মানবাধিকার আমাদের প্রতিদিনের অপরিহার্য বিষয়
কৃষিবিদ ড. মো. আল-মামুন
প্রকাশ : ১০ ডিসেম্বর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

মানুষের জীবন অসংখ্য ছোট-বড় প্রয়োজনের সমষ্টি- কিছু দৃশ্যমান, কিছু অদৃশ্য; কিছু বস্তুগত, কিছু মানসিক, বৌদ্ধিক ও নৈতিক শক্তির সঙ্গে সম্পর্কিত। প্রতিদিনের সিদ্ধান্তগুলোর মধ্যে লুকিয়ে থাকে জীবন গড়ার উপাদান। তবু খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান ও চিকিৎসার মতো মৌলিক চাহিদার দৌড়ে আমরা প্রায়ই অদৃশ্য প্রয়োজনগুলো ভুলে যাই, যা মন, বুদ্ধি, মূল্যবোধ ও সম্পর্ককে জীবিত রাখে। এগুলো উপেক্ষা করলে, বাইরের সাফল্য থাকলেও ভেতরে মানুষ অসম্পূর্ণ থেকে যায়।
আজ ১০ ডিসেম্বর, বিশ্ব মানবাধিকার দিবস। ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘ মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাপত্র গ্রহণের পর থেকে দিনটি পালিত হচ্ছে। এ বছরের প্রতিপাদ্য: ‘মানবাধিকার, আমাদের প্রতিদিনের অপরিহার্য বিষয়’। মানবাধিকার কোনো বিমূর্ত ধারণা নয়; এটি প্রতিদিনের জীবনের অপরিহার্য অংশ। সম্মান, সমতা, স্বাধীনতা, নিরাপত্তা ও ন্যায় এগুলোই মানবিক সমাজের ভিত্তি।
বিশ্ব দ্রুত বদলে যাচ্ছে। প্রযুক্তির অগ্রগতির গতি এত দ্রুত যে কয়েক বছরের ব্যবধানে একসময়ের দক্ষতা অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে। অনলাইন কর্মসংস্থান থেকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সবই মানুষের জীবনযাপন, শেখার ধরন, কাজের কাঠামো বদলে দিয়েছে। এ সময়ে প্রয়োজন শুধু ডিগ্রি নয়; প্রয়োজন কার্যকর দক্ষতাণ্ডসমস্যা সমাধান, তথ্য বিশ্লেষণ, যৌক্তিক চিন্তা, প্রযুক্তি ব্যবহার, আর্থিক সচেতনতা, দলগত দক্ষতা ও ভাষাজ্ঞান। প্রতিদিন ছোট করে হলেও কিছু শেখা একজন মানুষকে ধীরে ধীরে এগিয়ে নিয়ে যায়।
আধুনিক জীবনের চাপ মানুষের মানসিক সুস্থতাকে প্রভাবিত করছে। যানজট, কর্মক্ষেত্রের প্রতিযোগিতা, অনিশ্চিত কর্মসংস্থান ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অতিরিক্ত প্রভাবের ফলে অনেকেই মানসিক ক্লান্তি ও অস্থিরতায় ভোগছেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিজেকে সময় দেওয়া, পরিবার ও প্রকৃতির সঙ্গে সময় কাটানো, বই পড়া, সৃষ্টিশীল কাজে যুক্ত থাকা এবং নিয়মিত প্রার্থনা ও কৃতজ্ঞতা চর্চা মানসিক ভারসাম্য বজায় রাখতে সহায়ক। পর্যাপ্ত ঘুম ও বিশ্রামও জরুরি। তাদের পরামর্শ, দৈনন্দিন জীবনে সচেতনভাবে বিরতি নিয়ে নিজেকে শোনা ও জীবনের গতি নিয়ন্ত্রণে আনা মানসিক সমস্যার প্রতিরোধে কার্যকর। নিজেকে অবহেলা করলে ধীরে ধীরে আনন্দ, উদ্যম, সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা সবই দুর্বল হয়ে পড়ে।
সময় ব্যবস্থাপনা জীবনের অন্যতম অদৃশ্য শক্তি। প্রতিটি মানুষের দিনই ২৪ ঘণ্টা, কিন্তু ব্যবহারের পার্থক্যই জীবনের সাফল্য-ব্যর্থতা নির্ধারণ করে। ডিজিটাল যুগে মনোযোগ সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ। অনেকেই সারাদিন ব্যস্ত থেকেও উৎপাদনশীল হতে পারেন না। তাই দিনের শুরুতে ৫-১০ মিনিটের পরিকল্পনা, কাজের অগ্রাধিকার নির্ধারণ ও দিনের শেষে ছোট সেলিব্রেশন সবই জীবনকে সুশৃঙ্খল করে। পরিকল্পনাহীন জীবন পাহাড়বিহীন নদীর মতো-দিক হারায়, গতি কমে, লক্ষ্য হারিয়ে যায়।
মানুষ সমাজবদ্ধ প্রাণী। সহমর্মিতা, সদাচরণ, সহযোগিতা এসব মানুষের মৌলিক সামাজিক প্রয়োজন। একজন মানুষ যখন অন্যের পাশে দাঁড়ায়, তখন সে নিজের ভেতরেও শক্তি, শান্তি ও তৃপ্তি খুঁজে পায়। হাসিমুখে কথা বলা, কৃতজ্ঞতা প্রকাশ, কারও কষ্ট মন দিয়ে শোনা, নীরব সহায়তা এসব ছোট আচরণ সমাজকে মানবিক করে তোলে। প্রযুক্তির অগ্রগতির যুগেও মানবিকতা ছাড়া উন্নয়ন কখনোই পূর্ণতা পায় না।
প্রযুক্তি শুধু ব্যবহারের বিষয় নয়, এটি বুদ্ধিমত্তাপূর্ণ ব্যবহারের ব্যাপার। ডিজিটাল নিরাপত্তা, ই-সেবা, অনলাইন ব্যাংকিং, ডেটা ব্যবস্থাপনা, ক্লাউড সিস্টেম, ইমেইল এটিকেট, সাইবার নিরাপত্তাজ্ঞান এসব হলো আজকের যুগের প্রয়োজনীয় দক্ষতা। কারণ প্রযুক্তি সুবিধা দিচ্ছে ঠিকই, পাশাপাশি প্রতারণা, ভুল তথ্য, জালিয়াতি, হ্যাকিংয়ের ঝুঁকিও বাড়ছে। তাই প্রতিদিন কিছু নতুন শেখা মানুষকে প্রযুক্তিতে দক্ষ ও নিরাপদ করে।
স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন আজ বিলাসিতা নয়, প্রয়োজন। শরীর ভালো থাকলে মন ভালো থাকে, কাজের গতি বাড়ে, সিদ্ধান্ত গ্রহণ শক্তিশালী হয় এবং জীবনের প্রতি ইতিবাচকতা তৈরি হয়। স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন মানসিক ও শারীরিক শক্তির ভিত্তি। সুষম খাদ্য, পর্যাপ্ত পানি, নিয়মিত হাঁটা, ব্যায়াম, সময়মতো ঘুম এসব অভ্যাস জীবনের গুণগত মান বাড়ায়। প্রতিদিনের ৩০ মিনিট হাঁটা হৃদয়, মন ও শরীর সবকিছুর জন্যই উপকারী। শরীর প্রতিদিন আমাদের সেবা করে তাই শরীরের প্রতি দায়িত্বশীল হওয়া অপরিহার্য।
আয় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে খরচ বাড়ে- চাই তা অপ্রয়োজনীয় হোক বা আবেগের বশবর্তী। তাই অর্থ ব্যবস্থাপনা শেখা অত্যন্ত জরুরি। আর্থিক সচেতনতা একটি পরিবারকে স্থিতিশীল রাখার অন্যতম ভিত্তি। আয় বাড়লে খরচ বাড়ে কিন্তু প্রতিটি খরচ প্রয়োজনীয় নয়। বাজেট তৈরি, খরচের হিসাব রাখা, সঞ্চয়, বিনিয়োগ, ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা, জরুরি তহবিল এসব অভ্যাস একটি পরিবারকে সংকটের সময় রক্ষা করে। আর্থিক শিক্ষার অভাবে ভুল সিদ্ধান্ত, অপ্রয়োজনীয় ঋণ, অনিয়ন্ত্রিত খরচ ও ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তা জন্ম নেয়। অর্থোপার্জন দক্ষতা; কিন্তু অর্থ ব্যবস্থাপনা জ্ঞান।
পরিবার, কর্মক্ষেত্র ও সমাজ সর্বত্র প্রয়োজন যোগাযোগ দক্ষতা। ভদ্রতা, মনোযোগ দিয়ে শোনা, যুক্তিসংগত মতপ্রকাশ, দ্বন্দ্ব সমাধান এসব দক্ষতা মানুষকে কর্মে ও সম্পর্কে সফল করে তোলে। উন্নতির পথ সম্পর্ক দিয়েই শুরু হয়, আর সম্পর্ক শুরু হয় যোগাযোগ দিয়ে।
জীবনে লক্ষ্য নির্ধারণও একটি মৌলিক প্রয়োজন। ব্যস্ততার চাপে অনেকেই নিজের স্বপ্ন ভুলে যায়। মানুষ চেষ্টা করে, দৌড়ায়, পরিশ্রম করে; কিন্তু যায় কোথায়? কোন উদ্দেশ্যে? অনেকেই জানে না। অথচ লক্ষ্য মানুষের জীবনের দিকনির্দেশনা। নিয়মিত নিজেকে প্রশ্ন করা জরুরি- আমি কোথায় যেতে চাই? আমি কে হতে চাই? আমি কীভাবে উন্নতি করতে পারি? লক্ষ্য থাকলে পরিশ্রমের মানে থাকে, সময়ের মূল্য বাড়ে এবং ভুল পথে এগোনোর সম্ভাবনা কমে।
আমাদের অস্তিত্বনির্ভর করে পরিবেশের ওপর- বাতাস, পানি, খাদ্য, বন, নদী সবই আমাদের জীবনের ভিত্তি। মানুষের অসচেতন ব্যবহারের কারণে প্রকৃতি আজ বিপর্যস্ত। প্লাস্টিক কম ব্যবহার, পানি সাশ্রয়, বর্জ্য পৃথকীকরণ, গাছ লাগানো- এসব ছোট অভ্যাসই পরিবেশকে বাঁচায়। প্রকৃতি রক্ষার প্রয়োজন এখন আর তাত্ত্বিক নয়- বাস্তব ও জরুরি। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে নিরাপদ পৃথিবী দিতে হলে আজ থেকেই দায়িত্ব নিতে হবে।
নিজের প্রতি সন্দেহ বহু সম্ভাবনাকে হত্যা করে। আত্মবিশ্বাস আসে প্রস্তুতি, ছোট অর্জন, ভুল থেকে শেখা ও নিয়মিত অনুশীলনের মাধ্যমে। একইভাবে সম্পর্কও যত্ন দাবি করে। পরিবার, বন্ধু, সন্তান সবার সঙ্গে সময় কাটানো মানবিক শক্তি বাড়ায়। সম্পর্ক যত্নে প্রস্ফুটিত হয়, অবহেলায় ভেঙে যায়।
একসময় মফস্বলের খেলাঘর, বিজ্ঞান ক্লাব, সাংস্কৃতিক সংগঠন শিশুর চরিত্র গঠনের প্রধান পাঠশালা ছিল। এখন প্রযুক্তি ও ব্যস্ততার কারণে এসব উদ্যোগ দুর্বল হয়ে পড়েছে। এটি ভবিষ্যতের জন্য উদ্বেগজনক। তাই এসব সংগঠনকে পুনরুজ্জীবিত করতে হবে- বিজ্ঞানচর্চা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, ক্রীড়া, সংগীত ও মানবিক মূল্যবোধের সমন্বয়ে শিশুদের জন্য স্বাস্থ্যকর পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে।
মহামনীষীরা বলেন, গতকালের চেয়ে আজ ভালো না হলে উন্নতি অসম্ভব। প্রতিদিন ৩০ মিনিট শেখা, সাপ্তাহিক লক্ষ্য নির্ধারণ, সকালের রুটিন, শরীরচর্চা, ছোট কাজ সঙ্গে সঙ্গে করা, ইতিবাচক মানুষের সঙ্গে সময় কাটানো, দিনে নির্দিষ্ট সময় ডিভাইসমুক্ত থাকা এসব ছোট অভ্যাসই দীর্ঘমেয়াদে বড় পরিবর্তন আনে।
দৈনন্দিন প্রয়োজন শুধু জীবনধারণের উপকরণ নয়; এটি একটি জীবনদর্শন। শেখা, সচেতনতা, মানবিকতা, স্বাস্থ্যকর অভ্যাস, প্রযুক্তিজ্ঞান, সময় ব্যবস্থাপনা, আর্থিক শৃঙ্খলা, পরিবেশরক্ষা এসব ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের উন্নতির ভিত্তি। প্রতিদিনের ছোট সিদ্ধান্তগুলোই ভবিষ্যতের বড় ফল তৈরি করে। প্রতিদিনই নতুন সুযোগ- নিজেকে উন্নত করার, ভালো সিদ্ধান্ত নেওয়ার এবং একটি মানবিক সমাজ গড়ার।
মানবিকতাই মানুষের প্রকৃত শক্তি। ধন-সম্পদ, পদবি, সাফল্য সবই মূল্যবান; তবে সততা, সহমর্মিতা ও মানবিকতার মূল্য তার চেয়েও অনেক বেশি। প্রতিদিনের ছোট মানবিক আচরণ সমাজকে এগিয়ে নেয়। প্রয়োজন শুধু বেঁচে থাকার নয়- মানুষ হয়ে ওঠার। আর সেই পথ শুরু হয় সবচেয়ে সহজ জায়গা থেকে- নিজের প্রয়োজনগুলো সঠিকভাবে বোঝা এবং প্রতিদিন তা পূরণের পথে সচেতনভাবে অগ্রসর হওয়া।
কৃষিবিদ ড. মো. আল-মামুন
প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট মানিক মিয়া এভিনিউ
