নদী-নালা ভরাটে নগর পরিকল্পনার ব্যর্থতা
তহমিনা ইয়াসমিন
প্রকাশ : ০৬ ডিসেম্বর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
দেশের নগরায়ণ আজ এমন এক মোড়ে এসে দাঁড়িয়েছে, যেখানে উন্নয়নের নামে প্রকৃতিকে ধ্বংস করার চর্চাই যেন নিত্যদিনের বাস্তবতা হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে নদী, খাল, নালা ও জলাধার ভরাট করে শহর বিস্তৃত করার প্রবণতা এখন নগর পরিকল্পনার সবচেয়ে ভয়াবহ সংকটগুলোর একটি। বহু বছর ধরে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি কিংবা অসচেতন নাগরিক সকলের যৌথ উদাসীনতা আজকের এই বিপর্যস্ত নগর চিত্রের জন্য দায়ী। অথচ এসব নদী-নালা শুধু পানি নিষ্কাশনের পথ নয়, এগুলোই ছিল শহরের স্বাভাবিক বেঁচে থাকার শর্ত, পরিবেশগত ভারসাম্যের প্রধান ভিত্তি।
ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা কিংবা সিলেট দেশের প্রায় সব বড় শহরেই একই চিত্র। এক সময় যে নদী বা খালগুলো শহরের শ্বাস-প্রশ্বাসের পথ ছিল, সেগুলো এখন কংক্রিটে ঠাসা জলাবদ্ধতার ‘মৃত পথ’ হয়ে গেছে। পরিকল্পনার নামে যেসব মাস্টারপ্ল্যান তৈরি হয়েছিল, তার বেশিরভাগই বাস্তবায়নের আগেই সংশোধন, পরিবর্তন বা উপেক্ষার শিকার হয়েছে। নদী-নালার অস্তিত্ব নিশ্চিত করার বদলে অনেক ক্ষেত্রেই উন্নয়ন প্রকল্পগুলো সেগুলোর ওপরেই দাঁড়িয়ে গেছে। এ যেন নিজের শ্বাসকষ্ট নিজেই তৈরি করে নেওয়ার মতো এক আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত।
ফলে বর্ষা এলেই বড় শহরগুলোতে একই দৃশ্য ঘণ্টার বৃষ্টি মানেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা জলাবদ্ধতা। দোকানপাট, বাসাবাড়ি, অফিস, রাস্তা সবকিছুই পানির নিচে চলে যায়। মানুষের ভোগান্তি, যানজট, অর্থনৈতিক ক্ষতি সবই যেন এক অনিবার্য দুর্ভোগ। অথচ সক্ষম খাল, নালা ও নদী থাকলে এই জলাবদ্ধতা কখনোই এমন ভয়াবহ রূপ নিত না। পানি তার স্বাভাবিক পথ পেলে শহর কখনোই ডুবত না। কিন্তু সেই পথই আমরা বছরের পর বছর ভরাট করে বন্ধ করে দিয়েছি।
নগর বিশেষজ্ঞদের মতে, নদী-নালা ভরাট শুধু পরিবেশগত নয়, প্রশাসনিক ব্যর্থতারও প্রতীক। জলাধার রক্ষার আইন রয়েছে, মাস্টারপ্ল্যান রয়েছে, আদালতের নির্দেশনাও রয়েছে কিন্তু বাস্তবায়নের শক্তি নেই। ভরাটকারীদের বিরুদ্ধে বড় কোনো পদক্ষেপ নেই বললেই চলে। কখনো অভিযান চলে, কিন্তু তা স্থায়ী বা কার্যকর হয় না। আবার সরকারি সংস্থাগুলোর মধ্যেও সমন্বয়ের অভাব প্রকট; এক সংস্থার অনুমোদন অন্য সংস্থার নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়ে দাঁড়ায়। ফলে পরিকল্পনা বিশৃঙ্খল হয়ে পড়ে এবং যে অযোগ্য নগর বিন্যাস তৈরি হয় তা দীর্ঘমেয়াদে পরিবেশকে বিপর্যস্ত করার পাশাপাশি মানুষকে ভোগান্তির চক্রে বন্দি করে।
অন্যদিকে, নগরের তাপমাত্রা বৃদ্ধির পেছনেও নদী-নালা ভরাটের বড় ভূমিকা আছে। জলাধার কমে যাওয়ায় শহরগুলো ‘হিট আইল্যান্ড’-এ পরিণত হচ্ছে। বাতাস চলাচল ব্যাহত হচ্ছে, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর দ্রুত নামছে। অনেক এলাকায় নদী বা খালের জায়গায় গড়ে উঠা স্থাপনা বর্ষাকালে আবার নিজেরাই ডুবে যায়। এ যেন প্রকৃতির প্রতিশোধ নয়, বরং মানুষের নিজেদের সিদ্ধান্তের ফল।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখনও সময় আছে। নদী-খাল দখলমুক্ত করে পুনরুদ্ধারের উদ্যোগ জোরদার করা গেলে পরিস্থিতি পাল্টাতে পারে। সেই সঙ্গে ভবিষ্যৎ নগর পরিকল্পনায় জলাধার সংরক্ষণকে বাধ্যতামূলক করা, ভরাটকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করা এবং প্রকৃতিনির্ভর নগর উন্নয়নকে অগ্রাধিকার দেওয়াই এখন জরুরি। কারণ নগর শুধু কংক্রিট আর রাস্তার সমষ্টি নয় এটি প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সহাবস্থানের জায়গা। নদী-নালা ছাড়া নগর কখনোই টেকসই হতে পারে না।
নদী-নালা ভরাটের এই দীর্ঘস্থায়ী ব্যর্থতা তাই শুধু পরিবেশের ক্ষতি নয়; এটি নগর প্রশাসন, নীতি নির্ধারণ এবং দায়িত্ববোধেরও এক নির্মম ব্যর্থতার প্রতিচ্ছবি। উন্নয়নকে কাগজে-কলমে যতই টেকসই বলা হোক না কেন, বাস্তবে এসব পরিকল্পনা যখন প্রকৃতির মৌলিক কাঠামো ভেঙে তৈরি হয়, তখন তা মানুষের জীবনকে আরো অনিরাপদ করে তোলে। জলাধার নষ্ট হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শহরের ভবিষ্যতও সংকুচিত হয় কারণ একটি নগর তার জলপথ হারালে সে তার স্বাভাবিক শ্বাস-প্রশ্বাস, অর্থনৈতিক গতি এবং পরিবেশগত নিরাপত্তা সবই ধীরে ধীরে হারায়। এখন জরুরি হলো দখলদারিত্বমুক্ত প্রকৃতির পথ ফিরে পাওয়া। খাল পুনরুদ্ধার, নদী খনন, নালা-ড্রেনেজ সমন্বয় ও জলাধার সংরক্ষণকে আইনগতভাবে কঠোরভাবে বাধ্যতামূলক করা ছাড়া বিকল্প নেই। পাশাপাশি নগর পরিকল্পনা যেন কাগজে আটকে না থাকে তার বাস্তব প্রয়োগ নিশ্চিত করতে প্রশাসনিক সমন্বয়, রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও জনসচেতনতা সবই একসঙ্গে কাজ করতে হবে। উন্নয়নের প্রয়োজনে নদী-নালা ভরাট করার যে সংস্কৃতি বহু বছর ধরে চলছে তা বন্ধ না হলে ভবিষ্যতের নগরায়ণ শুধু ভঙ্গুরই নয়, বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে।
নগর উন্নয়ন নিয়ে যতই কথা বলা হোক না কেন, একটি সত্য স্পষ্ট নদী-নালা ছাড়া কোনো নগরই টেকসই হতে পারে না। প্রকৃতিকে বাঁচানো মানেই শহরের ভবিষ্যতকে বাঁচানো। এই উপলব্ধি থেকে পরিকল্পনাকারী, সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থা, নাগরিক সমাজ সবাইকে একই সুরে বলতে হবে: নদী-নালা রক্ষা শুধু পরিবেশের দায়িত্ব নয়, এটি আমাদের অস্তিত্বের লড়াইও। যদি এখনই সঠিক সিদ্ধান্তে না ফিরি, তবে নগরের ভরাট জলপথ একসময় আমাদেরই উন্নয়নের স্বপ্নকে ডুবিয়ে দেবে। ভবিষ্যতের শহর বাঁচাতে হলে আজই নদী-নালার স্বাভাবিক প্রবাহকে ফিরিয়ে দিতে হবে, এটাই সময়ের সবচেয়ে বড় ও জরুরি দাবি।
তহমিনা ইয়াসমিন
নৃবিজ্ঞান বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
