মৃত্যুফাঁদ ঢাকা : ভূমিকম্প ও বাস্তবতা

কে এম আসিফ ইকবাল আকাশ

প্রকাশ : ৩০ নভেম্বর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

ভূমিকম্প উড়ে এসে জুড়ে বসা কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ নয়। ১৬৪২ সালের ঐতিহাসিক সিলেট ভূমিকম্প থেকে শুরু করে ১৭৬২ সালের চট্টগ্রাম ভূমিকম্প হয়ে ১৯৫০ সালের আসাম ভূমিকম্পে ভূখণ্ডকে বারবার নাড়িয়ে দিয়ে গিয়েছে। কিন্তু গেল কয়েক বছরে এ অঞ্চলে বিজ্ঞানীদের প্রবল ভূমিকম্পের শঙ্কা ও ভূমিকম্পের সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতি এবার জনমনে ভয় বাড়িয়ে দিয়েছে আগের থেকে বহুগুণে।

ভূমিকম্প নিয়ে বিজ্ঞানীরা কী বলেছেন?

বিজ্ঞানীরা একাধিক গবেষণায় সতর্ক করে বলছেন, বাংলাদেশের চারপাশের সক্রিয় ফল্টগুলো বিশেষ করে ডাউকি ফল্ট, শিলং প্ল্যাটো অঞ্চল এবং ইন্দো-বার্মা সাবডাকশন জোনে বহু বছর ধরে চাপ জমে আছে। এই সঞ্চিত শক্তি যেকোনো সময় মাঝারি থেকে প্রবল মাত্রার ভূমিকম্পে রূপ নিতে পারে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এ অঞ্চলে ৭-৮ মাত্রার ভূমিকম্প হওয়ার মতো ভূতাত্ত্বিক পরিস্থিতি আগে থেকেই রয়েছে। সাম্প্রতিক ছোট ও মাঝারি কম্পনগুলোও ভূগর্ভে আসন্ন ভূমিকম্পের সক্রিয়তার ইঙ্গিত দেয়। বাংলাদেশ বাদেও জাপান, যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া, চিলি, নেপালসহ বহু দেশ আছে যারা এমন বা এর থেকেও বহুগুণে আসন্ন বিপদ সঙ্গে নিয়েই অবস্থান করে।

আতঙ্কের উৎস কী?

ঢাকাতে ৬.৯ মাত্রার ভূমিকম্পে ৪০ শতাংশ ভবন ভেঙে পড়তে পারে, বলছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) এর গবেষণা। এমন দুর্যোগে আপতিত হলে প্রাণহানি হতে পারে লক্ষাধিক। এখন প্রশ্ন হলো, ভূমিকম্প পরবর্তী এমন বিপদ কি ঢাকার জন্যে শুরু থেকেই ছিল? নাকি তা আমাদেরই সৃষ্টি? উত্তর এর দায় আমাদের। এ নগরের নাগরিক থেকে শুরু করে, সরকারের কর্তাব্যক্তি, নীতি নির্ধারক প্রত্যেকের দায় সমান। এ নগরকে আমরা বাসযোগ্য ও নিরাপদ করতে বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ), বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড, ইমারত নির্মাণ বিধিমালার মতো বহু আইন করেছি। কিন্তু এ আইন প্রণয়নেও আমরা বিশেষ কিছু শ্রেণি ও গোষ্ঠীর মনোরঞ্জন করতে এমন ফাঁকফোকর রেখে আইন করেছি যা ঢাকাকে নিরাপদ আবাস না বানিয়ে বরং মৃত্যুকূপে পরিণত করেছে। আইন যতখানিই জনবান্ধব, তা কার্যকরের ক্ষেত্রেও নানা সুপারিশ, পেশি প্রদর্শন, শৈথিল্য ও আইনের ফাঁক গলে বাড়তি সুবিধা প্রদান একে করে তুলেছে অকার্যকর। গণমাধ্যমে বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ)-এর এক ফ্লোর এরিয়া রেশিও বা ফার (Floor Area Ratio-FAR) পুনর্বিবেচনা নিয়েই বারবার মিটিং হচ্ছে। আদতে সরকার কি কোনো সমাধানে আসতে পেরেছে যা নগর ও জনবান্ধব? বাসার মালিক বেশি ভাড়ার জন্য, আবাসন ব্যবসায়ী বেশি মুনাফার জন্য, ভাড়াটিয়া বেশি জায়গার জন্যে ফার [FAR] পুনর্বিবেচিত চাচ্ছেন। অথচ, এই বেশি ফার [FAR] একটি শক্তিশালী ভূমিকম্পে কত নিষ্পাপ প্রাণ কেড়ে নিতে পারে সেদিকে আমাদের খেয়াল নেই। সূর্যের আলো বিহীন, আকাশ দেখা বিহীন আবদ্ধ ঘরে কেটে যাওয়া একটি জীবনের কথাতো বাদই দিলাম।

ইন্সটিটিউট অব প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইপিডি) এর এক গবেষণায় দেখা যায়, ঢাকায় ভূমিকম্পের জন্য সব থেকে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা হচ্ছে প্রথমত ঘনবসতি এলাকা, যেখানে ফ্লোর এরিয়া রেশিও বা ফার অতিমাত্রায় বেশি; দ্বিতীয়ত যেসব আবাসিক এলাকা বা বসতি জলাশয় ভরাট করে নির্মিত সেগুলো। ঢাকার বেসরকারি গেটেড কমিউনিটি বা আবাসিক এলাকাগুলো একপাশে রেখে যদি রাজউকের দক্ষিণ বারিধারা আবাসিক এলাকা ও উত্তরা দিয়াবাড়ি ৩য় প্রকল্পসহ অন্যান্য প্রকল্পের দিকে আমরা তাকাই দেখব, রাজউক নিজেই ঢাকা মেট্রোপলিটন ডেভেলপমেন্ট প্ল্যান (ডিএমডিপি) এ চিহ্নিত ওয়াটার রিটেনশন বডি বা জলাধারের সংরক্ষণের তোয়াক্কা না করে ভরাট করে গড়ে তুলেছে বসতি। এখন প্রশ্ন হলো, এ নগরের মানুষকে আসলে রক্ষা করবে কে? অনেকেই বলতে পারেন নিজ প্রেক্ষাপট থেকে এত জলাশয়ের দরকার কী ছিল? কয়েক মাস আগে ঘটে যাওয়া মাইলস্টোন বিমান দুর্ঘটনা যে জায়গায় ঘটে সেটা মূলত জলাশয় বা ওয়াটার রিটেনশন বডি ছিল। ধারণা করছি, এ জলাশয়ের উদ্দেশ ছিল, ঢাকার বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের মাধ্যমে নগরকে জলাবদ্ধতা থেকে রেহাই দেওয়া ও এয়ারপোর্ট সংলগ্ন যেকোনো দুর্ঘটনাকে প্রশমিত করা। মিরপুর-উত্তরা এলাকার ইদানীংকালের সকাল-সন্ধ্যা জলাবদ্ধতা ও মাইলস্টোন দুর্ঘটনা তাই প্রমাণ করে।

কথায় আবার ফিরি, জলাশয় ভরাট করা ভূমিতে অবকাঠামো নির্মাণ কেন ঝুঁকিপূর্ণ? জলাশয় বা ভরাট করা নরম মাটির ওপর অবকাঠামো নির্মাণ করলে ভূমিকম্পে লিকুইফেকশন (মাটির তরলীকরণ) হতে পারে।

অর্থাৎ, কম্পন তরঙ্গের কারণে পানিতে পরিপূর্ণ এই মাটি শক্তি হারিয়ে তরলের মতো আচরণ করতে পারে এবং এতে ভবন ধসে পড়ার ঝুঁকি অনেকটা বেড়ে যায়। রাষ্ট্র জলাশয় ভরাট করে বসতি করল কিন্তু জলাশয় ভরাট করে অবকাঠামো নির্মাণের জন্যে যে বাড়তি সতর্কতা ও নিরাপত্তার বিধিমালা তা কি সরকার করেছে? করলেও তার প্রয়োগ কতোখানি, এ শহরের গণমানুষের যথেষ্ট সন্দেহ আছে। আধুনিক ঢাকার এক বিরাট অংশই তো জলাশয় ভরাট করে নির্মিত। একটি মাঝারি শক্তিশালী ভূমিকম্পের কাছে নগরের হাজার-লাখ মানুষ আসলে কতোখানি নিরুপায়, তা বোঝানো অসম্ভব।

করণীয় কী?

ঢাকাতে হাইট জোনিং ও ল্যান্ড ইউজ জোনিং নিশ্চিত করা, আদর্শ ফ্লোর এরিয়া রেশিও অনুসরণ, বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠনের মাধ্যমে ত্রুটিপূর্ণ আইন সংশোধন ও প্রয়োগের ক্ষেত্রে জিরো টলারেন্স নীতি অবলম্বন। সঙ্গে ঢাকাকে উচ্চতায় আর বৃদ্ধি না করে আয়তনে বর্ধিত করা। পাড়া-মহল্লা পর্যায়ে অবকাঠামো নির্মাণে আইন অনুসরণ হচ্ছে কি না তা সময়ে সময়ে তদারকি ও নকশা বহির্ভূত নির্মাণের ক্ষেত্রে কঠোর পদক্ষেপ নিশ্চিতকরণ।

তুলনামূলক দুর্বল জমিতে স্থাপনা নির্মাণের ক্ষেত্রে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণের আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগ। আমরা সবাই একটু করে ছাড় দিলে, টাকার অঙ্কে মুনাফা একটু কম করলে এ শহর আমাদের জন্য মায়ের কোলের মতো নিরাপদ হতে পারত।

কে এম আসিফ ইকবাল আকাশ

শিক্ষক, স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ (এসইউবি)