চাষযোগ্য জমি কমে যাওয়া ভবিষ্যতের জন্য হুমকি
তহমিনা ইয়াসমিন
প্রকাশ : ২৯ নভেম্বর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

বাংলাদেশের কৃষি এই দেশের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও অর্থনীতির প্রাণশক্তি। কিন্তু উদ্বেগের বিষয় হলো চাষযোগ্য জমি আজ সবচেয়ে দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে এমন এক সম্পদ, যার ওপর দাঁড়িয়ে আমাদের খাদ্যনিরাপত্তা, কৃষিজ উৎপাদন ও গ্রামীণ অর্থনীতি টিকে আছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির চাপ, পরিকল্পনাহীন নগর সম্প্রসারণ, শিল্পায়ন, আবাসিক প্রকল্প, সড়ক নির্মাণ এবং নানা উন্নয়ন প্রকল্পের কারণে প্রতিদিনই কৃষিজমি কমছে। যে জমিতে একসময় ধান দুলত, পাট শুকাত বা সবজির সবুজ শোভা দেখা যেত, সেখানে এখন গড়ে উঠছে বহুতল ভবন, মার্কেট, ইটভাটা বা শিল্পকারখানা। কৃষির ওপর নির্ভরশীল একটি দেশের জন্য এ পরিবর্তন শুধু একটি পরিসংখ্যানগত সংকট নয়, এটি ভবিষ্যতের খাদ্য নিরাপত্তার ওপর সরাসরি আঘাত।
বিশেষজ্ঞদের মতে প্রতি বছর বাংলাদেশ বিপুল পরিমাণ আবাদি জমি হারাচ্ছে, যার বড় অংশই অবকাঠামো এবং বাণিজ্যিক ব্যবহারে চলে যাচ্ছে। মাথাপিছু জমি কমতে কমতে এখন বিশ্বের নিম্নস্তরের দেশগুলোর একটিতে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের শারীরিক চাপ উপকূলে নোনা পানির আগ্রাসন, ঘূর্ণিঝড়ের পরবর্তী লবণাক্ততা, নদীভাঙন, অতিবৃষ্টি ও দীর্ঘস্থায়ী জলাবদ্ধতা। এসব কারণে একদিকে জমি নষ্ট হচ্ছে, অন্যদিকে উৎপাদন ক্ষমতাও কমছে। ফলে দেশ যে পরিমাণ খাদ্য উৎপাদন করছে, তা জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাড়ানো ক্রমেই কঠিন হয়ে পড়ছে।
চাষযোগ্য জমি কমে যাওয়ার এই প্রভাব শুধু কৃষকের ঘরে সীমাবদ্ধ নয়। একটি দেশের আমদানি ব্যয় বেড়ে যায়, বাজার অস্থিতিশীল হয়, খাদ্যমূল্য বাড়ে, মজুত ঝুঁকির মুখে পড়ে, এবং কৃষিভিত্তিক কর্মসংস্থান হ্রাস পায়। কৃষির সঙ্গে সরাসরি বা পরোক্ষভাবে যুক্ত লাখো মানুষের জীবনে অনিশ্চয়তা নেমে আসে। যারা একসময় ফসল ফলিয়ে নিজের পরিবার চালাত, তারা বাধ্য হয়ে শহরের প্রান্তে অস্থায়ী শ্রমিক হয়ে ওঠে, ফলে সামাজিক নিরাপত্তা আরও দুর্বল হয়। দেশের অর্থনৈতিক কাঠামোতে যে ভারসাম্য কৃষি দীর্ঘদিন ধরে ধরে রেখেছিল, তা ক্রমেই ভেঙে পড়ার ঝুঁকি তৈরি করছে।
এ পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রথম প্রয়োজন জোরালো ও বাস্তবসম্মত ভূমিনীতি যেখানে কৃষিজমি রক্ষাকে কঠোরভাবে আইনগত সুরক্ষা দেওয়া হবে। প্রতিটি উন্নয়ন প্রকল্পে কৃষিজমির মূল্য বিবেচনায় নিতে হবে, প্রয়োজন হলে বিকল্প জমি বা কম ক্ষতিকর পরিকল্পনা নির্ধারণ করতে হবে। নিয়ন্ত্রণহীন ইটভাটা, এলোমেলো আবাসন প্রকল্প এবং বাণিজ্যিক স্থাপনা নির্মাণকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা ছাড়া কৃষিজমি সংরক্ষণ সম্ভব নয়। পাশাপাশি অনাবাদি ও পতিত জমি চিহ্নিত করে ব্যবহারযোগ্য করে তুলতে হবে, আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি ও স্মার্ট পানি ব্যবস্থাপনার ব্যবহার বাড়াতে হবে, যাতে সীমিত জমি থেকেও বেশি উৎপাদন পাওয়া যায়। ছাদ কৃষি, উল্লম্ব কৃষি, জলচাষ, মাটিবিহীন কৃষি এসব বিকল্প পদ্ধতি কৃষির নতুন দিগন্ত খুলে দিতে পারে।
এর পাশাপাশি জরুরি হলো- সমাজের প্রতিটি স্তরে সচেতনতা তৈরি করা। উন্নয়নের নামে কৃষিজমি দখল যে একটি দেশের ভবিষ্যৎ খাদ্য নিরাপত্তাকে বিপন্ন করে এ সত্যটি বোঝা অপরিহার্য। জমি একবার নষ্ট হলে সেটি আর ফিরে আসে না, এতে শুধু খাদ্য উৎপাদন কমে না, বরং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য আমরা রেখে যাই এক অনিশ্চিত, দুর্বল এবং আমদানিনির্ভর খাদ্যব্যবস্থা।
এই কারণে চাষযোগ্য জমি রক্ষা এখন একটি জাতীয় দায়িত্ব, সরকারের নীতিমালা, প্রশাসনের ভূমিকা, গবেষণা ও প্রযুক্তির সমন্বয় এবং জনগণের সচেতনতা সবকিছু একসঙ্গে কাজ করলেই এ সংকট মোকাবিলা করা সম্ভব। আজ যে ভুল সিদ্ধান্ত আমরা নেব, তার মূল্য দিতে হবে আগামী প্রজন্মকে; আর আজ যে সঠিক সিদ্ধান্ত নেব, তার সুফল তারা পাবে বহুদিন। তাই উন্নয়ন অবশ্যই হবে; কিন্তু সেই উন্নয়ন হবে পরিকল্পিত, কৃষিবান্ধব এবং ভবিষ্যতের প্রতি দায়িত্বশীল।
চাষযোগ্য জমি রক্ষা মানে শুধু কৃষিকে রক্ষা করা নয়, এটি অর্থনীতি, সমাজ, প্রকৃতি এবং পুরো দেশের ভবিষ্যৎকে রক্ষা করা। দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ ও স্থিতিশীল রাখতে হলে এখনই কৃষিজমি সংরক্ষণের লড়াইকে অগ্রাধিকার দিতে হবে কারণ জমি হারানো মানেই ভবিষ্যৎ হারানো।
তহমিনা ইয়াসমিন
নৃবিজ্ঞান বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
