মাদকে ডুবছে গ্রামবাংলা : পরিবার ও সমাজ নতুন সংকটে
শায়লা নাজনীন
প্রকাশ : ১২ ডিসেম্বর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

গ্রামবাংলা একসময় ছিল শান্ত, সরল আর আত্মিক বন্ধনে গড়া এক সমৃদ্ধ সামাজিক পরিবেশ। সেখানে পরিবারের শক্ত বন্ধন, প্রতিবেশীর আন্তরিকতা এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য মানুষকে ভালো থাকার প্রেরণা দিত। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই চিরচেনা গ্রামজীবনে নেমে এসেছে অস্থিরতার অন্যরকম ছায়া মাদকাসক্তির ভয়াল বিস্তার। কিশোর থেকে যুবক, মধ্যবয়স্ক থেকে বৃদ্ধ সবাই কোনো না কোনোভাবে নেশার জালে জড়িয়ে পড়ছে, আর এর পরিণতি গ্রামীণ সমাজকে এক বিপজ্জনক মোড়ে নিয়ে এসেছে।
গ্রামে আগে মাদক বলতে গাঁজা বা দেশীয় মদই বেশি পরিচিত ছিল। এখন ছবিটা সম্পূর্ণ বদলে গেছে। ইয়াবা, আইস, ফেন্সিডিল, ট্যাবলেট এসব শহরকেন্দ্রিক নেশা দ্রব্য সহজেই পৌঁছে যাচ্ছে প্রত্যন্ত গ্রামের ঘরদুয়ারে। সবচেয়ে ভয়াবহ বিষয় হলো, এই মাদকগুলো পরিচালনায় স্থানীয় দালাল, বেকার যুবক ও কিছু অসাধু ব্যবসায়ী একধরনের অনিয়ন্ত্রিত নেটওয়ার্ক তৈরি করে ফেলেছে। এর ফলে মাদক এখন আর লুকিয়ে ব্যবহৃত কোনো পণ্য নয়; বরং গ্রামের বাজার, হাট, এমনকি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সংলগ্ন এলাকায়ও এর প্রভাব দৃশ্যমান।
কিশোরদের মধ্যে মাদকাসক্তি সবচেয়ে বেশি উদ্বেগজনক। স্কুল-কলেজপড়ুয়া অনেকেই ‘মজা’ বা ‘বন্ধুদের সাথে সময় কাটানো’ এই অজুহাতে নেশার জগতে পা রাখছে। শুরুটা হয় কৌতূহল থেকে, এরপর দ্রুত তা অভ্যাসে পরিণত হয়। ফলে পড়াশোনা, পরিবার, ভবিষ্যৎ সবকিছুই একসময় দ্বিতীয় হয়ে পড়ে নেশার কাছে। যুবকদের ক্ষেত্রে বেকারত্ব, হতাশা এবং স্বপ্নভাঙার কষ্ট মাদককে আরও সহজ পালানোর রাস্তা হিসেবে তৈরি করছে। মধ্যবয়সী ও বয়স্কদের মধ্যে অনেকেই শারীরিক কষ্ট বা মানসিক দুঃখ ভুলতে নেশার দিকে ঝুঁকছেন।
এই মাদক বিস্তার শুধু ব্যক্তিকে নয়, পুরো গ্রামীণ সমাজকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। বাড়ছে চুরি-ছিনতাই, পারিবারিক ঝগড়া, জমি-বাড়ি নিয়ে বিবাদ, এমনকি হত্যাকাণ্ডের ঘটনাও। অনেক পরিবার ঋণে ডুবে যাচ্ছে মাদকাসক্ত সদস্যকে চিকিৎসা করাতে গিয়ে। কেউ কেউ চিকিৎসাও করাতে পারে না, কারণ সামাজিক লজ্জা ও দারিদ্র্যের কাঁটা তাদের আটকে দেয়। গ্রামের সামাজিক কাঠামোর যে ঐক্য, মানবিকতা এবং নিরাপত্তাবোধ ছিল তা এখন ভীষণভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছে।
মাদক প্রতিরোধে গ্রামে সচেতনতা তৈরির কাজ আরও জোরদার করতে হবে। স্থানীয় প্রশাসনের নজরদারি, যুবকদের কর্মসংস্থান, স্কুল-কলেজে নেশাবিরোধী শিক্ষা, ধর্মীয় ও সামাজিক সংগঠনের উদ্যোগ সবকিছুই সমন্বিতভাবে কাজ না করলে এই ভয়াবহতা ঠেকানো সম্ভব নয়। পরিবারকেও নতুনভাবে সচেতন হতে হবে, সন্তানদের সাথে খোলামেলা কথা বলতে হবে, তাদের মানসিক চাপ বা হতাশার জায়গাগুলো বুঝে পাশে দাঁড়াতে হবে।
গ্রামবাংলা আমাদের শেকড়। সেই শেকড় যদি মাদকের আগ্রাসনে ক্ষয়ে যায়, তবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে পুরো দেশের ভবিষ্যৎ। তাই এখনই সময়, মাদকের বিরুদ্ধে গ্রামপর্যায়ে সর্বাত্মক প্রতিরোধ গড়ে তোলার। আজকেই যদি আমরা এই সংকটকে গুরুত্ব না দিই, তবে আগামী প্রজন্মের ওপর নামবে আরও ভয়াবহ অন্ধকার।
শায়লা নাজনীন
সমাজবিজ্ঞান বিভাগ
