দেশের ভাবমূর্তি রক্ষা করতে অপসাংবাদিকতা বন্ধ করা প্রয়োজন
ওসমান গনি
প্রকাশ : ২৯ নভেম্বর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

যে দেশের সবকিছুই ভেজাল সে দেশে ভেজালের মাঝে খাঁটি ও আসল খুঁজে পাওয়া বড় মুশকিল। আমরা প্রায় সময় বিভিন্ন গণমাধ্যমের দেখতে পাই- ভুয়া ডাক্তার, আইনজীবী, মেজর, সচিব এমনকি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা প্রশাসন কিংবা জনগণের জালে ধরা পড়ে। অপরদিকে অনুমোদনহীন অনেক ডায়াগনস্টিক সেন্টার, বিভিন্ন এজেন্সি, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, কারখানাসহ নানা ধরনের অবৈধ প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে প্রশাসন। বৈধ প্রতিষ্ঠান সরকারি নিয়মের বাইরে কাজ করলে তাও সিলগালা করতে দেখা যায়। ডাক্তার হতে হলে সরকারি স্বীকৃত মেডিকেল থেকে এমবিবিএস-বিডিএস ডিগ্রি অর্জন করতে হয়। বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি) অন্তর্ভুক্ত হতে হয়। আইনজীবী হতে হলে অ্যাডভোকেটশিপ পাস করে বার কাউন্সিলের সনদ অর্জন করতে হয়। অনুরূপভাবে একটি প্রতিষ্ঠান করতে হলে প্রতিষ্ঠানের ধরন অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় কিংবা অধিদপ্তর, সংস্থা কর্তৃক নিবন্ধিত হতে হবে।
সব পেশায় আলাদা নিয়মনীতি, দক্ষতা, যোগ্যতা এবং একাডেমিক শিক্ষার প্রয়োজন আছে। সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করলে কিংবা সেবা প্রধান করলে সব পেশায় রয়েছে সম্মান। তার মধ্যে সাংবাদিকতা মহান ও ক্রিয়েটিভ পেশা। সাংবাদিক সমাজের লোকেরা হলো দেশ বা সমাজের দর্পণ। এই সমাজের লোকদের প্রতি সমাজের সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের একটা আলাদা দৃষ্টিভঙ্গি দেখা যায়। তাদের সাংবাদিকতা করার জন্য মানুষ যথেষ্ট শ্রদ্ধা ও সম্মানের সহিত দেখে থাকে। সাংবাদিকদের প্রতি সবারই রয়েছে আলাদা সম্মান। একজন পেশাদার সাংবাদিক তার বস্তুনিষ্ঠ লেখনীর মাধ্যমে সত্য ও সুন্দরের সন্ধান করে। তুলে ধরে সমস্যা, সম্ভাবনা, অনিয়ম, দুর্নীতি, উন্নয়ন, অগ্রগতি। একজন প্রকৃত সাংবাদিক দেশকে বহির্বিশ্বে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করার ক্ষমতা রাখে।
সাংবাদিক সমাজ যখন তার লেখনীর মাধ্যমে দেশের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ সারা বিশ্বের সামনে তুলে ধরেন, তখন সে দেশের মান মর্যাদা অনেক উন্নত হয়। দেশের বহু বরেণ্য ব্যক্তিত্ব এই পেশায় জড়িত আছেন। সফলভাবে সাংবাদিকতা করার ফলস্বরূপ জাতীয় পুরস্কার অর্জন করেছেন অনেকেই। এমনকি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সাংবাদিকতায় জড়িত ছিলেন। দৈনিক ইত্তেহাদ ও মিল্লাত নামক পত্রিকার সঙ্গে সংযুক্ত ছিলেন। দেশের যুদ্ধকালীন সময়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানি শাসকদের নির্যাতনের কথা, বাংলার মানুষের কথা তুলে ধরতেন। মানোন্নয়ন, গবেষণা এবং উচ্চ শিক্ষার জন্য দেশের প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতার ওপর উচ্চ ডিগ্রি রয়েছে। কিন্তু সবকিছুকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে উঁচু মাপের এই পেশাকে খুবই হাস্যকর করে তুলেছে স্কুলের গন্ডি পার হতে না পারা তথাকথিত সাংবাদিকরা। যাদের দেশবাসী হলুদ সাংবাদিক হিসেবে চিনে ও জানে।
আমার মনে হয়, বর্তমানে খুবই সহজ একটি পেশা সাংবাদিকতা। যে কেউ চাইলে যখন-তখন এখানে আগমন করতে পারে। লাগে না কোনো শিক্ষাগত যোগ্যতা কিংবা পূর্বের অভিজ্ঞতা। প্রকৃত ও পেশাদার সাংবাদিকদের প্রতি সম্মান রেখেই বলছি এ কথা। আশ্চর্য হলেও সত্য যে, বর্তমানে আন্ডার মেট্রিক অনেকেই পত্রিকার সম্পাদক বনে যাচ্ছেন! ভুয়া এসব পত্রিকার পাঠক না থাকলেও সারা দেশে সংবাদদাতা নিয়োগ করে বাণিজ্যে লিপ্ত হয় তারা। মাঝেমধ্যে আবার অনেক সময় প্রতিদিন ৮-১০ কপি পত্রিকা প্রিন্ট করে নিজেদের কার্য ও স্বার্থ হাসিলের লক্ষে প্রেস লেখাযুক্ত গাড়ি, আইডি কার্ড, এমনকি ভিজিটিং কার্ড ব্যবহার করে সাধারণ মানুষকে ভয়ভীতি দেখিয়ে বিভিন্ন অপকর্মে লিপ্ত। সাংবাদিকতার পরিচয়ে অবৈধ পণ্যের ব্যবসা, নারী কেলেঙ্কারি, অনৈতিক সুবিধা নিতে গিয়ে অনেক অখ্যাত সংবাদপত্রের মিডিয়াকর্মী ধরা পড়ে। যা আমরা প্রায় সময় বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত খবর থেকে জানতে পারি।
ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা অনলাইন নিউজ পোর্টাল এবং অনলাইন টিভিগুলোর অবস্থা আরও ভয়াবহ। বর্তমানে সবার হাতেই স্মার্ট ফোন। হাতের মুঠোয় বিশ্ব। খুব সহজে, কম খরচে, ঘরে বসে অনলাইনমাধ্যমে সংবাদ পাওয়া যায়। কিন্তু দুঃখজনক হলো, মানসম্মত নিউজ পোর্টালের ভেতর হাজারো নিম্নমানের পোর্টাল জায়গা করে নিয়েছে। এসব তথাকথিত নিউজ মাধ্যমগুলো মনগড়া, বানোয়াট, ভিত্তিহীন, অশ্লীল ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সংবাদ পরিবেশনে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। সস্তা জনপ্রিয়তার উদ্দেশ্যে জীবিত মানুষকে মৃত বানানো, অশ্লীল ও রসালো হেডলাইন দিয়ে সংবাদ, মূলধারার গণমাধ্যমের সংবাদ কপি করা, অনৈতিক সুবিধা না পেলে সম্মানিত ব্যক্তিগণের নামে মিথ্যা-বানোয়াট সংবাদ প্রচার করে হেয়প্রতিপন্ন করা, বিভিন্ন গুজব তথ্য দিয়ে সমাজে, মানুষে, ধর্মে, গোত্র-বর্ণে দাঙ্গা-হাঙ্গামা সৃষ্টি করতে ভূমিকা পালন করছে এসব তথাকথিত মিডিয়া ও এর নামধারী সাংবাদিকরা।
জরিপ চালালে দেখা যাবে, তাদের কেউ গার্মেন্ট শ্রমিক, দোকান কর্মচারী কিংবা দৈনিক মজুরিতে কাজ করা কর্মচারী থেকে হাজার পাঁচেক টাকা খরচ করে একটি পোর্টাল তৈরি করে কিংবা অনেকে ফেসবুকে পেজ, ইউটিউব চ্যানেল তৈরি করে অনলাইন টিভি নাম দিয়ে সাংবাদিকতায় পদার্পণ করেছে। বর্তমানে আমাদের দেশে এমন ধরনের সাংবাদিকতার সংখ্যায় বেশি। এটি এই মেধাবী পেশাটির জন্য খুবই নেতিবাচক এবং দেশ ও জাতির জন্য ও ক্ষতিকর। রাজধানীর ঢাকা শহর দেশের প্রত্যেকটি জেলা উপজেলা বিভাগীয় শহর এমনকি গ্রাম পর্যায়ে পর্যন্ত হতে এখন দেখা যায় যে, অনলাইন নিউজ পোর্টাল পরিচালনা করছে। এ সমস্ত আন্ডারগ্রাউন্ডের সংবাদপত্র বা অনলাইন নিউজ পোর্টাল গুলোর মূলত কাজ হচ্ছে আইডি কার্ড বিক্রি করা।
এ সমস্ত সংবাদপত্র বা অনলাইন নিউজ পোর্টালগুলো দেশের প্রত্যেকটি জেলা উপজেলা এবং কি ইউনিয়নে পর্যন্ত তারা প্রতিনিধি নিয়োগ দিয়ে থাকে। প্রত্যেক প্রতিনিধিকে তারা টাকার বিনিময়ে একটি করে আইডি কার্ড ধরিয়ে দেয় যার আবার রয়েছে সীমাবদ্ধতা। এসব আইডি কার্ডের মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে গেলে আবার টাকা দিয়ে নতুন আইডি কার্ড নিতে হয়। এটা হলো আন্ডারগ্রাউন্ড সংবাদপত্র বা অনলাইন নিউজ পোর্টাল গুলোর মালিকপক্ষের এক ধরনের একটা ব্যবসা। যে সমস্ত লোক পত্রিকার আইডি কার্ড পেয়ে গেল সে একজন সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে গলায় আইডি কার্ড ঝুলিয়ে অথবা একটা মোটরসাইকেল নিয়ে এলাকায় বীরদর্পে ঘুরে বেড়ায়। নিজেকে সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে বাহবা যোগায়। সমাজের সাধারণ বা অসহায় মানুষের নিকট গিয়ে তাদের নিকট বিভিন্নভাবে টাকা দাবি করে থাকে। টাকা দিতে অপারগতা প্রকাশ করলে তাদের বিরুদ্ধে মানহানীর নিউজ করে দিবে বল হুমকি-ধমকি দিয়ে থাকে।
এই টাকা শুধু সাংবাদিক নিজেই ভোগ করে না এই টাকার অংশ যে প্রতিষ্ঠান তাকে আইডি কার্ড দিয়েছে সে প্রতিষ্ঠানের প্রধানকেও দিতে হয়। তথাকথিত তাদের এই অপসংবাদিকতার কারণে সমাজ বা রাষ্ট্রের মূল ধারার সাংবাদিকদের মানহানির একটা কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যে সমস্ত ভুঁইফোড় সাংবাদিকদের নেই কোনো উল্লেখযোগ্য শিক্ষাগত যোগ্যতা নেই কোনো লেখার ক্যাপাসিটি তারা নাম ঠিকানা সংগ্রহ করে পাঠিয়ে দিলে পত্রিকা কর্তৃপক্ষ সেই নিউজ লিখে পত্রিকার ছাপিয়ে দেয় অথবা অনলাইন নিউজ পোর্টালে আপলোড করে দেয়। তখন সেই সাংবাদিক ছাপাকৃত নিউজ নিয়ে অথবা অনলাইনে আপলোডকৃত নিউজ এর লিংক নিয়ে নিজের ফেসবুক আইডিতে শেয়ার করে দেখায় আর নিজেকে সাংবাদিক হিসেবে জাহির করে। কিন্তু একজন সাংবাদিকের যে গুনে গুণান্বিত হতে হবে তার বিন্দুমাত্র মাত্র তার কাছে নেই।
একজন সাংবাদিককে সৃজনশীল, শিক্ষিত, দেশ-বিদেশ, রাজনৈতিক, বাণিজ্যসহ বহুমুখী জ্ঞানের অধিকারী হতে হবে। অনেক সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারী সত্য-মিথ্যার যাচাই না করে অখ্যাত মিডিয়ার ভুয়া সংবাদগুলো পড়া, লাইক, কমেন্ট, শেয়ার দিয়ে তাকে; পরে এর মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে সংঘাত। তাই পাঠক সমাজেরও সতর্ক থাকতে হবে যা দেখলাম কিংবা পড়লাম তা সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বাস না করে কয়েকটি মূলধারা গণমাধ্যমে সংবাদটি প্রচার করেছে কিনা তা দেখতে হবে। বলতে গেলে বর্তমানে মূলধারার গণমাধ্যমের পেশাদার সাংবাদিকদের চেয়ে তথাকথিত মিডিয়ার ভুয়া গণমাধ্যমকর্মীদের দৌড় বেশি।
বর্তমানে এমন অবস্থায় পেশাদার সংবাদকর্মীরা রীতিমতো বিব্রত। ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট গণমাধ্যম সংক্রান্ত কার্যাবলি পরিচালনার জন্য তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল, প্রেস ইনস্টিটিউট, জাতীয় গণমাধ্যম ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা অধিদপ্তরগুলো, পেশাদার সাংবাদিকদের প্রেসক্লাব, ইউনিয়নসহ বিভিন্ন সংগঠন রয়েছে। অখ্যাত বা ভূইফোড় সাংবাদিকরা মূলধারা সাংবাদিকদের সঙ্গে মিশতে না পেরে তারাও কয়েকজন একত্র হয়ে মিলে বিভিন্ন সাংবাদিক সংগঠন করে চাঁদাবাজি করে থাকে।
এসব ভুঁইফোড় সাংবাদিকদের সংগঠনের ব্যাপারে এলাকার সচেতন মহলকে সচেতন হতে হবে। যে হারে অখ্যাত সাংবাদিক বেড়ে চলেছে, তাতে এই পেশাটি হুমকির মুখে পড়বে। এই মুহূর্তে সরকারের উচিত দেশের ভুঁইফোড় সংবাদমাধ্যমগুলো অর্থাৎ যারা ভুয়া মিথ্যা নিউজ করে দেশ ও দেশের মানুষের মধ্যে অরাজকতা সৃষ্টি করে, সেগুলো বন্ধ করে দিয়ে মূলধারা সাংবাদিকদের মানমর্যাদা রক্ষা করা। সাংবাদিকতায় প্রবেশের যোগ্যতা নির্ধারণ করে দেওয়া। যে কেউ চাইলে যেনতেনভাবে অনলাইন, প্রিন্ট কিংবা ইলেকট্রনিক মিডিয়া খুলে বসতে না পারে, সে বিষয়ে নজরদারি ও নিয়মনীতি প্রয়োজন। একটি বিশ্বস্ত সংবাদ মাধ্যম যেমনিভাবে একটি দেশ ও দেশের মানুষকে সারা বিশ্বের কাছে উঁচু করে তুলতে পারে, আবার তেমনি একটি ভুঁইফোড় সংবাদপত্র বা গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান একটি দেশের ভাবমূর্তি মুহূর্তের মধ্যে বিলীন করে দিতে পারে। তাই দেশের সরকার প্রধানকে আগামী দিনের কথা চিন্তা করে এখনই তড়িৎ গতিতে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
ওসমান গনি
সাংবাদিক ও কলামিস্ট
