গ্রামের হারিয়ে যাওয়া উঠোন সংস্কৃতি ও পারিবারিক বন্ধনের পরিবর্তন
তহমিনা ইয়াসমিন
প্রকাশ : ০৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
একটা সময় বাংলাদেশের গ্রাম মানেই ছিল উঠোনকেন্দ্রিক জীবন। বাড়ির মাঝখানে বড় করে বিছানো সেই খোলা জায়গাটি ছিল পরিবারের প্রাণকেন্দ্র যেখানে সকালের প্রথম আলোয় ধান শুকাতো, দুপুরে পিঁড়িতে বসে দাদি গল্প বলতেন, সন্ধ্যায় প্রতিবেশীরা এসে যেতো চায়ের আড্ডায়, আর রাতের তারাভরা আকাশের নিচে পরিবারের সবাই একসঙ্গে বসে দিনের ক্লান্তি ঝেড়ে ফেলত। উঠোন যেন শুধু মাটির একটা খোলা জায়গা ছিল না, বরং পরিবার, প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজন সবাইকে একসূত্রে বেঁধে রাখার এক অদৃশ্য সেতু।
কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে গ্রামের জীবনযাত্রার পরিবর্তন এই উঠোন সংস্কৃতিকে ধীরে ধীরে বিলীন করে দিচ্ছে। আধুনিক নির্মাণশৈলী, জমির সংকট, বারান্দাকেন্দ্রিক ছোট ঘর, একক পরিবার প্রথার বেড়ে ওঠা সব মিলিয়ে সেই খোলা উঠোন আজ হারিয়ে যাচ্ছে দ্রুত। আগে যে উঠোনে বিকেলে বাচ্চারা খেলত, মহিলারা রান্নার ফাঁকে গল্প করতেন এবং পুরুষরা কাজ শেষে বিশ্রাম নিতেন, আজ সেই জায়গা আর নেই অনেক বাড়িতে। আঁটসাঁট সীমানা দেয়ালে ঘেরা বাড়িগুলো মানুষকে একদিকে নিরাপত্তা দিলেও অন্যদিকে ধীরে ধীরে বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছে।
এছাড়া গ্রামীণ অর্থনীতির পরিবর্তনও উঠোন সংস্কৃতিকে প্রভাবিত করছে। আগে কৃষিকাজ, গৃহস্থালি, পশুপালন সবকিছুই উঠোন ঘিরেই হতো। এখন যেহেতু কৃষিকাজের ধরন বদলে গেছে, যান্ত্রিকতা এসেছে, বাড়ির সামনে সেই দৈনন্দিন ব্যস্ততা আর দেখা যায় না। মানুষ রোজগারের জন্য শহরমুখী হচ্ছে, পরিবারের পুরোনো সদস্যরা একসঙ্গে সময় কাটানোর সুযোগ কম পাচ্ছে। ফলে যে উঠোন একসময় ছিল জীবনের কেন্দ্রবিন্দু, এখন তা অনেক বাড়িতে শুধু বাড়ির মানচিত্রের একটি অংশ হয়ে গেছে।
উঠোনের অভাব গ্রামীণ সামাজিক সম্পর্ককেও প্রভাবিত করছে গভীরভাবে। আগে প্রতিবেশীর দুঃখ-সুখ জানার সবচেয়ে সহজ মাধ্যম ছিল উঠোনের আড্ডা; এখন সেই জায়গায় এসেছে মোবাইল স্ক্রিন। পরিবারের সবাই একই বাড়িতে থাকলেও নিজেদের ঘরে সরে গিয়ে ফোনে ব্যস্ত হয়ে পড়ে ফলে কথাবার্তা, হাসি-ঠাট্টা, মান-অভিমান সবই কমে যাচ্ছে। সেই আন্তরিকতা, আগের মতো একসঙ্গে বসে সময় কাটানোর আন্তঃপ্রজন্ম সম্পর্ক সবই আজ ধীরে ধীরে ক্ষীণ হচ্ছে।
উঠোন ছিল গ্রামের শিশুদের সামাজিক শিক্ষার প্রথম বিদ্যালয়। সেখানে তারা দলবেঁধে খেলতে খেলতে শিখত ভাগাভাগি, সৌহার্দ্য, ঝগড়া মিটিয়ে বন্ধুত্ব ফিরিয়ে আনা কিন্তু এখন বদ্ধ দেয়ালের ভেতর এবং পর্দা-ভরা পৃথিবীতে তাদের সেই শেখার জায়গা নেই। ফলে বেড়ে উঠছে এক ধরনের একাকীত্ব আর সীমিত যোগাযোগের অভ্যাস। একসময় যে গ্রামে সামাজিক বন্ধন ছিল সবচেয়ে শক্ত, আজ সেই গ্রামেই দেখা দিচ্ছে সম্পর্কের দূরত্ব।
গ্রামের সাংস্কৃতিক আচার-অনুষ্ঠানেও উঠোন হারানোর প্রভাব দেখা যায়।
বৈশাখে পান্তা-ইলিশ, ঈদের দিন নতুন কাপড় পরে সবার আড্ডা, শীতের সকালে খেজুর রস এসবই একসময় উঠোনকেন্দ্রিক ছিল। এখন এসব আয়োজন ঘরের ভেতর সীমাবদ্ধ হচ্ছে, ফলে উৎসবের সামগ্রিকতা, মিলনমেলার ব্যাপ্তি কমে যাচ্ছে। সমাজবিজ্ঞানীরা মনে করেন, উঠোন ছিল গ্রামীণ জীবনের একটি মনস্তাত্ত্বিক নিরাপত্তাস্থল যেখানে মানুষ নিজের অনুভূতি প্রকাশ করতে পারত। উঠোন না থাকায় মানুষ সেই স্বতঃস্ফূর্ততা হারাচ্ছে।
তবে এই পরিবর্তন পুরোপুরি নেতিবাচক নয়, গৃহনির্মাণে আধুনিকতা এসেছে, নিরাপত্তা বৃদ্ধি পেয়েছে, জীবনমানও উন্নত হয়েছে। কিন্তু পরিবর্তনের সেই সর্বগ্রাসী ঢেউয়ে হারিয়ে যাচ্ছে গ্রামের সেই উষ্ণ, আন্তরিক, খোলা-হাওয়া জীবন। যে উঠোনে সন্ধ্যার আলোয় গৃহস্থালির গন্ধ ছড়িয়ে থাকত, যেখানে একসঙ্গে বসেই ভাগাভাগি করা হতো জীবন সেই উঠোন আজ স্মৃতি হয়ে যাচ্ছে অনেক পরিবারের কাছে।
সময়ের পরিবর্তন থামানো সম্ভব নয়, কিন্তু তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদের সম্পর্কগুলো টিকিয়ে রাখার চেষ্টা জরুরি।
উঠোন না থাকলেও আমরা চাইলে ঘরের ভেতরেই তৈরি করতে পারি মিলনমেলা একসঙ্গে বসার জায়গা, পারিবারিক কথা বলার সময়, প্রতিবেশীর খোঁজ নেওয়ার অভ্যাস। প্রযুক্তি আর আধুনিকতার ভিড়ে হারিয়ে যাওয়া উঠোন হয়তো আর ফিরবে না, কিন্তু তার যে মানবিক বন্ধন, সেই আন্তরিকতার সংস্কৃতি ফিরে আনা অবশ্যই সম্ভব যদি আমরা চাই।
তহমিনা ইয়াসমিন
শিক্ষার্থী, নৃবিজ্ঞান বিভাগ
