হতাশ প্রজন্ম ও নীরব ক্ষোভ

আরিফুল ইসলাম রাফি, শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ

প্রকাশ : ২২ ডিসেম্বর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

হতাশ প্রজন্ম বলতে সেই তরুণ সমাজকে বোঝায়, যারা স্বপ্ন দেখে কিন্তু বাস্তবতার কঠোর দেওয়ালে বারবার আঘাত পায়। কর্মসংস্থানের সংকট, বৈষম্য, অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ ও মূল্যবোধের অবক্ষয় তাদের মনে জন্ম দেয় গভীর ক্ষোভ। এই ক্ষোভ উচ্চস্বরে প্রকাশ পায় না; জমে থাকে নীরবতায়, চোখের ভাষায় কিংবা নির্লিপ্ত আচরণে। তারা প্রতিবাদ করতে চায়, কিন্তু বিশ্বাস করে না; কারণ বহুবার কণ্ঠস্বর উপেক্ষিত হয়েছে। এই নীরব ক্ষোভ একদিন বিস্ফোরিত হতে পারে, যদি সমাজ ও রাষ্ট্র তাদের আশা, সম্মান ও ন্যায়বিচার দিতে ব্যর্থ হয়।

হতাশ প্রজন্মকে বোঝা কঠিন, কারণ তারা আর উচ্চস্বরে কষ্ট প্রকাশ করে না। তারা শিখে গেছে, কথা বললে সবাই শোনে না, আর শোনালেও বোঝে না। তাই তারা চুপ করে থাকে। এই চুপ করে থাকাই তাদের সবচেয়ে বড় পরিচয়। বাইরে থেকে দেখলে মনে হয় সব ঠিক আছে: হাসি আছে, চলাফেরা আছে, ব্যস্ততা আছে। কিন্তু ভেতরে জমে থাকে এক ধরনের অব্যক্ত ক্ষোভ, যা কাউকে আঘাত করে না, কিন্তু মানুষটিকে প্রতিদিন একটু একটু করে ক্ষয় করে দেয়।

এই প্রজন্মের হতাশা হঠাৎ জন্ম নেয়নি। এটি কোনো একদিনের ব্যর্থতা নয়, কোনো একক ঘটনার প্রতিক্রিয়াও নয়। এটি বহু বছর ধরে জমে ওঠা এক ক্লান্তি। শৈশব থেকেই তাদের শেখানো হয়েছে; ভালো করতে হবে, সেরা হতে হবে, পিছিয়ে পড়া যাবে না। কিন্তু কখনো শেখানো হয়নি; সবাই সেরা হতে পারে না, ব্যর্থতাও মানুষকে মানুষ করে। ফলে তারা বড় হয়েছে ভয় নিয়ে; ভয় ব্যর্থ হওয়ার, ভয় কম হওয়ার, ভয় অন্যদের চোখে ছোট হয়ে যাওয়ার।

তারা স্বপ্ন দেখেছিল, খুব সাধারণ স্বপ্ন; নিজের জায়গা হবে, নিজের পরিশ্রমের মূল্য পাওয়া যাবে, নিজের মতো করে বাঁচা যাবে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তারা আবিষ্কার করেছে, এই সমাজে স্বপ্ন দেখার চেয়ে স্বপ্নপূরণ করা অনেক কঠিন, আর অনেক ক্ষেত্রে অসম্ভব। এখানে যোগ্যতার চেয়ে পরিচয় বেশি কাজ করে, সততার চেয়ে চাতুর্য বেশি টিকে থাকে। এই বাস্তবতা মেনে নেওয়া সহজ নয়। তাই তারা চিৎকার না করে ভেতরে ভেতরে ভেঙে পড়ে।

এই প্রজন্ম সবচেয়ে বেশি শিক্ষিত, অথচ সবচেয়ে বেশি অনিশ্চিত। ডিগ্রির পর ডিগ্রি নিয়েও তারা নিশ্চিত হতে পারে না; আগামী বছর তারা কোথায় থাকবে, কী করবে, আদৌ কিছু করতে পারবে কি না। চাকরি পেলেও সেখানে সম্মান নেই, নিরাপত্তা নেই, স্থায়িত্ব নেই। কাজ আছে; কিন্তু স্বস্তি নেই। ফলে তাদের জীবনে এক ধরনের স্থায়ী অস্থিরতা বাসা বাঁধে। এই অস্থিরতা ধীরে ধীরে রূপ নেয় নীরব ক্ষোভে।

শহরগুলো আগের চেয়ে আরও উজ্জ্বল, আরও ব্যস্ত। আলো আছে, শব্দ আছে, মানুষের ভিড় আছে। কিন্তু এই ভিড়ের মাঝেই মানুষ সবচেয়ে একা। এই প্রজন্ম প্রতিদিন হাজারো মানুষের পাশে বসে, তবু নিজের কথা বলার কাউকে খুঁজে পায় না। তারা অফিসে দায়িত্ব পালন করে, পরিবারে প্রত্যাশা পূরণ করে, সমাজে মুখোশ পরে থাকে; কিন্তু কোথাও নিজের মতো করে শ্বাস নিতে পারে না। অনুভূতিগুলো জমে থাকে, জমতে জমতে ভারী হয়ে ওঠে, আর সেই ভার তারা নীরবে বহন করে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এই ক্ষোভকে আরও গভীর করে তোলে। প্রতিদিন চোখের সামনে ভেসে ওঠে অন্যের সাফল্য, অন্যের সুখ, অন্যের এগিয়ে যাওয়া। কেউ দেখায় না তার ব্যর্থতা, তার একাকিত্ব, তার ভাঙন। ফলে যারা পিছিয়ে পড়ে, তারা ভাবে দোষটা বুঝি আমারই। এই আত্মদোষারোপ তাদের আরও চুপ করিয়ে দেয়। তারা আর অভিযোগ করে না, প্রশ্ন তোলে না; শুধু নিজেকেই দোষ দিতে থাকে।

পরিবার, যা হওয়ার কথা ছিল আশ্রয়, অনেক সময় সেটাই হয়ে ওঠে আরেকটি চাপের জায়গা। ভালোবাসার আড়ালে লুকিয়ে থাকে প্রত্যাশা, তুলনা, ভয়, মানুষ কী বলবে। এই প্রজন্ম তাই পরিবারের কাছেও নিজের দুর্বলতা প্রকাশ করতে ভয় পায়। তারা জানে, কষ্টের কথা বললে সমাধান আসবে না, আসবে উপদেশ। তাই তারা চুপ করে থাকে, নিজের ঘরেই একা হয়ে পড়ে। এই নীরবতা ধীরে ধীরে বিশ্বাস ভাঙে। তারা সমাজে বিশ্বাস হারায়, ব্যবস্থায় আস্থা হারায়, রাজনীতিতে আগ্রহ হারায়। তারা ভাবে কথা বলে কী হবে, কিছু তো বদলাবে না। এই ভাবনাই সবচেয়ে ভয়ংকর। কারণ যখন মানুষ বিশ্বাস হারায়, তখন সে আর লড়াইও করে না। সে শুধু টিকে থাকার চেষ্টা করে।

এই নীরব ক্ষোভ হঠাৎ বিস্ফোরণ ঘটায় না। বরং মানুষকে অনুভূতিহীন করে তোলে। তারা হাসে; কিন্তু আনন্দ পায় না। সম্পর্ক রাখে; কিন্তু গভীরতা হারায়। জীবন চলে, কিন্তু জীবনের স্বাদ ম্লান হয়ে যায়। অনেকেই দিনের পর দিন শুধু সময় পার করে; বেঁচে থাকে, কিন্তু জীবিত অনুভব করে না। তবু এই প্রজন্ম পুরোপুরি ভেঙে পড়েনি। এটাই তাদের সবচেয়ে বড় শক্তি। তারা এখনও সংবেদনশীল, এখনও অন্যায়ের ভেতরে অন্যায় দেখতে পায়। তারা হয়তো চিৎকার করে না, কিন্তু ভেতরে ভেতরে প্রশ্ন করে। তাদের নীরবতার মধ্যেই লুকিয়ে আছে পরিবর্তনের সম্ভাবনা।

এই প্রজন্মকে দোষ দিয়ে কিছু হবে না। তাদের দরকার বোঝা, শোনা, সম্মান দেওয়া। দরকার এমন এক সমাজ, যেখানে মানুষ শুধু সফল হলেই মূল্যবান নয়, মানুষ হলেই মূল্যবান। হতাশ প্রজন্ম মানে ব্যর্থ প্রজন্ম নয়। তারা এমন এক প্রজন্ম, যারা অনেক কিছু সহ্য করেছে, নিঃশব্দে। তাদের নীরব ক্ষোভকে অবহেলা করলে একদিন সমাজ এমন এক জায়গায় পৌঁছাবে, যেখানে সবাই কথা বলবে, কিন্তু কেউ শুনবে না। আর ইতিহাস বলে, সবচেয়ে গভীর পরিবর্তনগুলো আসে সবচেয়ে চুপ করে থাকা মানুষের ভেতর থেকেই।