পোশাকশিল্পে নারীর নীরব বিপ্লব

জান্নাতুল ফেরদৌস জেরিন, শিক্ষার্থী, বাংলা বিভাগ

প্রকাশ : ২২ ডিসেম্বর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে পোশাকশিল্প (RMG Sector) এক অপরিহার্য স্তম্ভ। আর এই স্তম্ভকে শক্তভাবে ধরে রেখেছে দেশের নারী শ্রমিকরা। বর্তমানে দেশের মোট রপ্তানি আয়ের সিংহভাগ (প্রায় ৮৪ ভাগ) আসে এই খাত থেকে, যার মূল চালিকাশক্তি প্রায় ৪০ লাখেরও বেশি নারী শ্রমিক। গ্রামীণ পটভূমি থেকে আসা এই নারীরা শুধুমাত্র সেলাই মেশিন চালিয়ে কাপড় তৈরি করছেন না, বরং তারা নিজেদের শ্রম, দক্ষতা এবং আত্মত্যাগের মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে নীরব বিপ্লব ঘটিয়ে চলেছেন। তাদের এই অবদান শুধুমাত্র জিডিপি বৃদ্ধিতে সীমাবদ্ধ নয়, বরং তা বাংলাদেশের সামাজিক কাঠামোর এক বিশাল পরিবর্তন এনেছে।

অর্থনীতির মূলচালিকাশক্তি হিসেবে নারীশ্রমিক : পোশাকশিল্পে নারীর অবদানকে কোনোভাবেই ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। এই শিল্পের মোট শ্রমিকের প্রায় ৬০ থেকে ৮০ শতাংশই নারী। তাদের দ্রুত শেখার ক্ষমতা, সূক্ষ্ম কাজে মনোযোগ এবং ধৈর্যশীলতা—এই তিনটি গুণাগুণ পোশাক কারখানার উৎপাদনে এক অপরিহার্য সুবিধা এনে দিয়েছে। বিশ্ব বাজারে প্রতিযোগিতামূলক দামে পণ্য সরবরাহ করার সক্ষমতা ধরে রাখতে এই নারীদের শ্রমই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তাদের হাত ধরে তৈরি হওয়া পোশাক যখন ইউরোপ, আমেরিকা বা অন্যান্য দেশে রপ্তানি হয়, তখন তা বিপুল পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রা দেশে নিয়ে আসে। এটি দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভকে স্থিতিশীল রাখতে, ব্যবসা-বাণিজ্য সচল রাখতে এবং দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই নারীরাই কার্যত বাংলাদেশকে স্বল্পোন্নত দেশ (LDC) থেকে উন্নয়নশীল দেশে (Developing Country) উত্তরণের পথে প্রধান সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করেছেন।

সামাজিক ক্ষমতায়ন ও পারিবারিক কাঠামোর পরিবর্তন : পোশাকশিল্পে নারীদের অংশগ্রহণ শুধু আর্থিক নয়, এর সুদূরপ্রসারী সামাজিক প্রভাবও রয়েছে। গ্রাম থেকে শহরে এসে কাজ করার সুযোগ পাওয়ায় নারীরা প্রথমত অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অর্জন করেছেন। তাদের উপার্জিত অর্থ পরিবারের খাদ্য, শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য খাতে সরাসরি বিনিয়োগ হচ্ছে। বহু ক্ষেত্রেই দেখা যায়, এই নারী শ্রমিকরাই এখন পরিবারের প্রধান উপার্জনকারী, যার ফলে তারা পরিবারে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন। এটি গ্রামীণ এবং শহুরে- উভয় সমাজেই নারীর প্রতি গতানুগতিক দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে সহায়তা করছে। বাল্যবিবাহ হ্রাস, শিশুদের শিক্ষার হার বৃদ্ধি, এবং মাতৃমৃত্যু ও শিশুস্বাস্থ্য পরিস্থিতির উন্নতিতে এই নারী শ্রমিকদের আয় করা অর্থের প্রত্যক্ষ প্রভাব অনস্বীকার্য। তাদের নিজস্ব উপার্জনের ফলে তাদের আত্মবিশ্বাস বেড়েছে, যা তাদের অধিকার সচেতন করে তুলেছে এবং সমাজে তাদের অবস্থানকে শক্তিশালী করেছে।

প্রতিকূলতা এবং টিকে থাকার সংগ্রাম : পোশাকশিল্পে নারীর অবদান অতুলনীয় হলেও, তাদের পথচলা মোটেও মসৃণ নয়। এই খাতে কর্মরত নারীদের প্রতিনিয়ত নানা প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হয়। স্বল্প মজুরি, অতিরিক্ত কাজের চাপ, অনিরাপদ কর্মপরিবেশ এবং মাতৃত্বকালীন ছুটির মতো মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়ার অভিযোগ প্রায়ই শোনা যায়। বিশেষ করে কারখানার কাজের পরিবেশে হয়রানি বা যৌন হয়রানির শিকার হওয়ার ঘটনাও মাঝে মাঝে সংবাদে আসে। এছাড়া, অধিকাংশ নারী শ্রমিকই বাসস্থান, স্বাস্থ্যসেবা এবং শিশুদের জন্য ডে-কেয়ার সুবিধার অভাবে কষ্ট পান। অর্থনৈতিক সংকটের সময় বা রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে কারখানা বন্ধ হলে সবার আগে এই নারী শ্রমিকরাই ক্ষতিগ্রস্ত হন। এত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও, তারা তাদের পরিবার এবং দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে কঠোর পরিশ্রম করে চলেছেন। তাদের এই সংগ্রাম এবং টিকে থাকার মানসিকতা দেশের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রার প্রতি এক বিরাট অঙ্গীকার।

শিল্পের ভবিষ্যৎ ও নারীর নেতৃত্ব : পোশাকশিল্পের ভবিষ্যৎ : উন্নয়নের জন্য নারী শ্রমিকদের অবদানকে আরও বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। এখন সময় এসেছে কেবল শ্রমিক হিসেবে নয়, নেতৃত্বের পর্যায়েও নারীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার। সেলাই মেশিন থেকে শুরু করে সুপারভাইজার, ম্যানেজার এবং এমনকি কারখানার মালিকানা- সব স্তরেই নারীর অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে। পোশাকশিল্প মালিক এবং সরকারের উচিত, শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি, নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করা, এবং কর্মস্থলে ডে-কেয়ার ও স্বাস্থ্যসেবা প্রদান নিশ্চিত করার জন্য সুনির্দিষ্ট নীতি প্রণয়ন করা। এই নারীদের শ্রম ও অধিকারকে সম্মান জানিয়ে যথাযথ সুযোগ-সুবিধা দিলে তা শুধু শ্রমিকদের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন করবে না, বরং এই শিল্পকে বিশ্ব দরবারে আরও বেশি প্রতিযোগিতামূলক করে তুলবে। পরিশেষে বলা যায়, পোশাকশিল্পের নারী শ্রমিকরা শুধু পোশাক প্রস্তুতকারী নন, তারা সামাজিক পরিবর্তন, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা এবং পারিবারিক সচ্ছলতার প্রতীক। তাদের নীরব বিপ্লব বাংলাদেশকে বিশ্ব মানচিত্রে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছে। এই অবদানকে যথাযথ সম্মান ও সমর্থন দেওয়াই হলো দেশের টেকসই উন্নয়নের মূলমন্ত্র।