পরিবেশ রক্ষায় তরুণদের ভূমিকা
আরশী আক্তার সানী
প্রকাশ : ১২ ডিসেম্বর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

পৃথিবী আমাদের একমাত্র আবাসভূমি। মানুষ, প্রাণী, গাছপালা, সবাই মিলে এই বিশাল পরিবারের অংশ। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, আমরা নিজেরাই আমাদের পৃথিবীকে অসুস্থ করে তুলছি। বনভূমি উজাড়, নদী দখল, বায়ু দূষণ, প্লাস্টিকের বন্যা- সব মিলিয়ে প্রকৃতি যেন হাঁপিয়ে উঠেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এরইমধ্যে চোখে পড়ছে। তাপমাত্রা অস্বাভাবিকভাবে বাড়ছে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ততা বৃদ্ধি পেয়েছে, ফলে কৃষি উৎপাদন কমছে। আবার হঠাৎ করে বন্যা, অতিবৃষ্টি, ঘূর্ণিঝড়- এগুলো আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অংশ হয়ে গেছে।
এ অবস্থায় পরিবেশ রক্ষা এখন আর বিলাসিতা নয়, এটি বেঁচে থাকার প্রশ্ন। সরকার, নীতি-নির্ধারক, বিজ্ঞানী সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। তৃবে এই যুদ্ধে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখতে পারে তরুণ প্রজন্ম। কারণ তরুণরাই ভবিষ্যতের চালক, তাদের হাতেই তৈরি হবে আগামী দিনের পৃথিবী।
তরুণ প্রজন্মের গুরুত্ব : তরুণরা সমাজের সবচেয়ে শক্তিশালী অংশ। তারা উদ্যমী, সাহসী এবং পরিবর্তন আনতে আগ্রহী। ইতিহাস প্রমাণ করেছে, তরুণরা চাইলে যেকোনো বড় পরিবর্তন সম্ভব। ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, গণআন্দোলন সবক্ষেত্রেই তরুণদের অবদান ছিল অমূল্য।
আজকের তরুণরা প্রযুক্তি-সচেতন। তারা সোশ্যালমিডিয়ায় সক্রিয়, তারা নতুন কিছু শিখতে ও শিখাতে পারে। তাদের এই দক্ষতাকে কাজে লাগালে পরিবেশ রক্ষার আন্দোলন আরও কার্যকর হবে। তারা অনলাইন ক্যাম্পেইন চালাতে পারে, মানুষকে দ্রুত সচেতন করতে পারে এবং সরকারের ওপর চাপ তৈরি করতে পারে।
ছোট কাজ, বড় প্রভাব : পরিবেশ রক্ষা করার জন্য বড় বড় প্রকল্প দরকার হলেও, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো মানুষের জীবনধারায় ছোট পরিবর্তন আনা। একজন তরুণ তার নিজের জীবনেই কিছু সহজ কাজ শুরু করতে পারে।
প্লাস্টিক বর্জন : বাজারে গেলে কাপড় বা জুটের ব্যাগ নিয়ে যাওয়া। একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক বোতল বা চামচ ব্যবহার না করা।
গাছ লাগানো : বাড়ির আঙিনা, স্কুল-কলেজের মাঠে বা রাস্তার পাশে গাছ লাগানো। একটি গাছ একদিন অক্সিজেন দেবে, ছায়া দেবে, পাখির আশ্রয়স্থল হবে।
বিদ্যুৎ সাশ্রয় : অপ্রয়োজনীয়ভাবে লাইট, ফ্যান, চার্জার চালু না রাখা।
পানি সাশ্রয় : হাত ধোয়া বা দাঁত ব্রাশ করার সময় কল বন্ধ রাখা।
পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা : রাস্তার ময়লা ডাস্টবিনে ফেলা এবং অন্যদেরও সচেতন করা।
এই কাজগুলো এতটাই ছোট যে করতে বিশেষ কোনো কষ্ট হয় না। কিন্তু যখন হাজার হাজার তরুণ একসঙ্গে এসব কাজ শুরু করে, তখন শহর-গ্রাম অনেকটাই পরিষ্কার হয়ে যায়।
সচেতনতা তৈরি ও নেতৃত্ব : তরুণরা শুধু নিজেরাই কাজ করলে হবে না, তাদের অন্যদেরও সচেতন করতে হবে। আজকাল সোশ্যালমিডিয়া একটি বড় হাতিয়ার। একজন তরুণ যদি পরিবেশ নিয়ে একটি তথ্যবহুল পোস্ট করে, সেটি হাজার হাজার মানুষ দেখতে পারে।
উদাহরণস্বরূপ- বাংলাদেশের অনেক তরুণ এরইমধ্যে সমুদ্রসৈকত পরিষ্কার অভিযান শুরু করেছে। তারা সৈকতে ছুটির দিনে প্লাস্টিক পরিষ্কার করে, সেই ছবি সোশ্যালমিডিয়ায় শেয়ার করে। ফলে অন্যরা অনুপ্রাণিত হয়।
তরুণরা স্কুল-কলেজে পরিবেশ বিষয়ক সেমিনার, বিতর্ক প্রতিযোগিতা, সচেতনতা মিছিল আয়োজন করতে পারে। স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে মিলে পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা ক্যাম্পেইন করতে পারে। তারা স্থানীয় মানুষকে বোঝাতে পারে কেন গাছ কাটা উচিত নয়, নদীতে আবর্জনা ফেলা ঠিক নয়।
পরিবেশবান্ধব জীবনধারা : পরিবেশ রক্ষার জন্য তরুণদের নিজেদের জীবনধারায় পরিবর্তন আনা দরকার।
পরিবেশবান্ধব যাতায়াত : ছোট দূরত্বে হাঁটা বা সাইকেল ব্যবহার করা উচিত। এতে শরীর সুস্থ থাকবে এবং কার্বন নিঃসরণও কমবে।
স্থানীয় ও মৌসুমি খাবার : স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত খাবার খেলে পরিবহন খরচ কমে, দূষণও কমে।
পুনর্ব্যবহার (Recycle) : পুরোনো কাগজ, বোতল, কাপড় পুনর্ব্যবহার করতে হবে।
পরিবেশবান্ধব পণ্য : যেসব পণ্য সহজে পচে যায় বা পুনর্ব্যবহারযোগ্য, সেগুলো ব্যবহার করতে হবে। যদি তরুণরা এসব জীবনধারা গ্রহণ করে, অন্যরাও তাদের দেখে শিখবে। এভাবে সমাজে একটি নতুন সংস্কৃতি গড়ে উঠবে।
সামাজিক আন্দোলন : ইতিহাস সাক্ষী, বড় পরিবর্তন সবসময় এসেছে গণআন্দোলনের মাধ্যমে। পরিবেশ রক্ষার জন্যও তরুণদের নেতৃত্বে আন্দোলন প্রয়োজন। নদী দখলের বিরুদ্ধে মিছিল। বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি। সমুদ্রসৈকত বা পার্ক পরিষ্কার অভিযান। স্থানীয় প্রশাসনের কাছে দূষণ বন্ধের দাবি জানিয়ে স্মারকলিপি দেওয়া।
এই ধরনের আন্দোলন শুধু পরিবেশ রক্ষা করবে না, বরং মানুষের মধ্যে দায়িত্ববোধও তৈরি করবে।
প্রযুক্তির ব্যবহার : তরুণরা প্রযুক্তিতে দক্ষ। তারা চাইলে অ্যাপ তৈরি করতে পারে যেটি দিয়ে দূষণ শনাক্ত করা যায়। তারা অনলাইনে স্বাক্ষর সংগ্রহ করে প্রশাসনের ওপর চাপ দিতে পারে। তারা ড্রোন ব্যবহার করে বনভূমি পর্যবেক্ষণ করতে পারে।
উদাহরণস্বরূপ- ভারতে একদল তরুণ প্লাস্টিক বর্জ্য সংগ্রহ করে রিসাইকেল করে রাস্তা বানিয়েছে। বাংলাদেশের তরুণরা চাইলে একই রকম উদ্যোগ নিতে পারে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট : বাংলাদেশের পরিবেশ আজ বড় সংকটে। ঢাকার বায়ু মান বিশ্বে সবচেয়ে খারাপের মধ্যে। নদীগুলো দূষণে কালো হয়ে গেছে। বনভূমির পরিমাণও কমছে। উপকূলীয় এলাকায় ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস বেড়েছে।
এই পরিস্থিতিতে তরুণদের ভূমিকা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। তারা যদি এগিয়ে আসে, স্থানীয় পর্যায়ে সচেতনতা তৈরি করে, তাহলে অনেক সমস্যা কমে যাবে। বাংলাদেশের তরুণরা এরইমধ্যে বিভিন্ন এনজিও, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এবং অনলাইন প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে কাজ করছে। তাদের এই কাজকে আরও বড় পরিসরে নিয়ে যেতে হবে।
ভবিষ্যতের দায়িত্ব : পরিবেশ রক্ষা শুধু আজকের জন্য নয়, ভবিষ্যতের জন্যও জরুরি। আমরা যদি আজ কিছু না করি, আগামী প্রজন্ম একটি অসুস্থ পৃথিবী পাবে। তারা হয়তো নিরাপদ পানি পাবে না, বন্যা বা খরায় ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাই তরুণদের এখন থেকেই সচেতন হতে হবে। তাদের মনে রাখতে হবে, তাদের ছোট ছোট কাজ একদিন বড় পরিবর্তন আনবে।
পরিবেশ রক্ষা একটি চলমান প্রক্রিয়া। এখানে সরকারের পাশাপাশি জনগণ, বিশেষ করে তরুণদের ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তারা উদ্যমী, সাহসী এবং নতুন কিছু করার ক্ষমতা রাখে।
তাদের ছোট ছোট কাজ, গাছ লাগানো, সচেতনতা তৈরি, প্লাস্টিক বর্জন সবকিছু মিলে একদিন একটি বড় আন্দোলন তৈরি হবে। পৃথিবী আবার সবুজ হবে, নদী হবে নির্মল, বাতাস হবে পরিষ্কার।
আমাদের মনে রাখতে হবে, পরিবেশ বাঁচলে আমরাও বাঁচব। তাই তরুণদের এখনই এগিয়ে আসতে হবে, হাতে হাত রেখে ভবিষ্যৎকে রক্ষা করতে হবে।
আরশী আক্তার সানী
গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ
