অভিভাবকের সচেতনতা ও পারিবারিক বন্ধন

আরিফুল ইসলাম রাফি

প্রকাশ : ০২ ডিসেম্বর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

অভিভাবকের সচেতনতা আজকাল শুধু একটি প্রয়োজন নয়, বরং সময়ের কঠোর দাবি। সমাজ যতই বদলাচ্ছে, প্রযুক্তি যতই সর্বগ্রাসী হয়ে উঠছে, পারিবারিক বন্ধন ততই নানা দিক থেকে টানাপোড়েনের মুখোমুখি হচ্ছে। একসময় একটি পরিবার ছিল পারস্পরিক বিশ্বাস, বোঝাপড়া, স্নেহ ও দায়িত্ববোধের সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয়। এখন সেই আশ্রয় অনেক পরিবারেই হারাচ্ছে তার স্বাভাবিক উষ্ণতা। এর পেছনে রয়েছে নানান সামাজিক, অর্থনৈতিক, প্রযুক্তিগত ও মানসিক কারণ; কিন্তু এর কেন্দ্রে আছে অভিভাবকের ভূমিকা, যেটি কখনও অবহেলায়, কখনও সময়ের অভাবে, কখনও আবার সচেতনতার ঘাটতিতে দুর্বল হয়ে পড়ছে।

আজকের শিশুরা বড় হচ্ছে এমন এক পৃথিবীতে, যেখানে বাস্তবের চেয়ে ভার্চুয়াল উপস্থিতিই বেশি শক্তিশালী। তারা পরিবারের সঙ্গে যতটা সময় কাটায়, তার চেয়ে বেশি সময় কাটায় স্ক্রিনে, গেমে, সামাজিক মাধ্যমে বা অ্যালগরিদম দ্বারা বোনা এক বিচ্ছিন্ন জগতে। এই অবস্থায় যদি অভিভাবকরা কেবলমাত্র উপার্জন, ব্যস্ততা বা দৈনন্দিন জীবনযাপনের যান্ত্রিকতায় ডুবে থাকেন, তবে সন্তানদের সঙ্গে মানসিক যোগাযোগ ক্রমেই দূরত্বে হারিয়ে যায়। সন্তান তখন নিজের প্রশ্ন, ভয়, কৌতূহল, ভুল কিংবা বিচ্যুতি নিয়ে পরিবারের বাইরে অন্য উৎসের ওপর ভরসা করতে শুরু করে, যা সবসময় নিরাপদ বা ইতিবাচক নাও হতে পারে। অভিভাবকের সচেতনতা প্রথমত প্রকাশ পায় সন্তানের প্রতি সময় দেওয়ার মধ্যে। এই সময় শুধু বসে থাকা নয়; বরং কথোপকথন, শোনা, বোঝা, স্নেহ দেওয়া আর প্রয়োজন হলে সঠিকভাবে সীমা টেনে দিতে পারার ক্ষমতা। সন্তান যখন নিজের আনন্দ ভাগ করে নেয়, তখন অভিভাবকের উপস্থিতি তাকে আত্মবিশ্বাসী করে তোলে; আর যখন ভুল করে, তখন সেই ভুলের ব্যাখ্যা শেখানোর মধ্যেই পরিণত হয় ভালোবাসার সবচেয়ে কার্যকর রূপ। অনেকে মনে করেন শাসনই হলো সন্তানের উন্নতির প্রধান উপায়, কিন্তু শাসনের আগে দরকার সম্পর্ক; আর সম্পর্ক গড়ে ওঠে বোঝাপড়া, সহানুভূতি ও খোলা আলোচনার ওপর। পারিবারিক বন্ধন তখনই দৃঢ় হয় যখন পরিবার একে অন্যের দুর্বলতাকে গ্রহণ করতে শেখে। পরিবার শুধু সাফল্যের গল্প শোনানোর জায়গা নয় বরং ব্যর্থতা, আতঙ্ক, উদ্বেগ ও ভুল সিদ্ধান্ত ভাগ করে নেওয়ার নিরাপদ আশ্রয়।

কিন্তু আধুনিক জীবনের প্রতিযোগিতাময় পরিবেশে অনেক পরিবারেই শিশুদের ওপর চাপ বাড়ছে। একা টিউশনি, ফলাফলের প্রতিযোগিতা, কোচিং, সমাজের প্রত্যাশা- সব মিলিয়ে তারা নিজেদের পরিবারেরই কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। যদি অভিভাবকরা তাদের প্রত্যাশাগুলোকে মানবিকতার আলোতে না দেখেন, তবে সন্তানদের মানসিক ভারসাম্য নষ্ট হতে বেশি সময় লাগে না।

অন্যদিকে পারিবারিক বন্ধনের ক্ষয় শুধুমাত্র সন্তানের অবহেলায় নয়; দাম্পত্য সম্পর্কে দূরত্ব, পরিবারে অশান্তি, অপ্রয়োজনীয় তুলনা, পারস্পরিক সম্মানের অভাব- এসবই সন্তানের মনে নানা জটিল প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। একটি পরিবার তখনই সুস্থ থাকে যখন তার ভিত্তি হলো ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা। বাবা-মা যদি একে অন্যের প্রতি সদাচরণ, সহমর্মিতা ও সৌজন্য প্রদর্শন করেন, সন্তান সেটাই শেখে। অভিভাবকের আচরণই সন্তানের কাছে সবচেয়ে বড় পাঠ্যবই। পরিবারে স্নেহ, পরামর্শ ও আস্থাই তাকে সামনে এগোনোর শক্তি দেয়। আজকের সমাজে অভিভাবকের সচেতনতা মানে শুধু নিরাপত্তা, পড়াশোনা বা নিয়মশৃঙ্খলা নিশ্চিত করা নয়; বরং সন্তানকে মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা।

আরিফুল ইসলাম রাফি

শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ