প্রশ্নফাঁস সংস্কৃতি বনাম শিক্ষার পতন
আরশী আক্তার সানী
প্রকাশ : ০২ ডিসেম্বর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে সবচেয়ে বিপজ্জনক ও দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা হলো প্রশ্নফাঁস সংস্কৃতি। এটি শুধু একাধিক পরীক্ষায় ধরা দেয় না, বরং শিক্ষার মূল ভিত্তিকে নাড়া দেয়। আমরা অনেক সময় পড়াশোনার মান, সিলেবাসের কঠিনতা, শিক্ষক সংকট বা ক্লাসরুমের ভিড় নিয়ে আলোচনা করি। কিন্তু এই সমস্ত সমস্যার পেছনে সবচেয়ে বড় প্রভাব ফেলছে প্রশ্নফাঁস, যা শিক্ষার্থীদের নৈতিকতা, পরিশ্রম এবং দক্ষতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। প্রশ্নফাঁস শুধু অপরাধ নয়; এটি একটি সামাজিক ও নৈতিক সংকট, যা শিক্ষার মূল উদ্দেশকে ক্ষয় করছে। প্রশ্নফাঁস সাধারণত দুটি কারণে হয়। এক, পরীক্ষার পরিচালনার দুর্বলতা এবং দুই, কিছু মানুষের সহজে অর্থ আয়ের লোভ। প্রতিটি ধাপে যেমন প্রশ্নপত্র তৈরি, সংরক্ষণ এবং পরিবহন দুর্বলতা থাকলে সুযোগপন্থিরা তা কাজে লাগায়। কিন্তু সমস্যা শুধু এখানেই শেষ নয়। মূল সমস্যা হলো চাহিদা। শিক্ষার্থীরা যখন প্রশ্ন আগে পেতে চায়, তখন বাজারে সরবরাহও তৈরি হয়। এই চক্রে শিক্ষার্থী, শিক্ষক এবং প্রতিটি অংশগ্রহণকারী একে অন্যের ওপর নির্ভর করে।
সমাজে জিপিএ-৫ বা সর্বোচ্চ নম্বরকে যেন দেবতার আসনে বসানো হয়েছে। পরিবারের চাপ, বন্ধুবান্ধবের প্রত্যাশা, এবং নিজের স্বপ্ন সব মিলিয়ে শিক্ষার্থীরা মনে করে, যেভাবেই হোক, ভালো ফল আনতেই হবে। এই চাপ শিক্ষার্থীদের শর্টকাটের দিকে ঠেলে দেয়। তারা বুঝতে পারে, পরিশ্রম করলে হয়তো ফল ভালো হবে, আর ফাঁকি দিলে নিশ্চয়ই দ্রুত ফল মিলবে। ফলে প্রশ্নফাঁস যেন শিক্ষার শর্টকাট হয়ে দাঁড়ায়। শর্টকাট নেওয়া সমাজে স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে। কেউ যদি বলে, প্রশ্ন পেয়েছি, তখন তাকে দোষারোপ করা হয় না; বরং অনেকেই এ পথে হাঁটার উপায় জানতে চায়। আমরা ভুলে যাই যে শর্টকাটে পাওয়া নম্বর দীর্ঘমেয়াদে কোনো দক্ষতা বা আত্মবিশ্বাস গড়ে তোলে না। শিক্ষার্থীরা মুখস্থকারী, নম্বরভিত্তিক, আত্মবিশ্বাসহীন হয়ে পড়ে। তারা শেখার প্রকৃত মানে বোঝে না এবং কেবল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার দিকে মনোযোগ দেয়।
শিক্ষার মান কমে যাওয়ার মূল কারণ শিক্ষাব্যবস্থার ভেতরের নৈতিকতার অবনতি। শিক্ষক, অভিভাবক, ছাত্র সবার মধ্যে নৈতিক মূল্যবোধের দুর্বলতা শিক্ষার ভিতকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। প্রশ্নফাঁস শিক্ষার্থীদের সততা, পরিশ্রম এবং অধ্যবসায়ের মূল্যকে অস্বীকার করে। এটি শিক্ষার নৈতিক ভিত্তিকে সরাসরি আঘাত করে।
প্রশ্নফাঁস শিক্ষার্থীদের বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। প্রথমে, শেখার প্রতি আগ্রহ নষ্ট হয়। যখন প্রশ্ন আগেই পাওয়া যায়, শিক্ষার্থীরা ভাবতে শেখে না। তারা মনে করে, পরিশ্রম করা মানে সময় নষ্ট করা। দ্বিতীয়ত, আত্মবিশ্বাস কমে যায়। যারা প্রশ্নফাঁসের উপর নির্ভর করে ভালো ফলাফল করে, তারা ভবিষ্যতে বাস্তব জীবনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে পারে না। তৃতীয়ত, দক্ষতা অর্জন হয় না। আজকের সময়ে শুধু বই পড়া বা পরীক্ষা পাস করলেই চলবে না; বিশ্লেষণ, যোগাযোগ, সৃজনশীলতা, সমস্যা সমাধানের দক্ষতা প্রয়োজন। প্রশ্নফাঁস শিক্ষার্থীদের এই দক্ষতা অর্জনের সুযোগ থেকে বঞ্চিত করে। শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্কও প্রশ্নফাঁসের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। শিক্ষার্থীর কাছে শিক্ষক এক সময় মানসম্পন্ন নির্দেশদাতা ছিলেন; এখন শিক্ষার্থীর মনে প্রশ্ন আসে, শিক্ষক কি সত্যিই ন্যায়পালন করছেন? এতে শিক্ষকপ্রতি বিশ্বাস কমে যায় এবং শিক্ষার পরিবেশে সন্দেহ জন্মায়। এছাড়াও পরীক্ষার মর্যাদা হারায়। একটি পরীক্ষা শুধু নম্বর প্রদানের মাধ্যম নয়; এটি শিক্ষার্থীর বছর ব্যাপী পরিশ্রমের মূল্যায়ন। কিন্তু যখন প্রশ্ন ফাঁস হয়ে যায়, পরীক্ষা অর্থহীন হয়ে যায়। ফলাফল নির্ভর করে কেবল কাগজে লেখা নম্বরে, যা সত্যিকারের দক্ষতা প্রতিফলিত করে না।
প্রশ্নফাঁসের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব দেশের ওপরও পড়ে। অদক্ষ মানবসম্পদ তৈরি হয়, যা ভবিষ্যতে দেশকে অগ্রসর হতে দেয় না। আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ার ঝুঁকি থাকে, কারণ দক্ষতা বিহীন শিক্ষার্থী চাকরি বা প্রতিযোগিতায় সফল হতে পারে না। প্রশাসনে দুর্নীতি বাড়ে। যারা প্রশ্নফাঁসের মাধ্যমে সাফল্য অর্জন করে, তাদের মধ্যে নৈতিকতার অভাব থাকে, যা ভবিষ্যতে রাষ্ট্রের উন্নয়ন বা দায়িত্বশীল পদে প্রভাব ফেলে।
শিক্ষার্থীর জীবনে প্রশ্নফাঁস এক ধরনের মানসিকতা তৈরি করে ফাঁকি দিয়ে সফল হওয়া যায়। এটি শুধু শিক্ষার্থীর নৈতিকতা নয়, পুরো সমাজের নৈতিক কাঠামোকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। শিক্ষার মূল উদ্দেশ হলো জ্ঞান, দক্ষতা, নৈতিকতা এবং মূল্যবোধ চর্চা। কিন্তু প্রশ্নফাঁস এগুলোর বিকল্প হিসেবে দেখা দেয়, যা শিক্ষার মূল্যকে হ্রাস করে।
সমাধান সহজ নয়, কিন্তু অসম্ভবও নয়। প্রথমে শিক্ষার নৈতিক ভিত্তি পুনর্গঠন করতে হবে। শিক্ষার্থীকে শেখাতে হবে পরিশ্রমের মূল্য। শিক্ষক ও অভিভাবককে দায়িত্ব নিতে হবে শিক্ষার্থীর প্রতি চাপ কমানো, নৈতিক শিক্ষা দেওয়া এবং পরীক্ষা প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা বজায় রাখা। শুধুমাত্র কঠোর আইনি ব্যবস্থা নয়, মানসিক ও নৈতিক পরিবর্তনই স্থায়ী সমাধান।
শিক্ষার্থীদের মনোভাব পরিবর্তনের জন্য পরিবার ও স্কুল মিলিতভাবে কাজ করতে হবে। ছাত্রদের বোঝাতে হবে যে শর্টকাট শুধুমাত্র পরীক্ষার জন্য নয়; জীবনেও এটি ক্ষতিকারক। শেখার আসল মানে হলো দক্ষতা, আত্মবিশ্বাস এবং নৈতিকতা অর্জন। শিক্ষকরা উদাহরণ স্থাপন করে দেখাতে পারেন যে সততা, পরিশ্রম এবং অধ্যবসায় সবসময় ফল আনে।
শিক্ষাব্যবস্থার স্বচ্ছতা বৃদ্ধি করতে হবে। প্রশ্নপত্র তৈরির প্রতিটি ধাপ মনিটর করা, সুরক্ষিত সংরক্ষণ ব্যবস্থা, এবং নির্ভরযোগ্য পরিবহন নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি। শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের সচেতন করা উচিত, যাতে তারা প্রশ্নফাঁসের ঝুঁকি সম্পর্কে জানতে পারে এবং এ থেকে দূরে থাকে। শিক্ষার মান পুনরুদ্ধার করা মানে দেশের ভবিষ্যতকে রক্ষা করা। অদক্ষ, নৈতিকভাবে দুর্বল এবং আত্মবিশ্বাসহীন শিক্ষার্থী দেশের উন্নয়নকে ব্যাহত করে। তাই আমাদের জন্য জরুরি শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য পুনর্বিবেচনা করা, প্রশ্নফাঁসের সংস্কৃতি নির্মূল করা, এবং শিক্ষার্থীদের নৈতিক ও দক্ষ মনোভাব গড়ে তোলা।
প্রশ্নফাঁস বনাম শিক্ষার পতন এই দ্বন্দ্বের শেষজবাব সমাজের নৈতিকতা ও শিক্ষাব্যবস্থার স্বচ্ছতা পুনরায় প্রতিষ্ঠা ছাড়া সম্ভব নয়। শিক্ষার আসল মানে হচ্ছে কেবল নম্বর নয়; এটি হচ্ছে দক্ষতা, সততা, চিন্তাশীলতা এবং নৈতিক শিক্ষার বিকাশ। এই পরিবর্তনই পারে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে প্রশ্নফাঁসের অভিশাপ থেকে মুক্তি দিতে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সমৃদ্ধ, দক্ষ ও নৈতিকভাবে শক্তিশালী করে গড়ে তুলতে।
আরশী আক্তার সানী
গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
