প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ১৭ ডিসেম্বর, ২০২৫
প্রতি বছর বাজেট বক্তৃতায় শোনা যায় দেশের মাথাপিছু আয় বেড়েছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৬ থেকে ৭ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। দারিদ্র্যের হার কমেছে। এসব সংখ্যা শুনে মনে হয় দেশ দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে মানুষের জীবনে সেই উন্নয়নের ছোঁয়া কতটুকু লাগছে? পরিসংখ্যানের সংখ্যা আর মানুষের প্রকৃত সমৃদ্ধির মধ্যে একটা অদৃশ্য সেতু তৈরি হয়ে গেছে, যা দিন দিন প্রশস্ত হচ্ছে।
পরিসংখ্যানের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো গড়ের হিসাব। যেমন, ১০ জন মানুষের মধ্যে ৯ জনের মাসিক আয় ১০ হাজার টাকা, একজনের আয় ১ লাখ টাকা। এখন গাণিতিকভাবে এই দশজনের গড় আয় হবে ১৯ হাজার টাকা। কিন্তু বাস্তবে নয়জন মানুষই ১০ হাজার টাকায় সংসার চালাচ্ছে। পরিসংখ্যান বলছে গড় আয় প্রায় ২০ হাজার অথচ সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ তার অর্ধেক আয় করছে। জাতীয় আয়ের হিসাবে ঠিক এই খেলাটাই চলে। শীর্ষ ১০ শতাংশ মানুষের আয় যদি বিপুল পরিমাণে বাড়ে আর বাকি ৯০ শতাংশের আয় সামান্য বাড়ে বা স্থির থাকে, তবুও মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির চমকপ্রদ পরিসংখ্যান তৈরি হয়ে যায়।
আয় বৈষম্য পরিমাপের জন্য অর্থনীতিতে জিনি সহগ নামে একটা সূচক আছে। এটি শূন্য থেকে এক পর্যন্ত হয়। শূন্য মানে সবার আয় সমান, এক মানে একজনের কাছে সব সম্পদ। বাংলাদেশে এই সূচকের মান ক্রমাগত বৃদ্ধির ফলে ধনী-গরিবের ব্যবধান বাড়ছে। কিন্তু সরকারি প্রতিবেদনে এই বৈষম্যের চিত্র আড়ালে থেকে যায় এবং সামনে আসে শুধু মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির তথ্য।
দারিদ্র্যের হার নিয়েও প্রশ্ন আছে। দরিদ্র কাকে বলা হবে সেই সংজ্ঞা নির্ধারণে রয়েছে সুযোগ। দারিদ্র্যসীমা যেভাবে নির্ধারণ করা হয় তাতে কারচুপির সুযোগ থাকে। এই সীমারেখা সামান্য উপরে-নিচে করলেই দরিদ্র মানুষের সংখ্যা কমানো-বাড়ানো সম্ভব। আগে যদি বলা হতো দিনে ২০ হাজার ক্যালরির কম খেলে দরিদ্র কিন্তু এখন যদি বলা হয় ১ হাজার ৮০০ ক্যালরির কম, তাহলে পরিসংখ্যানে দরিদ্রের সংখ্যা কমে যাবে। এভাবেই সংখ্যার খেলায় রাজনীতির পথ সহজ হয়ে যায়।
জরিপ পদ্ধতিতেও রয়েছে সমস্যা। নমুনা নির্বাচনে যদি পক্ষপাত থাকে তাহলে পুরো পরিসংখ্যানই ভুল হবে। যদি উন্নত এলাকায় বেশি জরিপ হয়, পিছিয়ে পড়া এলাকায় কম হয়, তাহলে যে তথ্য আসবে তা দেশের প্রকৃত চিত্র তুলে ধরবে না। অনেক সময় প্রত্যন্ত অঞ্চল জরিপের বাইরে থেকে যায়। সেই এলাকার মানুষের অবস্থা জাতীয় হিসাবে ধরাই হয় না।
গড়ের চেয়ে মধ্যমা অনেক সময় বাস্তবসম্মত হিসাব দেয়। মধ্যমা হলো মাঝামাঝি মান। যদি ১০০ জন মানুষের আয় ছোট থেকে বড় সাজিয়ে লেখা হয়, ৫০তম জনের আয়ই মধ্যমা। উপরে কয়েকজন কোটিপতি থাকলে তারা গড় বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু মধ্যমায় এর প্রভাব কম থাকে ফলে মধ্যমায় আসল চিত্র কিছুটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আমাদের দেশে মাথাপিছু আয় বলতে গড় দেখানো হয়, মধ্যমা দেখানো হয় না।
পরিসংখ্যানে আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো বিচ্যুতি বা ছড়ানোর পরিমাণ। গড় থেকে মানগুলো কতটা ছড়ানো তা দিয়ে বোঝা যায় বৈষম্যের মাত্রা। যদি ১০ জনের আয় ১০, ১১, ১২, ১৩ হাজার টাকার মধ্যে থাকে তাহলে তারা সবাই মোটামুটি কাছাকাছি অবস্থানে আছে। কিন্তু যদি একজনের আয় ৫ লাখ আর বাকিদের ১০ হাজার, তাহলে বিচ্যুতি বিশাল। জাতীয় পরিসংখ্যানে গড় দেখানো হয়, বিচ্যুতির পরিমাণ দেখানো হয় না। ফলে বৈষম্যের আসল চিত্র আড়ালে থাকে। শিক্ষা খাতের পরিসংখ্যানেও একই সমস্যা। শিক্ষার হার বৃদ্ধির তথ্য দেওয়া হয় কিন্তু সেখানে শুধু ভর্তির হার দেখানো হয়, ঝরে পড়ার হার দেখানো হয় না। কতজন শিশু স্কুলে ভর্তি হলো সেটা একটা সংখ্যা, কিন্তু তারা কতদিন স্কুলে থাকল, কী শিখল, সেটা আরেক গল্প। অনেক শিশু পঞ্চম শ্রেণিতে গিয়েও নিজের নাম ঠিকমতো লিখতে পারে না। কিন্তু পরিসংখ্যানে সে শিক্ষিত হিসেবে গণ্য। স্বাস্থ্য খাতেও একই অবস্থা। জনসংখ্যার অনুপাতে হাসপাতালের সংখ্যা বাড়ছে বলে দাবি করা হয়। কিন্তু সেবার গুণমান কোথায়? হাসপাতাল তৈরি হওয়া আর মানুষ চিকিৎসা পাওয়া- এই দুইটা ভিন্ন বিষয়। অবকাঠামো থাকলেই হয় না, সেখানে পর্যাপ্ত ডাক্তার, নার্স, ওষুধ, যন্ত্রপাতি থাকতে হয়। সেবার মান নিশ্চিত করতে হয়। কিন্তু পরিসংখ্যানে শুধু হাসপাতালের সংখ্যা গণনা করা হয়, সেবার মান পরিমাপ করা হয় না।
মূল্যস্ফীতির হিসাবও ঠিক নেই। সরকারি হিসাবে মূল্যস্ফীতি বছরে ৭-৮ শতাংশ। কিন্তু বাজারে গেলে মনে হয় ৩০-৪০ শতাংশ দাম বেড়েছে। কারণ মূল্যস্ফীতির হিসাব করা হয় বিভিন্ন পণ্যের ওজনের মাধ্যমে। কিছু পণ্যকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়, কিছু পণ্যকে কম। যদি বিলাসবহুল পণ্যের দাম সামান্য বাড়ে আর নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম অনেক বাড়ে, তাহলে হিসাবে বিলাসবহুল পণ্যকে বেশি ওজন দেওয়া হয়। যার ফলে দেখা যায় গড় মূল্যস্ফীতি কম আসে। অথচ সাধারণ মানুষের ব্যবহৃত পণ্যের দাম নাগালের বাইরে চলে যায়।
মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি নিয়েও প্রশ্ন তোলা যায়। জিডিপি বাড়লেই কি সবার ভালো হয়? জিডিপিতে কী কী হিসাব করা হয়, সেটাও গুরুত্বপূর্ণ। একটা নতুন কলকারখানা তৈরি হলে জিডিপিতে যোগ হয়। কিন্তু সেই কারখানার দূষণে যে নদী মরে যাচ্ছে, বন উজাড় হচ্ছে, সেই ক্ষতি জিডিপি থেকে বিয়োগ হয় না। পরিবেশের ক্ষতি, প্রাকৃতিক সম্পদের অবক্ষয়- এসব জিডিপিতে ধরা পড়ে না। তাহলে এই জিডিপি কি প্রকৃত সমৃদ্ধির পরিমাপ?
আয় বণ্টনের চিত্রও পরিসংখ্যানে উপেক্ষিত। মাথাপিছু আয় দিয়ে কিছু বোঝা যায় না, যদি না জানা যায় সেই আয় কীভাবে বণ্টন করা হয়েছে। দেশের মোট আয়ের কত শতাংশ শীর্ষ ১০ ভাগ মানুষের হাতে, আর কত শতাংশ নিচের পঞ্চাশ ভাগ মানুষের হাতে- এই তথ্য জানা দরকার। লরেঞ্জ রেখা নামে একটা পদ্ধতি আছে যা দিয়ে আয় বৈষম্য চোখে দেখা যায়। কিন্তু সরকারি প্রতিবেদনে সেই রেখা দেখানো হয় না। তথ্যের সত্যতা ও নির্ভরযোগ্যতাও একটা বড় প্রশ্ন। যে তথ্যের ভিত্তিতে জাতীয় পরিসংখ্যান তৈরি হয়, সেই তথ্য কতটা বৈধ? কীভাবে সংগ্রহ করা হয়েছে? কোন পদ্ধতিতে বিশ্লেষণ করা হয়েছে? এসব তথ্য স্বচ্ছভাবে প্রকাশ করা হয় না। ফলে পরিসংখ্যান যাচাই করার উপায় থাকে না। তথ্য সংগ্রহেই যদি ভুল থাকে, তাহলে পুরো হিসাবই ভুল হবে। যে কোনো জরিপের ফলাফলে একটা ভুলের সীমা থাকে। যেমন বলা হতে পারে, বেকারত্বের হার ২০ শতাংশ, প্লাস-মাইনাস ৩ শতাংশ। মানে প্রকৃত হার ১৭ থেকে ২৩ শতাংশের মধ্যে যে কোনো কিছু হতে পারে। কিন্তু সংবাদে শুধু বলা হয় ২০ শতাংশ। এই অনিশ্চয়তার কথা জানানো হয় না। ফলে মানুষ ভাবে সংখ্যাটা একদম নিখুঁত।
মুহম্মদ গোলাম রাব্বি
শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়