ঢাকা বুধবার, ১৭ ডিসেম্বর ২০২৫, ২ পৌষ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

শীতের কুয়াশা ও সড়ক দুর্ঘটনার অদৃশ্য ভয়

আরশী আক্তার সানী
শীতের কুয়াশা ও সড়ক দুর্ঘটনার অদৃশ্য ভয়

শীত এলেই ভোরের রাস্তাগুলো যেন অন্য রূপ নেয়। চারপাশে ঘন কুয়াশা, রাস্তার বাতিগুলো অস্পষ্ট, দূরের শব্দ কাছাকাছি এসে মিলিয়ে যায়। এই দৃশ্য অনেকের কাছে শান্ত, মুগ্ধকর, ছবির মতো সুন্দর। কিন্তু এই সৌন্দর্যের আড়ালেই লুকিয়ে থাকে প্রতিদিনের অগণিত শোকগাথা সড়ক দুর্ঘটনার নীরব ভয়।

বাংলাদেশে শীত মানেই কুয়াশা, আর কুয়াশা মানেই অনিশ্চয়তা। ভোর চারটা থেকে সকাল আটটা পর্যন্ত সময়টা যেন এক অদৃশ্য ঝুঁকির সময়। মহাসড়ক, আঞ্চলিক সড়ক কিংবা গ্রামীণ পথ সব জায়গায় তখন চালকের চোখে রাস্তা স্পষ্ট থাকে না। তারা চালান অভ্যাসের ওপর ভর করে, অনুমানের ওপর নির্ভর করে। আর এই অনুমাননির্ভর যাত্রাই অনেক সময় হয়ে ওঠে জীবনের শেষ যাত্রা।

শীতকালের দুর্ঘটনার সবচেয়ে বড় কারণ হলো দৃশ্যমানতার সংকট। কুয়াশার ঘনত্ব এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে কয়েক হাত দূরের যানবাহনও চোখে পড়ে না। সামনে ধীরগতির কোনো গাড়ি, হঠাৎ রাস্তা পার হওয়া পথচারী, কিংবা রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষ সবই মুহূর্তে বিপদের কারণ হয়ে ওঠে। ভারী যানবাহনের ক্ষেত্রে বিপদ আরও বেশি, কারণ ব্রেক করলেও তাৎক্ষণিকভাবে গাড়ি থামানো সম্ভব হয় না।

কিন্তু কুয়াশাই কি একমাত্র দায়ী? বাস্তবতা হলো আমাদের অসচেতনতা কুয়াশাকে আরও ভয়ংকর করে তোলে। অনেক চালক কুয়াশার মধ্যেও স্বাভাবিক কিংবা অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালান। সময়ের তাড়া, যাত্রী চাপ, কিংবা দায়িত্বহীন মানসিকতা সব মিলিয়ে তারা ঝুঁকি নিতে দ্বিধা করেন না। ফগ লাইট ব্যবহার অনেক জায়গায় এখনও বাধ্যতামূলক হয়ে ওঠেনি, আর যেখানে আছে, সেখানে প্রয়োগ নেই। অনেক গাড়ির হেডলাইট এতটাই দুর্বল যে কুয়াশার ভেতর তা কার্যকর হয় না।

সড়ক ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা এই সমস্যাকে আরও গভীর করে তোলে। অনেক মহাসড়কে নেই স্পষ্ট রোড মার্কিং, নেই প্রতিফলক সাইনবোর্ড। কোথায় বাঁক, কোথায় ইউটার্ন, কোথায় ব্রিজ এসব বোঝার কোনো উপায় থাকে না। কোথাও আবার রাস্তার পাশে অবৈধ দোকান, বাজার কিংবা যানবাহনের স্ট্যান্ড গড়ে ওঠে। কুয়াশার ভেতর এগুলো হয়ে দাঁড়ায় অদৃশ্য ফাঁদ।

শীতকালে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকেন পথচারীরা। গ্রামাঞ্চলে ভোরে মানুষ কাজে বের হন কেউ মাঠে, কেউ বাজারে, কেউবা দূরের কর্মস্থলে। কুয়াশার ভেতর দিয়ে রাস্তা পার হওয়া তাদের কাছে নিত্যদিনের বাস্তবতা। কিন্তু চালক যেমন তাদের দেখতে পান না, তেমনি পথচারীরাও গাড়ির গতি ও দূরত্ব ঠিকভাবে বুঝতে পারেন না। ফলাফল মুহূর্তের মধ্যে ঘটে যায় মর্মান্তিক দুর্ঘটনা।

মোটরসাইকেল চালকদের ঝুঁকিও কম নয়। শীতের ঠান্ডায় শরীর শক্ত হয়ে আসে, প্রতিক্রিয়া সময় কমে যায়। হেলমেটের কাচ কুয়াশায় ঝাপসা হয়ে পড়ে, দৃষ্টিসীমা আরও সংকুচিত হয়। অনেকেই গরম কাপড় পরার কারণে স্বাভাবিকভাবে নড়াচড়া করতে পারেন না। এই ছোট ছোট সমস্যাগুলো একত্র হয়ে বড় দুর্ঘটনার জন্ম দেয়।

দুর্ঘটনার পরের বাস্তবতা আরও বেদনাদায়ক। অনেক ক্ষেত্রে সময়মতো উদ্ধারকাজ শুরু হয় না। কুয়াশার কারণে অ্যাম্বুলেন্স পৌঁছাতে দেরি করে, কোথাও আবার জরুরি সেবা পাওয়াই কঠিন। গ্রামাঞ্চলে আহতকে হাসপাতালে নিতে হয় অটোরিকশা বা ভ্যানগাড়িতে এই দেরিতেই অনেক প্রাণ ঝরে যায়। যে মানুষটি একটু দ্রুত চিকিৎসা পেলে বেঁচে যেতে পারত, সে মানুষটিই হয়ে ওঠে পরিসংখ্যানের সংখ্যা।

সবচেয়ে ভয়ংকর বিষয় হলো আমরা এসব দুর্ঘটনাকে প্রায় স্বাভাবিক ঘটনা হিসেবে মেনে নিয়েছি। শীত এলেই দুর্ঘটনার খবর হবে, কিছুদিন আলোচনা চলবে, তারপর সবকিছু ভুলে যাওয়া। এই মানসিকতাই আমাদের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা। দুর্ঘটনা কোনো নিয়তি নয়; অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এটি প্রতিরোধযোগ্য।

এই পরিস্থিতি থেকে বের হতে হলে দায় নিতে হবে সবাইকে। শুধু চালক বা পথচারী নয় রাষ্ট্র, প্রশাসন, সড়ক কর্তৃপক্ষ সবারই দায়িত্ব রয়েছে। শীত শুরুর আগেই ঝুঁকিপূর্ণ সড়কগুলো চিহ্নিত করে বিশেষ ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রতিফলক সাইনবোর্ড, স্পষ্ট রোড মার্কিং, স্পিড লিমিট নিয়ন্ত্রণ এসব কোনো অতিরিক্ত দাবি নয়, এগুলো জীবন রক্ষার মৌলিক শর্ত।

যানবাহনে কার্যকর ফগ লাইট ব্যবহার নিশ্চিত করা, পুরোনো ও ঝুঁকিপূর্ণ যানবাহন চলাচল নিয়ন্ত্রণ, চালকদের শীতকালীন বিশেষ প্রশিক্ষণ এসব এখন সময়ের দাবি। একই সঙ্গে পথচারীদের জন্যও সচেতনতা বাড়াতে হবে। কুয়াশার মধ্যে রাস্তা পার হওয়ার ঝুঁকি, উজ্জ্বল রঙের পোশাক ব্যবহারের গুরুত্ব, নির্দিষ্ট পারাপার ব্যবহার এসব বিষয়ে নিয়মিত প্রচার প্রয়োজন।

শীতের কুয়াশা প্রকৃতির দান। এতে আছে সৌন্দর্য, নীরবতা আর প্রশান্তি। কিন্তু এই সৌন্দর্যের আড়ালে যেন আর কোনো মায়ের বুক খালি না হয়, আর কোনো পরিবার শোকের সংবাদ না পায়। দুর্ঘটনা কমানো অসম্ভব নয় শুধু প্রয়োজন একটু ধীরতা, একটু দায়িত্ববোধ আর একটু মানবিকতা। শীত আসবে, কুয়াশা নামবে এটাই প্রকৃতির নিয়ম। কিন্তু সেই কুয়াশার ভেতর দিয়ে আমরা কতোটা নিরাপদে চলব, সেটাই আমাদের সিদ্ধান্ত। এখন সময় এসেছে দুর্ঘটনাকে নিয়তি না ভেবে প্রতিরোধযোগ্য বাস্তবতা হিসেবে দেখার। শীতের কুয়াশার অদৃশ্য ভয়কে দৃশ্যমান করে তুলতে পারলেই, হয়তো কোনো এক ভোরে খবরের শিরোনাম আর এতটা মর্মান্তিক হবে না।

আরশী আক্তার সানী

গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত