধোঁয়া, ধূমপানের ক্ষতিকর কণা বা অ্যালার্জেন জমে থাকে- যা হাঁপানির ঝুঁকি বাড়ায়।

ব্যায়ামের অভাব ও মানসিক চাপ : শীতের অলসতায় ব্যায়াম কম হলে ফুসফুসের কার্যক্ষমতা কমে যায়। অন্যদিকে মানসিক চাপও শরীরের হরমোনের ভারসাম্য বদলে হাঁপানির সংবেদনশীলতা বাড়িয়ে তোলে।

সাধারণ লক্ষণ-

শ্বাস নিতে বা ছাড়তে কষ্ট, ঘন ঘন কাশি (রাত বা ভোরে বেশি) শোঁ-শোঁ শব্দ, বুকে চাপ, ভারীভাব বা টান, পরিশ্রমে শ্বাসকষ্ট।

প্রকারভেদ-

অ্যালার্জিক অ্যাজমা- ধুলা, পোলেন, মাইট, পশুর লোম ইত্যাদির প্রতি সংবেদনশীলতা

নন-অ্যালার্জিক অ্যাজমা- ঠান্ডা বাতাস, রাসায়নিক পদার্থ, ধোঁয়া

ব্যায়ামজনিত অ্যাজমা- দৌড়, খেলাধুলা বা ব্যায়ামের পর উপসর্গ

কফপ্রধান অ্যাজমা- ঘন কফ জমে শ্বাসনালী সংকুচিত হয়ে যায়

পেশাগত অ্যাজমা- কারখানা, রং, কাঠ, ধুলো বা রাসায়নিকের সংস্পর্শে কর্মরতরা আক্রান্ত

জটিলতা।

বারবার অ্যাটাক, দীর্ঘমেয়াদি শ্বাসকষ্ট, ঘন ঘন সংক্রমণ, দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডে ব্যাঘাত, ঘুমের সমস্যা ও ক্লান্তি।

নির্ণয়- শারীরিক পরীক্ষা। স্পাইরোমেট্রি- ফুসফুসের ক্ষমতা মাপার পরীক্ষা। পিক ফ্লো মিটার- বাসায় শ্বাস প্রবাহ পর্যবেক্ষণ। চেস্ট এক্স-রে- অন্য কোন রোগ। অ্যালার্জি পরীক্ষা- ট্রিগার শনাক্ত। FeNO পরীক্ষা-শ্বাসে প্রদাহের মাত্রা জানা।

শীতকালে বিশেষ যত্ন-

ঠান্ডা বাতাস থেকে সুরক্ষা : বাইরে গেলে স্কার্ফ বা মাস্ক ব্যবহার করা। ভোর ও রাতে বাইরে অযথা ঘোরাঘুরি এড়িয়ে চলা।

ধুলাবালি কমানো : বিছানাপত্র নিয়মিত রোদে দেওয়া। কার্পেট কম ব্যবহার করা। ঘর ভেজা কাপড়ে পরিষ্কার রাখা।

সংক্রমণ প্রতিরোধ : নিয়মিত হাত ধোয়া। ঠান্ডা লাগলে পর্যাপ্ত বিশ্রাম নেওয়া। ভিড় এড়িয়ে চলা।

ঘরের পরিবেশ নিয়ন্ত্রণ : প্রতিদিন কিছু সময় জানালা-দরজা খোলা রাখা। ঘরে ধূমপান সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। রান্নাঘরে বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা রাখা।

পানি ও খাদ্যাভ্যাস : গরম পানি নিয়মিত পান। ঠান্ডা খাবার কমানো। লেবু-আদা-মধুর গরম পানি শীতলতা কমাতে সহায়ক।

জীবনযাত্রায় পরিবর্তন-

হালকা ব্যায়াম : প্রতিদিন ২০-৩০ মিনিট হাঁটা ফুসফুসকে শক্তিশালী করে।

শ্বাস ব্যায়াম : গভীর শ্বাস-প্রশ্বাসের অনুশীলন শ্বাসনালীকে স্থিতিশীল রাখে

ভালো ঘুম : পর্যাপ্ত ঘুম রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়

মানসিক চাপ কমানো : ধ্যান, রিলাক্সেশন বা পছন্দের কাজ মনকে শান্ত রাখে

ওজন নিয়ন্ত্রণ : সঠিক ওজন ফুসফুসের ওপর চাপ কমায়

জরুরি অবস্থায় কী করবেন?

নিম্নের লক্ষণ দেখা দিলে তৎক্ষণাৎ চিকিৎসা নিতে হবে-

কথা বলতে কষ্ট, হাঁটতে বা দাঁড়াতে অসুবিধা, ঠোঁট বা আঙুল নীল হয়ে যাওয়া, নাকের পাখা ফুলে যাওয়া, শিশুর অস্বাভাবিক ঘুম বা খাওয়া কমে যাওয়া।

শিশুদের জন্য বিশেষ সতর্কতা

ঘরের ধুলাবালি কম রাখা, ঠান্ডা শুরু হলে দ্রুত সেবা নেওয়া, স্কুলব্যাগে প্রয়োজনীয় জিনিস রাখা, সকালের অতিরিক্ত ঠান্ডায় খেলাধুলা কমানো, পোষাপ্রাণী থাকলে বাড়তি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা

হোমিও সমাধান-

হোমিওপ্যাথি মতে তিনটি মূল রোগ-বীজ বা মায়াজমসোরা, সাইকোসিস, সিফিলিস- দৈহিক ও মানসিক অসুস্থতার মূল কারণ। অ্যাজমা বা হাঁপানি রোগ প্রায়শই সোরা-সাইকোসিস বা সোরা-সাইকোসিস-সিফিলিস মিশ্রণ হিসেবে দেখা দেয়। বর্তমান যুগে এই মিশ্র মায়াজমকে অনেক অভিজ্ঞ চিকিৎসক টিউবারকুলার মায়াজম নামেও অভিহিত করেন। ডা. হানেমানের নির্দেশিত হোমিওপ্যাথিক নিয়ম অনুযায়ী, রোগীর পূর্ণাঙ্গ রোগীলিপি- শারীরিক ও মানসিক উপসর্গ, জীবনধারা, ধাতুগত বৈশিষ্ট্য- নিরীক্ষা করে সঠিক ওষুধ নির্বাচন করতে হয়। হোমিওপ্যাথি একমাত্র চিকিৎসা পদ্ধতি যেখানে রোগ নয়, রোগীকে চিকিৎসা দেওয়া হয়। সঠিকভাবে প্রয়োগ করলে অ্যাজমাসহ যেকোনো জটিল রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। চিকিৎসা বিজ্ঞানে চিরন্তন সত্য নেই। একসময় বলা হতো যক্ষা হলে রক্ষা নেই, আজ তারও সফল চিকিৎসা সম্ভব। এভাবেই হোমিওপ্যাথি আধুনিক যুগে গুরুত্বপূর্ণ চিকিৎসা পদ্ধতি হিসেবে নিজের স্থান ধরে রেখেছে। হোমিওপ্যাথিতে অ্যাজমা চিকিৎসা রোগীর সামগ্রিক উপসর্গ- শ্বাসকষ্টের ধরন, কফের প্রকৃতি, শীত-গরম সংবেদনশীলতা ও মানসিক অবস্থা- মতো ওষুধ নির্বাচন করে। ফলে রোগী শুধু উপশমই পান না, বরং রোগের মূল মায়াজম দুর্বল হয়ে সুস্থতার দিকে এগোতে পারেন। তবে সম্প্রতি কিছু অনভিজ্ঞ চিকিৎসক পেটেন্ট টনিক বা মিশ্র প্যাথি ব্যবহার করে রোগীদের চিকিৎসা করছেন, যা মূল নীতি থেকে বিচ্যুত। ডা. হানেমানের ভাষায় এরা ‘শংকরজাত হোমিওপ্যাথ।’ সঠিক হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা রোগীর স্বতন্ত্র লক্ষণ ও ধাতুগত বৈশিষ্ট্যের ওপর ভিত্তি করে প্রয়োগ করলে আল্লাহর রহমতে পূর্ণ আরোগ্য সম্ভব।

পরিশেষে, হাঁপানি স্থায়ী রোগ হলেও সঠিক সচেতনতা, জীবনযাত্রায় পরিবর্তন এবং পরিবেশ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে এটি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। শীতকালে নিজের ট্রিগারগুলো চিনে রাখা, ঠান্ডা ও ধুলাবালি থেকে দূরে থাকা এবং প্রতিদিনের ছোট ছোট অভ্যাসগুলোর প্রতি যত্নবান হওয়াই হাঁপানি রোগীদের জন্য সুস্থতার মূল চাবিকাঠি। নিয়মিত শ্বাস ব্যায়াম, সক্রিয় জীবনযাপন, পর্যাপ্ত পানি পান ও চাপ কমানোর অভ্যাস ফুসফুসের ক্ষমতা বাড়িয়ে শীতকালকে অনেক বেশি সহনীয় করে তোলে।