বিনোদন সংস্কৃতিতে মাদকের আধিপত্য

আরিফুল ইসলাম রাফি

প্রকাশ : ০৭ ডিসেম্বর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

আধুনিক পৃথিবীর বিনোদন সংস্কৃতি আজ শুধু আর আনন্দের উৎস নয়; এটি সমাজের মানসিক গঠন, মানুষের চিন্তাভাবনা এবং তরুণদের জীবনযাত্রাকে নতুনভাবে প্রভাবিত করে এমন এক বিশাল শক্তি। বিনোদন আসে গান, সিনেমা, নাটক, ওয়েব সিরিজ, রিয়েলিটি শো, ফ্যাশন ইভেন্ট, ক্লাব কালচার, ডিজিটাল কনটেন্ট অসংখ্য রূপে, অসংখ্য প্রকাশে। মানুষ ক্লান্তি ভুলতে এই বিনোদনের কাছে আসে, নিজের জীবন থেকে পালিয়ে নতুন দিগন্তের স্বাদ নিতে আসে, আবার জীবনের প্রতিচ্ছবি দেখতেও আসে। কিন্তু এই অপার আলোর নিচে, রঙিন গ্ল্যামারের আড়ালে জমে আছে এক গভীর অন্ধকার, যার নাম মাদকের আধিপত্য। এটি এতটাই প্রবল যে বিনোদন শিল্পের প্রায় প্রতিটি কোণে আজ তার ছায়া দেখা যায়; কখনও প্রকাশ্যে, কখনও সরাসরি চোখের সামনে, আবার কখনও আড়ালের অচেনা ঘূণির মতো।

বিনোদনের ইতিহাসে মাদকের উপস্থিতি নতুন নয়। বিংশ-শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকেই পাশ্চাত্যের সংগীতাঙ্গনে জ্যাজ শিল্পীদের মধ্যে মাদক ব্যবহার ছিল পরিচিত বিষয়। পরে রকস্টার, হিপ-হপ আর র‍্যাপারদের জীবনযাত্রা যেন মাদক ছাড়া কল্পনাই করা যেত না। আমাদের উপমহাদেশেও চলচ্চিত্রের সোনালি যুগে নায়ক-নায়িকাদের ব্যক্তিগত জীবনে নানা ধরনের নেশা চুপিসারে অবস্থান করত। তবে তখন বিষয়গুলো ছিল আড়ালনির্ভর, গোপন, ইঙ্গিতমূলক। এখনকার যুগে সোশ্যাল মিডিয়া, ডিজিটাল নথি আর টিভি সংবাদ প্রত্যেকটি ঘটনাকে জনসমক্ষে এনে ফেলে। ফলে শিল্পীদের নেশা, পার্টি, ব্যক্তিগত আসক্তি- সব খবরই মানুষের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে এবং সেই আগ্রহ আবার মাদককে আরও আলোচনার জগতে নিয়ে আসে।

বিনোদনশিল্পে মাদকের আধিপত্য সবচেয়ে স্পষ্ট হয়, যখন আমরা দেখি গান, সিনেমা, ভিডিও কনটেন্ট বা বিজ্ঞাপনগুলোর ভিজ্যুয়ালে মাদককে কেমন করে রঙিন, আকর্ষণীয় এমনকি অনুকরণযোগ্য হিসেবে তুলে ধরা হয়। গানের লিরিকে ‘হাই’ হওয়ার আনন্দ, ক্লাব পার্টিতে ড্রিংক আর স্মোকের স্বাধীনতা, বন্ধুদের সঙ্গে রাতজাগা নেশাসেশনে ‘কুল’ জীবনযাত্রা, সবকিছুই যেন এক ধরনের রোমান্টিকতা পায়। সিনেমায় নায়ককে দেখানো হয় সিগারেট হাতে গভীর ভাবনায় ডুবে থাকা একাকী যোদ্ধা হিসেবে, আর অ্যালকোহলকে দেখানো হয় ব্যথা ভুলিয়ে দেওয়ার সহজ পথ হিসেবে। ওয়েব সিরিজে দেখানো হয়- একটি রাত, একটি পার্টি, এক চুমুক, এক টান আর সবকিছু বদলে যায়। এই ভিজ্যুয়ালাইজেশনে ব্যবহৃত রঙ, স্লো-মোশন শট, ব্যাকগ্রাউন্ড সাউন্ড, ক্যামেরার মুভমেন্ট- সব কিছুই এমনভাবে তৈরি করা হয়, যেন দর্শক মাদককে কোনো ক্ষতিকর জিনিস নয়, বরং একটি অভিজ্ঞতা হিসেবে দেখে। এই গ্ল্যামারাইজেশনের মধ্যেই বিপদের মূল।

সেলিব্রেটি কালচারে মাদকের প্রভাব আরও গভীর। তরুণরা তারকাদের দেখে, শুনে, অনুভব করে এবং তাদের অনুকরণ করতে চায়। তারকা যদি একটি নতুন পোশাক পরেন, পরের দিনই তা বাজারে জনপ্রিয় হয়। সে যদি নতুন গান শোনে, পরের দিন প্লেলিস্টে তা চেপে বসে। একইভাবে যখন কোনো শিল্পী লাইভ ভিডিওতে সিগারেট হাতে আসে, পার্টির ছবি পোস্ট করে বা মাদক নিয়ে অস্পষ্ট হাসি দিয়ে কথা বলে, তখন অনেক তরুণ মনে করে এই আচরণ যেন স্বাভাবিক। সেলিব্রেটিরা হয়তো নিজেদের দুর্বলতা প্রকাশ করতে চান না বরং নিজেদের জীবনের চাপ, ব্যর্থতা, নিঃসঙ্গতা, অনিশ্চয়তা থেকে বের হতে চেষ্টা করেন নেশার মাধ্যমে; কিন্তু তরুণরা সেই মাদককে দেখে শুধু বাহ্যিক উত্তেজনা, আনন্দ আর স্টাইলকে শেখে। এই ভুল অনুকরণই মাদকের আধিপত্যকে সবচেয়ে দ্রুত ছড়িয়ে দেয়।

শিল্পীদের জীবনে মাদক কেন এত সহজে ঢুকে পড়ে তারও কারণ আছে। প্রথমত, বিনোদন শিল্পে কাজের চাপ অস্বাভাবিকভাবে বেশি। ক্যামেরার সামনে হাসি থাকলেও, অন্তরে থাকে অস্থিরতা, অনিদ্রা, প্রত্যাশার চাপ, ব্যর্থতার ভয়।

প্রতিদিন নতুন থাকে শরীরচর্চা, ডায়েট, সাজসজ্জা, ইমেজ ম্যানেজমেন্ট, ফলোয়ার ধরে রাখা, ট্রল ও সমালোচনার মুখোমুখি হওয়া। এই অবিরাম চাপ বহুশিল্পীকে মানসিকভাবে দুর্বল করে দেয় এবং তারা নেশাকে হয় বিশ্রামের মাধ্যম হিসেবে, নয় স্ট্রেস কমানোর উপায় হিসেবে ব্যবহার করেন।

দ্বিতীয়ত, রাতজাগা শুটিং, ভোরে রিহার্সাল, এক দিনে তিনটা ইভেন্ট। এই অনিয়মিত সময়সূচি শরীরকে এতটাই পীড়িত করে যে কেউ কেউ ক্লান্তি দূর করতে উত্তেজক পদার্থ ব্যবহার করেন। তৃতীয়ত, বিনোদন শিল্পে নেটওয়ার্কিং খুব গুরুত্বপূর্ণ। বড় পরিচালক, প্রযোজক, মিউজিক লেবেল, ব্র্যান্ড- সবাইকে সন্তুষ্ট রাখতে হয়। এই সম্পর্ক তৈরির প্রধান জায়গা হলো ক্লাব, বার এবং প্রাইভেট পার্টি। সেখানে মাদক সহজেই ঘুরে বেড়ায় এবং অনেকে আবর্তনের মধ্যে ঢুকে পড়ে।

মাদককে সৃজনশীলতার উৎস মনে করার ভুল ধারণাও প্রচলিত। অনেক শিল্পী মনে করেন নেশা তাদের মন খুলে দেয়, কল্পনাশক্তি বাড়ায়, শিল্পে নতুনমাত্রা আনে। যদিও বাস্তবে মাদক শুধু শারীরিক ক্ষতিই করে না, মনকেও বিভ্রান্ত করে, আত্মবিশ্বাস নষ্ট করে এবং দীর্ঘমেয়াদে সৃষ্টিশীলতাকে ধ্বংস করে।

বিনোদন জগতে মাদকের এই আধিপত্য তরুণদের ওপর ভয়াবহ সামাজিক প্রভাব ফেলছে। যেকোনো ট্রেন্ড তরুণরা প্রথমে গ্রহণ করে, কারণ তারা কৌতূহলী, অনুসন্ধিৎসু এবং আত্মপরিচয় খুঁজে বেড়ায়। যখন তারা দেখে তাদের প্রিয় তারকা মাদক নিয়ে পার্টি করছে, যখন তারা গানের লিরিকে নেশাকে রোমান্টিক রূপে দেখে, যখন তারা সিনেমার নায়ককে সিগারেট হাতে হিরোইক শটে দেখে; তখন তারা মনে করে, এই জিনিসগুলো হয়তো স্বাভাবিক, এমনকি প্রয়োজনীয়। ক্যাম্পাসে বন্ধুদের চাপ, নতুন কিছু চেষ্টা করার প্রবণতা, নিজেকে সাহসী দেখানোর ইচ্ছা- এসব তাদের আরও মাদকের দিকে ঠেলে দেয়। আবার অনেক তরুণ মানসিকভাবে একা থাকে, কেউ বোঝে না বলে মনে করে কিংবা নিজেদের অর্জনকে ছোট মনে করে; সেই জায়গায় তারা সাময়িক সুখ খুঁজে পেতে নেশার আশ্রয় নেয়।

কিন্তু বিনোদন শিল্পের এই নেশা-সংস্কৃতির প্রভাব শুধু ব্যক্তিগত পর্যায়ে আটকে থাকে না; সমাজের ওপর এটি বিশাল নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। মাদক ব্যবসা বাড়ে, চোরাচালান বাড়ে, অপরাধ বাড়ে। পরিবার ভেঙে পড়ে, সন্তানরা মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, আর্থিক সমস্যা তৈরি হয়। সমাজে মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটে। যেসব আচরণ একসময় লজ্জাজনক বা অনুচিত মনে করা হতো, এখন সেগুলো ‘স্টাইল’ হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা পেতে থাকে। তরুণ প্রজন্ম ধীরে ধীরে অস্থির, বেপরোয়া এবং বাস্তবতাবর্জিত সিদ্ধান্ত নিতে থাকে।

মিডিয়ার ভূমিকা এখানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অনেক সময় মিডিয়া মাদক সম্পর্কিত সংবাদকে এমনভাবে প্রচার করে, যেন তা একটি উত্তেজনাপূর্ণ বড় ঘটনা। কারা গ্রেপ্তার হলো, কোন তারকা কী ব্যবহার করছিল, কোন ক্লাবে কী ঘটেছে; এসব খবর বারবার দেখানো হয়। এতে মানুষ ঘটনাটিকে ভয়ংকর মনে না করে বরং কৌতূহল নিয়ে দেখতে শুরু করে। মিডিয়া যদি মাদকবিরোধী সচেতনতা তৈরিতে মনোযোগী হত, যদি ইতিবাচক উদাহরণ দেখাত তাহলে পরিস্থিতি পরিবর্তন হতে পারত।

রাষ্ট্রীয় পর্যায়েও সমস্যা রয়েছে। মাদকচক্র ভাঙতে সরকার বিভিন্ন অভিযান চালালেও বিনোদনশিল্পে এটি সবচেয়ে বেশি গোপনে চলে বলে অনেক ক্ষেত্রেই আইনি নজরদারি দুর্বল হয়ে পড়ে। প্রয়োজন কঠোরতা, প্রমাণ সংগ্রহে পেশাদার দক্ষতা, ক্লাব-বার ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা এবং আইন প্রয়োগে নিরপেক্ষতা।

সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো, সমাধান কোথায়? সমাধান প্রথমেই সচেতনতায়। স্কুল-কলেজে মাদকবিরোধী কার্যক্রম পরিচালনা করা জরুরি, যাতে তরুণরা শুরু থেকেই বুঝতে পারে মাদক কোনো অভিজাততা নয় বরং এক ধরনের ফাঁদ। শিল্পী, তারকা এবং প্রভাবশালী ব্যক্তিরাও এই সচেতনতায় অংশ নিতে পারেন। দ্বিতীয়ত, নেশাগ্রস্ত মানুষকে অপরাধী নয়, রোগী হিসেবে দেখতে হবে। তাদের রিহ্যাবের সুযোগ বাড়াতে হবে, মানসিক স্বাস্থ্যসেবা সহজ করতে হবে। পরিবারকে সন্তানের সঙ্গে আরও সময় কাটাতে হবে, কথা বলতে হবে, তাদের মানসিক অবস্থা বুঝতে হবে। তৃতীয়ত, বিনোদন মাধ্যমকে দায়িত্বশীল হতে হবে। সিনেমা বা গানে মাদক দেখানো হলে সেটিকে রোমান্টিকভাবে নয় বরং সতর্কভাবে উপস্থাপন করতে হবে এবং সর্বোপরি সমাজে বিকল্প বিনোদন; খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, বই, আলোচনাচক্র- এসবের প্রতি আগ্রহ বাড়াতে হবে।

বিনোদন জগত উজ্জ্বল, আকর্ষণীয়, প্রভাবশালী- এ কথা সত্য। কিন্তু সেই আলো যদি মাদক নামের অন্ধকারে কালো হয়ে যায়, তবে সমাজের ভবিষ্যৎও অন্ধকারে ডুবে যাবে। মাদক কখনো স্বাধীনতা নয়; এটি এমন এক শৃঙ্খল যা ধীরে ধীরে মানুষকে বন্দি করে ফেলে। নেশা কখনও সৃষ্টিশীলতা বাড়ায় না; বরং তা ভেঙে দেয় মানুষকে ভেতর থেকে। আজ প্রয়োজন সবাই মিলে একসঙ্গে দাঁড়ানো; শিল্পী, দর্শক, পরিবার, রাষ্ট্র- একে অপরের পাশে দাঁড়িয়ে বলা যে আমরা বিনোদন চাই; কিন্তু সেই বিনোদনগুলো হোক আলোয় ভরা, মানবিক, দায়িত্বশীল এবং সুস্থ সংস্কৃতির বাহক। মাদকের আধিপত্য ভাঙা কঠিন হলেও অসম্ভব নয়; সচেতনতার আলো জ্বালালে অন্ধকারের গহ্বর ভেদ করেই নতুন বিনোদন সংস্কৃতি জন্ম নেবে- যেখানে হাসি থাকবে, কিন্তু নেশা থাকবে না; আনন্দ থাকবে, কিন্তু ধ্বংস থাকবে না; থাকবে শুধু মানুষের সৃজনশীলতা, সুস্থতা এবং ভবিষ্যতের জন্য এক নতুন পথ।

আরিফুল ইসলাম রাফি

গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ