বিদেশে মেধা পাচার বাংলাদেশের ক্ষতি না সুযোগ

আরশী আক্তার সানী

প্রকাশ : ০৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

বাংলাদেশ ধীরে ধীরে উন্নত দেশের পথে হাঁটছে। একসময় আমরা কেবল কৃষির ওপর নির্ভরশীল ছিলাম, কিন্তু এখন শিল্প, ব্যবসা, প্রযুক্তি- সবকিছু দ্রুত বদলে যাচ্ছে। তবে একটা বড় সমস্যা বা বিতর্ক এখন অনেকের আলোচনায় উঠে আসে- আমাদের সেরা শিক্ষিত মানুষ, যাদের আমরা অনেক কষ্টে তৈরি করি, তারা দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে। কেউ বিদেশে পড়তে যায়, কেউ চাকরি করে থেকে যায়, কেউ আবার পুরো পরিবার নিয়ে অন্য দেশে বসতি গড়ে তোলে। এই ঘটনা আমরা বলি মেধা পাচার বা Brain Drain।

এটা ভালো না খারাপ- এই প্রশ্ন নিয়ে অনেকের মধ্যে তর্ক-বিতর্ক চলে। কেউ বলে এটা দেশের জন্য ভয়ংকর ক্ষতি, আবার কেউ বলে বিদেশে যাওয়া মানুষ দেশের জন্য সুযোগ তৈরি করে। এখন আমরা এই দুই দিক নিয়ে ধীরে ধীরে আলোচনা করব।

ক্ষতির দিক : দেশের জন্য বড় সমস্যা- প্রথমেই বলতে হয়, একজন মানুষকে শিক্ষিত করতে দেশের প্রচুর সময়, টাকা ও পরিশ্রম লাগে। সরকার প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত বই দেয়, শিক্ষক বেতন দেয়, ল্যাব তৈরি করে। একজন ডাক্তার তৈরি করতে অন্তত দশ-বারো বছর সময় লাগে। একজন ইঞ্জিনিয়ার তৈরি করতে চার-পাঁচ বছর লাগে। এত কষ্ট করে তৈরি করা এই মানুষ যদি বিদেশে গিয়ে কাজ করে, তখন সেই লাভ বিদেশ পায়, দেশ পায় না। এই কারণে দেশের মধ্যে দক্ষ মানুষের ঘাটতি তৈরি হয়। হাসপাতালে ডাক্তার পাওয়া কঠিন হয়। স্কুল-কলেজে ভালো শিক্ষক থাকে না। গবেষণাগারে বিজ্ঞানী থাকে না। কারখানায় দক্ষ ইঞ্জিনিয়ার না থাকলে উৎপাদন কমে যায়। ফলে দেশের উন্নয়নের গতি ধীরে হয়ে যায়।

আরেকটা বড় সমস্যা হলো গবেষণার সুযোগ কমে যাওয়া। যারা নতুন আবিষ্কার বা উদ্ভাবন করতে পারত, তারা বিদেশে গিয়ে অন্য দেশের হয়ে কাজ করে। ফলে বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে পিছিয়ে পড়ে।

এছাড়া সামাজিক, মানসিক প্রভাবও পড়ে। যখন সবাই দেখে ভালো ছাত্ররা দেশ ছাড়ছে, তখন দেশের তরুণদের মধ্যে একটা ধরনের হতাশা তৈরি হয়। তারা ভাবে- “দেশে কিছু নেই, বিদেশেই ভবিষ্যৎ।” এই মানসিকতা দেশের প্রতি ভালোবাসা কমিয়ে দেয়।

সুযোগের দিক : নতুন সম্ভাবনা- তবে সবকিছু যে খারাপ, তা নয়। বিদেশে যাওয়া মানুষের মাধ্যমে দেশের জন্য অনেক ভালো কিছু হয়। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো রেমিট্যান্স। বিদেশে থাকা মানুষ তাদের পরিবারকে টাকা পাঠায়। এই টাকা দিয়ে দেশে নতুন বাড়ি হয়, ব্যবসা শুরু হয়, বাচ্চারা ভালো স্কুলে পড়ে, চিকিৎসা নেয়। পুরো গ্রামের অর্থনীতি বদলে যায়।

বিদেশে গিয়ে মানুষ নতুন নতুন প্রযুক্তি শেখে। পরে দেশে এসে সেই জ্ঞান ব্যবহার করে। কেউ নতুন কোম্পানি খোলে, কেউ বিদেশি বিনিয়োগ আনে, কেউ আবার আন্তর্জাতিক মানের পণ্য তৈরি করে। এছাড়া বিদেশে যারা ভালো কিছু করে, তারা দেশের জন্য গর্ব বয়ে আনে। যেমন বিদেশে থাকা কোনো বিজ্ঞানী যদি বড় পুরস্কার পায়, তখন সারা বিশ্বে বাংলাদেশের নাম আলোচিত হয়।

ভারসাম্য আনার উপায় : এখন আসল প্রশ্ন- আমরা কীভাবে ক্ষতি কমিয়ে সুযোগকে কাজে লাগাবো? প্রথমে দেশে ভালো সুযোগ তৈরি করতে হবে। ভালো বেতন, আধুনিক অফিস, গবেষণার ল্যাব, ফান্ড- এসব বাড়াতে হবে। চাকরির পরিবেশ ভালো হলে মানুষ বিদেশে না গিয়ে দেশে কাজ করতে চাইবে। বিদেশে যারা গেছে, তাদের সাথে যোগাযোগ রাখা দরকার। তাদের দেশে ফিরে কাজ করার জন্য সুবিধা দিতে হবে। যেমন- ট্যাক্স কমানো, সরকারি প্রকল্পে কাজ করার সুযোগ, বা বিশেষ পদে নিয়োগ দেওয়া। এছাড়া যেসব ছাত্র-ছাত্রী সরকারি স্কলারশিপে বিদেশে পড়তে যায়, তাদের জন্য নিয়ম করা যেতে পারে যে পড়াশোনা শেষে অন্তত কয়েক বছর দেশে কাজ করতে হবে। এতে দেশের বিনিয়োগ নষ্ট হবে না।

বাস্তব উদাহরণ : ভারত এই কাজটা খুব ভালোভাবে করছে। তারা বিদেশে থাকা ভারতীয় মেধাবীদের দেশে এনে গবেষণা করাচ্ছে। চীনও একইভাবে বিদেশে থাকা শিক্ষার্থীদের দেশে ফিরিয়ে এনে বড় বড় আবিষ্কার করছে। বাংলাদেশেও এই ধারা শুরু হয়েছে। অনেক তরুণ বিদেশ থেকে এসে আইটি কোম্পানি, স্টার্টআপ খুলছে। অনেকেই ফ্রিল্যান্সিং টিম বানাচ্ছে। এর ফলে দেশে নতুন চাকরি তৈরি হচ্ছে।

ভবিষ্যতের বাংলাদেশ : আমরা যদি এখনই সঠিক পরিকল্পনা করি, তাহলে বিদেশে মেধা পাচার আর সমস্যা হবে না। বরং এটি হবে আমাদের শক্তি। বিদেশে যাওয়া মানুষরা দেশের উন্নয়নের অংশ হবে। একটা দিন আসবে যখন বিদেশে থাকা বাংলাদেশিরা শুধু টাকা পাঠাবে না, বরং প্রযুক্তি, ব্যবসা, গবেষণা- সবকিছু দেশে এনে বাংলাদেশের মানচিত্র পাল্টে দেবে।

আরশী আক্তার সানী

গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়