শিল্পে জ্বালানি সংকট
গুরুত্ব দিতে হবে নবায়নযোগ্য খাতে
প্রকাশ : ০৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

দেশের শিল্প খাতে নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করা বর্তমানে এক মারাত্মক চ্যালেঞ্জ হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে, যা সামগ্রিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, উৎপাদন ও বিনিয়োগকে গভীরভাবে প্রভাবিত করছে। এক খবরে প্রকাশ, ঢাকা চেম্বার অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) এবং সানেমের যৌথ আলোচনা সভায় ব্যবসায়ীরা এই সংকটের ভয়াবহতা ও তা থেকে উত্তরণের উপায় নিয়ে কথা বলেছেন। তাদের বক্তব্যে উঠে এসেছে, জিডিপিতে ৩৫ শতাংশের বেশি অবদান রাখা শিল্প খাত এখন গভীর অস্তিত্ব সংকটের মুখে। মাত্র এক বছরে গ্যাসের দাম ১৭৮ শতাংশ এবং সম্প্রতি তা আরও ৩৩ শতাংশ বৃদ্ধির ফলে টেক্সটাইল, স্টিল ও সারের মতো প্রধান শিল্পগুলোর উৎপাদন ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ কমে গেছে। বিশেষ করে এসএমই খাত কার্যক্রম গুটিয়ে নিতে বাধ্য হচ্ছে, যা কর্মসংস্থানের ওপর সরাসরি নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। ব্যবসায়ীদের মতে, শিল্পায়নের অভাবে এরই মধ্যে প্রায় ১৪ লাখ মানুষ চাকরি হারিয়েছে, যা দেশের ক্রমবর্ধমান বেকারত্বের হারকে আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে।
বলাবাহুল্য, এই সংকটের মূলে রয়েছে জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর অত্যধিক নির্ভরতা এবং দেশীয় গ্যাসের মজুত হ্রাস সত্ত্বেও অনুসন্ধান কার্যক্রমে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতির অভাব। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) চেয়ারম্যান স্বীকার করেছেন, ২০৩০ সালের পর দেশীয় গ্যাসের মজুত ফুরিয়ে আসার পূর্বাভাস সত্ত্বেও অফশোর-অনশোরে গ্যাস অনুসন্ধানে তেমন অগ্রগতি হয়নি। ফলে দেশকে আমদানি করা গ্যাসের ওপর নির্ভরশীল হতে হচ্ছে, যার জেরে জ্বালানির উচ্চমূল্য শিল্পের উৎপাদন খরচ বাড়িয়ে দিচ্ছে। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় তারা বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণের ওপর জোর দিয়েছেন। যেমন- শিল্প ও অর্থনীতিকে বাঁচাতে জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতা কমিয়ে সৌর, বায়ু ও অন্যান্য নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার সম্প্রসারণ করা। কারণ, এটি শুধু পরিবেশবান্ধবই নয়, বরং দীর্ঘমেয়াদে আমদানিনির্ভরতা কমিয়ে জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে।
বিইআরসি চেয়ারম্যানের তথ্য অনুযায়ী, জ্বালানি খাতে বর্তমানে দক্ষতার হার মাত্র ৩০ শতাংশের কাছাকাছি। এই দক্ষতা বাড়ানো গেলে বিদ্যুৎ ঘাটতি হ্রাস করা সম্ভব হবে। এছাড়া, শিল্প খাতে এনার্জি অডিট বাধ্যতামূলক করার পাশাপাশি জ্বালানি অপচয় রোধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। এটাও ঠিক, বিদ্যমান জ্বালানিবিষয়ক ভালো নীতিমালাগুলোর দুর্বল বাস্তবায়ন এদেশে একটি বড় সমস্যা। একইসঙ্গে, বিদ্যমান শুল্ক কাঠামো পরিবর্তন না হলে এ খাতের সমস্যার দীর্ঘস্থায়ী সমাধানও সম্ভব নয়।
আমরা মনে করি, আমদানির ওপর বেশিমাত্রায় নির্ভরশীল হলে ব্যবসায়িক খরচ ক্রমাগত বাড়বে। তাই জাতীয় নিরাপত্তা এবং খাদ্য নিরাপত্তার পরই গুরুত্বপূর্ণ এই জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে দেশীয় উৎসের ওপর বেশি গুরুত্ব দেওয়া জরুরি। অন্যদিকে, জ্বালানি সংকটের এই ঢেউয়ে রপ্তানি খাতও টালমাটাল হতে দেখা যাচ্ছে। ব্যবসায়ীদের দাবি, যুক্তরাষ্ট্রের বাড়তি শুল্ক ও ক্রয়াদেশ কমে যাওয়ায় পোশাক রপ্তানিতে বড় সমস্যার শঙ্কা তৈরি হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে শিল্পে নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করা শুধু নীতিগত অগ্রাধিকারই নয়, বরং জাতীয় অর্থনীতির স্থিতিশীলতা ও টেকসই শিল্পায়নের জন্য অপরিহার্য। দ্রুততম সময়ে দীর্ঘমেয়াদি এবং বাস্তবমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করে সরকার শিল্প খাতকে এই কঠিন পরিস্থিতি থেকে রক্ষা করবে, এটাই প্রত্যাশা।
