কুটিরশিল্প : বেঁচে থাকার লড়াইয়ে পরাজিত শিল্প
আরিফুল ইসলাম রাফি
প্রকাশ : ২৮ নভেম্বর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
গ্রামবাংলার একসময়কার সকালের একটি পরিচিত দৃশ্য ছিল- কোথাও কুমারের চাকা ঘুরছে, কোথাও তাঁত বেজে উঠছে ছন্দে, কোথাও তালপাতার পাখা কাটছে একজন নারী আর দূরে কারো উঠোনে দা দিয়ে বাঁশ চেঁছে কেউ বানাচ্ছে ঝুড়ি। বাতাসে মিশে থাকত মাটির গন্ধ, খড়ের চাটাইয়ের তন্তুর ঘ্রাণ আর কোথাও কোথাও পাটের শুকনো গন্ধ। এই দৃশ্যগুলো শুধু একটি শিল্পের নয়, বরং একটি পরিপূর্ণ সমাজব্যবস্থার অংশ ছিল। কুটিরশিল্প শুধু কর্মসংস্থান নয়; এ ছিল সংস্কৃতির বাহক, গ্রামীণ আত্মপরিচয়ের অনুষঙ্গ, মানবিক সৃষ্টিশীলতার এক নিখুঁত প্রতীক।
কিন্তু আজ সেই পরিচিত দৃশ্য ধীরে ধীরে স্মৃতির অ্যালবামে চলে যাচ্ছে। কুটিরশিল্পের মানুষরা যারা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে হাতের কাজে বাঁচতেন, তারা এখন দাঁড়িয়ে আছেন গভীর সংকটের মুখে। সময়, সমাজ, অর্থনীতি, বৈশ্বিক বাজার- সবমিলিয়ে কুটিরশিল্প আজ এমন এক লড়াইয়ে নেমেছে, যেখানে বেঁচে থাকাই কঠিন হয়ে পড়েছে। আর কঠিন এই লড়াইয়ে তারা অনেক ক্ষেত্রেই পরাজিত হয়ে পড়ছেন। বাংলার কুটিরশিল্পের ইতিহাস হাজার বছরেরও পুরোনো। মাটির প্রত্ননিদর্শন, পাথরের খোদাই, প্রাচীন গ্রন্থের বিবরণ; সবই এ কথা বলে যে এই ভূমি একসময় হাতের কাজের অনন্য শিল্পে সমৃদ্ধ ছিল।
সিন্ধু সভ্যতার পোড়ামাটির পুতুলের মতোই বাংলা অঞ্চলেও পাওয়া গেছে প্রাচীন কলা নিদর্শন। পাল-সেন যুগে নকশিকাঁথা, তাঁত, পটচিত্র, ধাতুশিল্প আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছিল। মধ্যযুগে গড়ে ওঠে বাঁশ ও বেতশিল্প, পাটশিল্প, তাঁত-বয়ন। মোগল আমলে ধাতুশিল্প ও কাঠের নক্সাখোদাই শীর্ষে ওঠে। ব্রিটিশ আমলে তাঁতশিল্প ও হাতের কাজ বৈশ্বিক বাজারে সাড়া ফেলেছিল। কুটিরশিল্প শুধু উৎপাদন নয়; এটি ছিল সমাজ-পরিবার-অর্থনীতির কেন্দ্রবিন্দু। তখন অর্থনীতি ছিল খুবই স্থানীয়। প্রতিটি গ্রামে প্রয়োজনমতো উৎপাদক ছিল; কারিগর, তাঁতি, কামার-কুমোর, সুতা কাটার মহিলা, বুননকারিগর প্রভৃতি। আজ সেই কাঠামো ভেঙে পড়েছে। আর ভেঙে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে যাচ্ছে শিল্পটিও।
কেন কুটিরশিল্প টিকতে পারছে না? এর উত্তর খুঁজতে হলে সামনে আসে বেশকিছু বিষয়। যেমন- এখনকার মানুষ সস্তা ও দ্রুত উৎপাদিত পণ্য চায়। মেশিনে তৈরি প্লাস্টিকের জিনিসপত্র, স্টিলের সামগ্রী, সস্তা ফ্যাশন- সবই কুটিরশিল্পের শত্রু হয়ে দাঁড়িয়েছে। একটি মেশিন দিনে হাজার পণ্য বানাতে পারে, কিন্তু একজন কারিগর বানাতে পারে হয়তো ৫-১০টি। ফলে দাম কমে, বাজার সয়লাব হয়, আর হাতের কাজ বাজার হারায়। আগে গ্রামের পাশে পাওয়া যেত প্রয়োজনীয় উপকরণ। কিন্তু আজ বাঁশের দাম দ্বিগুণ-তিনগুণ। সূতা, রং, কাঠ, খড়- সবকিছুর দাম লাগামহীন। নদীর মাটি মিলছে না, অপ্রাকৃতিক পরিবর্তনে জিনিসের ঘাটতি। উৎপাদন খরচ বাড়ছে, কিন্তু মূল্য বাড়ানোর স্বাধীনতা নেই। কারণ বাজারে তখন গ্রাহক কিনবে না। কারিগরের ছেলে এই পেশায় আসতে চায় না। কারণ : আয় কম, সামাজিক সম্মান কম, ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত, পরিশ্রম বেশি। ফলে প্রজন্মান্তরে কারিগরের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। একটি শিল্প যখন উত্তরাধিকার হারাতে থাকে, তখন তার মৃত্যু নিশ্চিত। বাজারে কুটিরশিল্পের পণ্য বিক্রি হয়, কিন্তু সেই পণ্যের আসল মূল্য কে পায়? একটি পণ্যের দাম যদি হয় ১,০০০ টাকা, কারিগর পায় ৩০০-৪০০ টাকা।
মধ্যস্বত্বভোগী পায় বাকি ৬০০-৭০০ টাকা। এই অন্যায় ব্যবস্থায় কারিগর কেবল বেঁচে থাকার জন্য কাজ করে, উন্নতি করতে পারে না। সরকার কাগজে-কলমে অনেক প্রকল্প নেয়, কিন্তু মাঠপর্যায়ে তার ভালো ফল পাওয়া যায় না। কারিগরদের রয়েছে নানা অভিযোগ। যেমন- টাকা পেতেও লাগে দালালের হাত। প্রশিক্ষণ হয় শহরে, গ্রামের মানুষ যেতে পারে না। লোনের কাগজপত্র জটিল, মূল্য নির্ধারণের সুষ্ঠু ব্যবস্থা নেই, মার্কেটিং ব্যবস্থা দুর্বল। ফলে সহায়তা থাকলেও সেটির সুফল পৌঁছায় না শিল্পীর কাছে।
চীনসহ অন্যান্য দেশ থেকে আসে সস্তা, রঙিন, আকর্ষণীয় পণ্য। মানুষ ভাবে, ‘একই জিনিস তো কম দামে পাওয়া যাচ্ছে, তবে ঘরোয়া কেন?’ এভাবে দেশের বাজারই বিদেশি পণ্যের দখলে চলে যাচ্ছে। স্থানীয় শিল্পী টিকতে পারছে না। আজকের যুগ অনলাইনের। কিন্তু কারিগরদের স্মার্টফোন নেই, ইন্টারনেট সম্পর্কে ধারণা নেই, ছবি তুলে পোস্ট করতে পারেন না, অনলাইনে লেনদেন জানেন না। ফলে অনলাইন বাজার মধ্যস্বত্ত্বভোগীদের দখলে, কারিগরের নয়।
গ্রামের মানুষ এখন শহরমুখী। প্রবাসে যাচ্ছে বহু যুবক। কারখানায় শ্রমিক হচ্ছে হাজারো মানুষ। কেউ আর ঘরে বসে হাতের কাজ করতে চায় না। একসময় যে দাদিমা নকশিকাঁথা সেলাই করতেন, তার নাতনি হয়তো এখন গার্মেন্টসে কাজ করেন। একসময় যে কুমোর ৫০টি মাটির হাঁড়ি বানাতেন, আজ তিনি শহরে রিকশা চালান; কারণ অনিশ্চিত শিল্প করে তিনি পরিবার চালাতে পারেন না।
কুটিরশিল্প হারালে আমরা হারাচ্ছি আমাদের ঐতিহ্য, সৃজনশীলতা আর দেশীয় অর্থনীতি। এ পণ্যগুলো শুধু পণ্য নয়; এগুলো আমাদের ইতিহাস, সংস্কৃতি, শেকড়, পরিচয়। শিল্পী মানেই সৃষ্টিশীলতা, হাতের কাজ মানেই মৌলিকতা। মেশিন কখনই তা পারে না। কুটিরশিল্প দেশের GDP-তে বড় অবদান রাখার ক্ষমতা রাখে। গ্রামে হাজার হাজার পরিবার এ দিয়ে বাঁচত। এখন সেই পথ হারিয়ে যাচ্ছে। একটি কুটিরশিল্প পুরো একটি পাড়াকে কর্মসংস্থান দিতে পারে। কিন্তু এখন আর সেই সুযোগ নেই। হাতে তৈরি পণ্য পরিবেশবান্ধব। মেশিনের প্লাস্টিক পণ্য পরিবেশের ক্ষতি করে। কুটিরশিল্প হারানো মানে প্রকৃতির সঙ্গে সম্পর্ক হারানো। বিদেশিরা আজও বাংলাদেশের নকশিকাঁথা, মাটির পণ্য, পাটের ব্যাগ, বাঁশের ঝুড়ি দেখে মুগ্ধ হয়। বাংলাদেশ চাইলে এই শিল্প পুনরুজ্জীবিত করতে পারে। এজন্য কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। যেমন- কারিগরদের ন্যায্যমূল্য দেওয়া। কারিগররা যাতে তাদের পণ্যের ন্যায্য মূল্য পায় তা নিশ্চিত করতে হবে। অনলাইন বিক্রির প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে। কারিগরদের জন্য বিশেষ বাজার বা ‘ক্রাফট ভিলেজ’ গড়ে তোলার পাশাপাশি বিদেশে রপ্তানির সুবিধা বাড়াতে হবে। শিক্ষাব্যবস্থায় কুটিরশিল্প অন্তর্ভুক্ত করার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিটি জেলা শহরে নিয়মিত কুটিরশিল্প মেলা আয়োজন করতে হবে। মধ্যস্বত্বভোগীর আধিপত্য কমিয়ে সরাসরি কারিগরদের সঙ্গে ক্রেতার যোগাযোগের ব্যবস্থা করতে হবে।
আরিফুল ইসলাম রাফি
শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ
