তরুণ বেকারত্ব : দক্ষতা নাকি সুযোগের ঘাটতি

আরিফুল ইসলাম রাফি

প্রকাশ : ০১ ডিসেম্বর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

বাংলাদেশ আজ সম্ভাবনার যে উচ্চতায় দাঁড়িয়ে, সেখানে সবচেয়ে বড় সম্পদ আমাদের তরুণ সমাজ। কিন্তু এই সম্ভাবনাই আজ বড় সংকটে। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে প্রতিবছর হাজার হাজার তরুণ বেরিয়ে আসছে, হাতে ডিগ্রি, চোখে স্বপ্ন; তবুও একটি বড় অংশ নিজেদের জন্য উপযুক্ত কর্মজীবন খুঁজে পাচ্ছে না। তরুণ বেকারত্ব তাই শুধু ব্যক্তিগত নয়; এটি জাতীয় উদ্বেগ, যেটি অর্থনীতি, সমাজ, পরিবার এবং রাষ্ট্রের সামগ্রিক স্থিতির ওপর প্রভাব ফেলছে। আমরা উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে এগোচ্ছি ঠিকই; কিন্তু তরুণদের কর্মসংস্থানের প্রশ্নে একটি গভীর অমিল ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে।

দেশের জনসংখ্যা গঠনের সবচেয়ে শক্তিশালী অংশটি হলো তরুণসমাজ। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির নানা সূচকে আমরা উন্নতির গল্প শোনালেও তরুণদের কর্মসংস্থানের চিত্র এ দেশকে অন্য বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করায়। ডিগ্রি অর্জন, প্রযুক্তি ব্যবহারে দক্ষতা এবং আধুনিক চিন্তায় স্বতঃস্ফূর্ততা থাকা সত্ত্বেও বিপুলসংখ্যক তরুণ এখনো কর্মজীবনে প্রবেশ করতে পারছে না। সমস্যাটি শুধু ব্যক্তিগত সংসার-অর্থনীতির সীমাবদ্ধতা তৈরি করছে না, বরং জাতীয় সম্ভাবনার বৃহত্তর অংশকে স্থবির করে দিচ্ছে। আজকের তরুণরা যে সুযোগের প্রত্যাশা করে, দেশের বর্তমান কাঠামো সেই প্রত্যাশার সঙ্গে তাল মেলাতে পারছে না।

দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় উল্লেখযোগ্য বিস্তার ঘটেছে; বিশ্ববিদ্যালয় সংখ্যা বেড়েছে, শিক্ষার্থী প্রবাহ বেড়েছে, উচ্চশিক্ষা এখন আগের চেয়ে বহু বেশি সহজলভ্য। কিন্তু সহজলভ্যতা মানেই উপযোগিতা নয়। বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা ক্রমাগত তত্ত্বনির্ভর, পরীক্ষানির্ভর এবং কর্মজীবনের বাস্তব প্রয়োজন থেকে বিচ্ছিন্ন থেকে গেছে। ফলে বিপুলসংখ্যক তরুণ ডিগ্রি হাতে পেলেও কর্মক্ষেত্রের প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জনে পিছিয়ে পড়ছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শেখানো জ্ঞান ও শিল্পক্ষেত্রের চাহিদার মধ্যে একটি সুস্পষ্ট ব্যবধান তৈরি হয়েছে, যা বেকারত্বের মূলভিত্তি আরও কঠোর করে তুলেছে।

দক্ষতার অভাব নিয়ে প্রচুর আলোচনা হয়; ইংরেজিতে দুর্বলতা, যোগাযোগ দক্ষতার সীমাবদ্ধতা, প্রযুক্তিগত যন্ত্রপাতি ব্যবহারে অনভিজ্ঞতা, দলগত নেতৃত্বে পিছিয়ে থাকা। সত্যিই এসব সমস্যা রয়েছে; তবে সমস্যা এখানেই শেষ নয়। দক্ষতা থাকা মানেই চাকরি নিশ্চিত, এই ধারণা বাস্তবে আর টিকে নেই। দেশে প্রতি বছর যে সংখ্যায় তরুণ শ্রমবাজারে প্রবেশ করে, সেই তুলনায় নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হয় বহু কম। দক্ষতা বাড়ানোর দাবি ঠিকই; কিন্তু সুযোগ সৃষ্টি না হলে দক্ষতার চমকও কোনো ব্যবহার খুঁজে পায় না। অর্থনীতির কাঠামোগত সীমাবদ্ধতা এখানে তরুণদের জন্য সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধক।

বাংলাদেশে শিল্পায়ন এখনও সীমিত কয়েকটি খাতকেন্দ্রিক। পোশাকশিল্প দেশের প্রধান রপ্তানি খাত হলেও সেখানে কর্মসংস্থান বৃদ্ধির হার থমকে গেছে। অটোমেশন বাড়ায় কম দক্ষ শ্রমের প্রয়োজন কমছে। নতুন শিল্প খাতগুলো: ফার্মাসিউটিক্যালস, আইটি ইলেকট্রনিকস, সিরামিক, ই-কমার্স। এগুলো বিকাশমান হলেও তরুণদের বিশাল সংখ্যাকে ধারণ করার মতো কর্মসংস্থান তৈরি করতে পারেনি। ফলে দক্ষতা থাকলেও কাঙ্ক্ষিত চাকরির সুযোগ সৃষ্টি হয় না। তিনটি খাতের ওপর রাষ্ট্রের অতিরিক্ত নির্ভরতা শ্রমবাজারকে সংকুচিত করে রেখেছে, যেখানে নতুন প্রজন্মের জন্য দরকার ছিল বহুমুখী শিল্প বিস্তার।

সরকারি চাকরির প্রতি তরুণদের আকর্ষণ আমাদের সামাজিক কাঠামোর এক ঐতিহ্যগত ধারা। নিরাপত্তা, নিশ্চয়তা, স্থায়িত্ব- এই তিনটি কারণে লাখ লাখ তরুণ সরকারি চাকরির প্রতি ঝুঁকে পড়ে। কিন্তু সেই সুযোগ সীমিত, পদের সংখ্যা অল্প, প্রতিযোগী বিশাল। ফলে এই একমাত্র লক্ষ্যই তরুণদের সময়, সম্ভাবনা ও শক্তির একটি বড় অংশ গ্রাস করে। বহু প্রতিযোগী বছরের পর বছর চেষ্টা করে হতাশ হয়ে পড়ছে, অথচ অন্য খাতে তাদের দক্ষতা কাজে লাগানোর জন্য যথেষ্ট দিকনির্দেশনা ও পেশাগত পরিকাঠামো নেই। ফলে চাকরি প্রাপ্তিতে ব্যর্থতা তরুণদের মানসিক ও আর্থিক সংকট আরও জটিল করে তোলে।

বিদেশে কর্মসংস্থানও বাংলাদেশের অর্থনীতির একটি বড় অংশ। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্য ও কয়েকটি রাষ্ট্রের শ্রমবাজার দ্রুত বদলে যাচ্ছে। তারা এখন অদক্ষ শ্রমিক নয়; প্রযুক্তি-সচেতন, ইংরেজিতে যোগাযোগ সক্ষম এবং বিশেষজ্ঞ দক্ষতা সম্পন্ন কর্মীকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে। ফলে আমাদের দেশের অদক্ষ বা কম দক্ষ তরুণরা আগের মতো বিদেশে সহজে যেতে পারছে না। এই পরিবর্তন দেশীয় শ্রমবাজারের ওপরও চাপ সৃষ্টি করছে, কারণ বিদেশে শ্রম রপ্তানির প্রবাহ কমলে দেশের বেকারত্ব অনিবার্যভাবেই বাড়ে। নতুন প্রযুক্তিগত বাস্তবতা তরুণদের সামনে আবারও দুই ধরনের চ্যালেঞ্জ নিয়ে এসেছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, রোবটিক অটোমেশন, মেশিন লার্নিং। এসব প্রযুক্তি বহু কাজ মানুষের পরিবর্তে করছে। ফলে কিছু কাজ একেবারেই বিলুপ্ত হচ্ছে। আবার নতুন কিছু কাজ তৈরি হচ্ছে- ডিজিটাল মার্কেটিং, সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট, অ্যানিমেশন, ডেটা অ্যানালাইসিস, কনটেন্ট ক্রিয়েশন, সাইবার সিকিউরিটি। কিন্তু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো এই পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মেলাতে পারেনি। ফলে নতুন প্রজন্মের দক্ষতার যে কাঠামো প্রয়োজন, তা গড়ে উঠছে না; আধুনিক শ্রমবাজারে প্রতিযোগিতা তাই আরও কঠিন হয়ে পড়ছে।

ব্যক্তিগত স্তরে তরুণরা যে হতাশার মুখোমুখি হয়, তার সামাজিক প্রভাবও কম নয়। বেকারত্বের সঙ্গে যুক্ত হয় আত্মবিশ্বাস হারানো, আত্মমর্যাদার সংকট, পারিবারিক চাপ, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং দীর্ঘস্থায়ী মানসিক অস্থিরতা। বহু তরুণ ডিগ্রি অর্জন করেই পরিবার ও সমাজে বহুল প্রত্যাশার ভার বইতে থাকে। চাকরি না পাওয়া মানে শুধু অর্থনৈতিক ব্যর্থতা নয়; এটি সামাজিকভাবে অযোগ্যতার মতো চাপ হিসেবে তরুণদের কাঁধে চেপে বসে। তরুণ বয়সেই হতাশা, ভেঙে পড়া, আত্মনির্ভরতা হারানো- এসব একটি জাতির ভবিষ্যৎ শক্তি কমিয়ে দেয়।

তবে দায় একমাত্র তরুণদের নয়; কাঠামোই তাদের সীমাবদ্ধ করছে। সরকার-বেসরকারি খাত ও শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে কার্যকর নীতিগত সমন্বয় না থাকলে সমস্যার গভীরতা আরও বাড়বে। বিরাজমান কাঠামো পরিবর্তনের জন্য শক্তিশালী শিল্পনীতি, বাজারচাহিদা গবেষণা, টেকনিক্যাল শিক্ষার মর্যাদা বৃদ্ধি, শিক্ষাক্রমে সফট স্কিল সংযোজন এবং নতুন খাতে বিনিয়োগকে রাষ্ট্রীয় অগ্রাধিকারে আনা জরুরি। বিভিন্ন দেশের উদাহরণ দেখলে বোঝা যায়, টেকনিক্যাল শিক্ষা ও বাজার চাহিদানির্ভর কোর্সই কর্মসংস্থান বৃদ্ধির আসল সহায়ক।

এখনও সময় আছে, পরিবর্তন সম্ভব। ডিজিটাল অর্থনীতি, ফ্রিল্যান্সিং, স্টার্টআপ ইকোসিস্টেম, ই-কমার্স, ক্রিয়েটিভ ইন্ডাস্ট্রি- এসব খাতে বাংলাদেশের তরুণেরা এরইমধ্যে সম্ভাবনার আলো দেখিয়েছে। কিন্তু সম্ভাবনা বাস্তব কর্মসংস্থান হয়ে উঠবে শুধু তখনই, যখন রাষ্ট্র শিক্ষা ও শিল্পের সংযোগ সুদৃঢ় করবে। উদ্যোক্তা পরিবেশকে আরও স্বচ্ছ ও ঝুঁকি হ্রাসকারী করতে হবে, যাতে নতুন উদ্যোক্তারা টিকে থাকার সুযোগ পায়। পাশাপাশি তরুণদেরও বুঝতে হবে যে সরকারি চাকরিই একমাত্র গন্তব্য নয়; নতুন পৃথিবী নানা পথের দরজা খুলে দিয়েছে। তাই স্পষ্ট, তরুণ বেকারত্বের দায় শুধু দক্ষতার অভাবের ঘাড়ে চাপালে সমস্যার অর্ধেকটাই উপেক্ষা করা হয়। আবার শুধু সুযোগের সংকটকে দায়ী করলেও সমাধান আসবে না। এ দুটির জটিল সম্পর্ক একটি চক্র তৈরি করেছে। শিক্ষায় দুর্বলতা, দক্ষতায় সীমাবদ্ধতা, শিল্পে সংকট, চাকরির ঘাটতি এবং হতাশা- এই পরস্পরনির্ভর চক্র ভাঙতে হলে জাতীয় অগ্রাধিকার বদলাতে হবে। কারণ তরুণদের প্রত্যাশা পূরণ মানে শুধু কয়েক লাখ কর্মসংস্থান সৃষ্টি নয়; এটি একটি জাতির শক্তি, স্থিতি, আস্থা ও ভবিষ্যৎ নির্মাণ।

তরুণদের সম্ভাবনা অবারিত; কিন্তু সম্ভাবনাকে সফলতার দিকে নিয়ে যেতে রাষ্ট্র, সমাজ, প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি- সবার ভূমিকা দরকার। যারা দক্ষতা তৈরি করবে তাদের জন্য সুযোগ থাকতে হবে; আর যেখানে সুযোগ নেই সেখানে দক্ষতা গড়ে উঠলেও তা অপচয় হয়। বাংলাদেশের উন্নয়নের ভবিষ্যৎনির্ভর করছে এই সহজ সত্যকে বাস্তব নীতিতে রূপ দিতে পারার ওপর। তরুণরা যদি নিজেদের পথ খুঁজে পায়, রাষ্ট্র তার সঠিক ভূমিকা পালন করে এবং সমাজ যদি পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারে, তবেই এই জনসমুদ্র বোঝা নয়, বরং শক্তি হয়ে উঠবে।

আরিফুল ইসলাম রাফি

গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়