যে খাবারে বাঁচার কথা, সেই খাবারেই মৃত্যুর বীজ

আরিফুল ইসলাম রাফি

প্রকাশ : ১২ ডিসেম্বর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

বাংলাদেশে খাদ্যদূষণের গল্পটি এখন আর কোনো লুকোচুরি খেলা নয়। এটি এমন এক দুঃস্বপ্ন, যা আমরা জেগে জেগেই দেখি; প্রতিদিন, প্রতিটি বাজারে, প্রতিটি বাসাবাড়ির থালায়। আমরা খাই ভাত, ডাল, মাছ, মাংস, সবজি, ফল; কিন্তু আসলে আমরা কী খাই? খাবার, নাকি খাবারের ছদ্মবেশে লুকিয়ে থাকা বিষ? আমাদের দেশের মানুষ প্রতিদিন খাবার খেতে বসে জানেই না, সেই খাবার কি আদৌ জীবন দিচ্ছে, নাকি ধীরে ধীরে জীবনটাই কেড়ে নিচ্ছে।

ইউনিসেফ-এর তথ্য মতে বিশ্বের প্রায় ৬০ কোটি ও বাংলাদেশে সাড়ে ৩ কোটি শিশু সীসার সংক্রমনে আক্রান্ত; শিশা মানবদেহে ঢুকে মস্তিষ্ক, যকৃত, কিডনি, হাড় ও দাঁতে জমা হয়; শিশুদের হাড় নরম হওয়ায় সীসা সরাসরি মস্তিষ্কে প্রবেশ করে, ফলে শিশুদের মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্থ হয়।

নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের গবেষণা মতে, ৫ শতাংশ গর্ভবতী নারীর দেহে সীসার সংক্রমণ পাওয়া গেছে। আর কৃষি কর্মকর্তাদের মতে, হাঁস-মুরগির খামারগুলোতে ব্যবহার করা হচ্ছে অনিয়ন্ত্রিত ঔষধ। মুরগিকে এন্টিবায়োটিক দেওয়া হলে তা প্রায় ২৮ দিন পর্যন্ত থেকে যায়, এর আগেই মুরগিগুলো বাজারজাত করা হলে তা প্রবেশ করে মানব শরীরে।

বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের তথ্য মতে, প্রতি বছর ১০ জনের মধ্যে একজন শিশু অন্তত একবার খাদ্যবাহিত রোগে আক্রান্ত হয়। খাদ্যবাহিত রোগে আক্রান্ত তিন ভাগের এক ভাগ শিশুই মৃত্যুবরণ করে। শেবাকৃবি, বাকৃবি ও ইউএমইএ সুইডেন-এর যৌথ গবেষণায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে পানির ৮৭টি ও ২৩ ধরনের মাছের নমুনা সংগ্রহ করা হয়, সংগ্রহ করা নমুনা থেকে ৩০০ ধরনের ওষুধ ও ২০০ ধরনের কীটনাশক ছাড়াও ১৬ ধরনের পিএফএএস শনাক্ত করা হয়।

বাংলাদেশে বাজারের ৭৩ শতাংশ সবজিতে অতিরিক্ত কীটনাশক, যা আন্তর্জাতিক মানদ-ের অনেক বাইরে। অর্থাৎ প্রতি ১০টি সবজি কেনা হলে অন্তত ৭টিই নিজের অজ্ঞাতে শরীরে বিষ ঢোকাচ্ছে। আমরা মনে করি, বাজার থেকে সবজি কিনে পানি দিয়ে ধুলেই সব ঠিক। কিন্তু এই বিষের বড় অংশই সবজির শরীরের গভীরে শোষিত থাকে, যা পানিতে ধুলে যায় না। একজন মা যখন তার শিশুকে পালংশাক খাওয়ান, তিনি জানেন না এই শাক শিশুর রক্তে ক্যানসারের বীজও বপন করে দিতে পারে।

দুধের গল্প আরও অন্ধকার। বিশেষ করে খোলা দুধে, মিশ্রিত থাকে ডিটারজেন্ট, ফরমালিন, অ্যান্টিবায়োটিক, ব্যাকটেরিয়া এবং স্টার্চ। এতে অ্যান্টিবায়োটিকের অবশিষ্টাংশের মাত্রা এতই বেশি যে, নিয়মিত পান করলে শিশুর শরীরে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স তৈরি হতে পারে। ভবিষ্যতে সাধারণ জ্বর, কাশি পর্যন্ত সারানো কঠিন হয়ে যায়। এক অর্থে, শিশুর জন্য দুধ, যা জীবন শুরু হওয়ার খাদ্য; একই সঙ্গে স্বাস্থ্য ধ্বংসেরও অস্ত্র হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

মাছের দাম বাড়ে, কিন্তু তার ভেতরের বিপদের দাম আমরা কেউ হিসাব করি না। দেশের ৪০ শতাংশ মাছেই পাওয়া গেছে ফরমালিন বা কার্বাইড, যা মূলত মরদেহ সংরক্ষণে ব্যবহৃত রাসায়নিক। সাগরের মাছগুলো তাজা দেখানোর জন্য ফরমালিনের বৃষ্টি ঝরানো হয়। আপনি বাজারে গিয়ে মাছ টিপে দেখে বলেন, ‘ওহ, মাছটা তো শক্ত আছে, ভালোই!’ কিন্তু সেই শক্ত থাকা মানে স্বাভাবিক তাজা নয়, বরং রাসায়নিকের শক্তি।

চালের মতো প্রধান খাদ্যও বাদ নেই। দেশে উৎপাদিত লক্ষাধিক টন চালের একটি বড় অংশে মিলিং প্রক্রিয়ার সময় মিশে যায় কৃত্রিম পালিশ, ব্লিচিং এজেন্ট, নিষিদ্ধ রং, যা আকৃতিতে আকর্ষণীয় দেখায়, কিন্তু শরীরের রক্তে শোষিত হলে দীর্ঘমেয়াদে অ্যালার্জি, শ্বাসকষ্ট, লিভারের ক্ষতি; এমনকি ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।

রাস্তায় যে ফুচকা, বিরিয়ানি, শিঙাড়া, জিলাপি, পরোটা- এসব লাখো মানুষের প্রতিদিনের খাবার, তার অধিকাংশই তৈরি হয় অস্বাস্থ্যকর পানি, পুনর্ব্যবহৃত পোড়া তেল এবং টেক্সটাইল গ্রেড রং দিয়ে। ঢাকার জনপ্রিয় রেস্টুরেন্টের রান্নাঘরের তেলে পাওয়া গেছে অ্যাক্রোলিন, যা দীর্ঘদিন গ্রহণ করলে মানুষকে ক্যান্সারের দিকে ঠেলে দেয়।

এটাই খাদ্যদূষণের চিত্র, আমরা যা খাই, তার সঙ্গে শরীরও ধীরে ধীরে খেয়ে ফেলা হয়। তবে সবচেয়ে ভয়ংকর হলো বৃহত্তর পরিসংখ্যান। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব বলছে, খাদ্যবাহিত রোগে বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ৩০ লক্ষ মানুষ অসুস্থ হয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দূষিত খাবারের কারণে আমাদের দেশের অর্থনীতিতে বছরে প্রায় ৮,০০০ কোটি টাকার ক্ষতি; চিকিৎসা, কর্মঘণ্টার ক্ষতি, মৃত্যুহার সব মিলে। কিন্তু এই সংখ্যাগুলো সংবাদে আসলেও কিছু দিনের মধ্যেই আলোচনার বাইরে চলে যায়। আমরা ভুলে যাই। আবার আগের মতো বাজারে যাই, খাবার কিনে আনি, খাই। যেন এই মৃত্যুফাঁদকে আমরা খুব স্বাভাবিকভাবে মেনে নিয়েছি।

রাষ্ট্রের ভূমিকা অবশ্যই আছে। সময় সময় অভিযান হয়, দোকান সিলগালা হয়, জরিমানা হয়। কিন্তু বিচ্ছিন্ন অভিযান দিয়ে সমস্যার অন্তরালে থাকা কাঠামোগত দুর্নীতি, অজ্ঞতা আর উদাসীনতা দূর হয় না। এখনো দেশে খাদ্য পরীক্ষাগার আছে হাতে গোনা কয়েকটি। জেলা পর্যায়ে সঠিক ল্যাব নেই, যেটুকু আছে, সেগুলোতে আধুনিক যন্ত্রপাতি নেই, দক্ষ পরীক্ষক নেই। ফলে হাজার হাজার টন খাদ্য প্রতিদিন কোনো পরীক্ষা ছাড়াই বাজারে ঢুকে যায়।

আর সেই খাদ্যই ঢুকে যায় আমাদের পেটে।

কৃষকদেরও দোষ দিয়ে লাভ নেই। তারা জানে, সঠিক জৈব পদ্ধতি ব্যবহার করলে ফলন কমে। বাজারে তাদের পণ্যের দামও কম। ফলে তারা বাধ্য হয় বিষাক্ত রাসায়নিক ব্যবহারে। এটি এক বিস্তৃত সামাজিক-অর্থনৈতিক জটিলতা। সমাধান দিতে হলে পুরো প্রক্রিয়াটিকেই সংস্কার করতে হবে। কৃষককে উৎসাহ দিতে হবে, প্রণোদনা দিতে হবে, প্রশিক্ষণ দিতে হবে, যাতে তিনি ভয় না পান বিষ ছাড়া চাষ করতে।

খাদ্যদূষণ নিয়ন্ত্রণের প্রথম শর্ত হলো আইনকে শক্ত করা। শুধু জরিমানা নয়, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রয়োজন- লাইসেন্স বাতিল, দীর্ঘমেয়াদি কারাদণ্ড। যখন কেউ জানবে যে খাদ্যে বিষ মেশালে শাস্তি নিশ্চিত, তখন অনেকেই ভয় পাবে। দ্বিতীয়ত, প্রতিদিনের বাজারের দামে যেভাবে আমাদের নজর থাকে, তেমনিভাবে নিরাপত্তার ওপরও নজর থাকতে হবে। যেমন আমরা সকালের আবহাওয়ার খবর দেখি, তেমনি বাজারের “নিরাপদ খাবারের বুলেটিন” থাকলে মানুষ জানতে পারে আজ কোনটি খাওয়া নিরাপদ, কোনটি নয়।

সবশেষে, ভোক্তার শক্তি সবচেয়ে বড় শক্তি। যদি আমরা নিজেরা সচেতন হই, অস্বাস্থ্যকর দোকান থেকে খাবার না কিনি, সস্তার খাবারের লোভ না করি, রাসায়নিকের গন্ধযুক্ত ফল দেখলে বাদ দিই, খাবার কেনার আগে প্রশ্ন করি; তাহলে ব্যবসায়ীরা বাধ্য হবে পরিবর্তন আনতে। কারণ ব্যবসা সেই রাস্তাতেই চলে, যেদিকে ভোক্তা হাঁটে।

আজ যখন আমরা থালায় খাবার সাজাই, তখন হয়তো আমাদের মনে প্রশ্ন ওঠা উচিত, এ খাবার কি আমাকে শক্তি দেবে, নাকি আমার শরীরের ভেতর ধীরে ধীরে ক্ষয় ধরাবে? আমরা কি বিষের সঙ্গে বাস করব, নাকি নিরাপদ খাবারের অধিকারের জন্য একযোগে দাঁড়াব? খাদ্যদূষণকে আর ‘অদৃশ্য শত্রু’ বললে চলবে না; এটি স্পষ্ট, নির্মম, প্রতিদিনকার সত্য। আর এই সত্য বদলাতে হলে প্রত্যেক মানুষ, রাষ্ট্র, সমাজ- সবারই দায়িত্ব আছে। আজ আমরা যদি কথা না বলি, আগামী প্রজন্ম আমাদের ভুলে যাবে না।

আরিফুল ইসলাম রাফি

শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ