শরীফ ওসমান হাদি : এক অমর স্মৃতির নাম
প্রকাশ : ২২ ডিসেম্বর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
কিছু মৃত্যু শুধু একটি জীবনকে নিভিয়ে দেয় না; তারা সময়ের স্বাভাবিক প্রবাহকে থামিয়ে দেয়, সমাজকে বাধ্য করে নিজের দিকে তাকাতে, আর একটি সম্পূর্ণ প্রজন্মকে দাঁড় করিয়ে দেয় কঠিন আত্মজিজ্ঞাসার মুখোমুখি। শরীফ ওসমান হাদীর মৃত্যু তেমনই এক গভীর অভিঘাত, যা ব্যক্তিগত শোকের গণ্ডি ছাড়িয়ে সমষ্টিগত চেতনায় আঘাত হানে। তার প্রয়াণ শুধু একটি তরুণ প্রাণের শেষ নয়; এটি সেই স্বপ্নগুলোর ভাঙন, যা একটি প্রজন্ম বহন করে চলেছিল পরিবর্তন, ন্যায় এবং সাহসের প্রত্যয়ে।
হাদি ছিলেন এমন এক কণ্ঠ, যা নিঃশব্দ থাকতে শেখেনি। তার কথায় ছিল অন্যায়ের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান, চোখে ছিল ভবিষ্যৎ গড়ার দৃঢ় বিশ্বাস, আর মননে ছিল প্রশ্ন তোলার সাহস, যে সাহস সমাজকে অস্বস্তিতে ফেলে, কিন্তু এগিয়ে নেয়। তিনি প্রতিনিধিত্ব করতেন সেই তরুণদের, যারা ভয়কে অতিক্রম করে কথা বলতে চায়, যারা বিশ্বাস করে পরিবর্তন সম্ভব এবং যারা ন্যায়ের প্রশ্নে আপস করতে রাজি নয়। তার চলে যাওয়া তাই শুধু একজন মানুষকে হারানো নয়; এটি একটি সম্ভাবনাময় আগামীর ক্ষতি, যা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, কণ্ঠ দমিয়ে দিলে প্রশ্ন থামে না, বরং আরও গভীর হয়ে ফিরে আসে।
তরুণ বিদ্রোহের প্রতীক
২০২৪ সালের ছাত্রনেতৃত্বাধীন গণঅভ্যুত্থানে হাদি উঠে আসেন এক অগ্নিমুখী তরুণ নেতা হিসেবে। তার চোখে ছিল অন্যায়ের বিরুদ্ধে অগ্নি, তার কণ্ঠে ছিল সত্য বলার দৃঢ়তা। তিনি বিশ্বাস করতেন, রাজনীতি মানে শুধু ক্ষমতার খেলা নয়, এটি মানুষের মর্যাদা রক্ষার সংগ্রাম। সেই বিশ্বাসই তাঁকে তরুণদের কাছে এক প্রতীক করে তোলে। তখনকার বাংলাদেশ ছিল হতাশার অন্ধকারে আচ্ছন্ন। কর্তৃত্ববাদী শাসন, অর্থনৈতিক বৈষম্য, মতপ্রকাশের স্বাধীনতার সংকোচ- সব মিলিয়ে তরুণদের মনে জমে উঠেছিল ক্ষোভ। হাদি সেই ক্ষোভকে রূপ দেন সংগঠিত আন্দোলনে। তার নেতৃত্বে রাজপথে নেমে আসে হাজারো তরুণ, যারা বিশ্বাস করত পরিবর্তন সম্ভব।
আপসহীন পথচলা : অনেকেই আন্দোলনের উত্তাপ স্তিমিত হয়ে এলে নীরবে হারিয়ে যান। কিন্তু হাদী ছিলেন ব্যতিক্রম। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন, প্রতিবাদ তখনই টেকসই পরিবর্তনে রূপ নেয়, যখন তা প্রাতিষ্ঠানিক রাজনীতির ভেতরে প্রবেশ করে। সেই উপলব্ধি থেকেই তিনি সাহসিকতার সঙ্গে ঘোষণা দেন ঢাকা-৮ আসন থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে তিনি নির্বাচনে অংশ নেবেন। এটি ছিল তার জীবনের সবচেয়ে বড় ঝুঁকি, আবার একই সঙ্গে সবচেয়ে বিস্তৃত স্বপ্নের ঘোষণা।
এই সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে হাদি স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন রাজনীতি শুধু স্লোগানের শিল্প নয়, এটি দায়িত্ব গ্রহণেরও সাহসী নাম। তিনি চেয়েছিলেন তরুণদের উচ্চারিত কণ্ঠ শুধু রাজপথে সীমাবদ্ধ না থেকে জাতীয় সংসদের মেঝেতেও প্রতিধ্বনিত হোক। তার এই ঘোষণা বহু তরুণকে অনুপ্রাণিত করেছিল নতুন সম্ভাবনার পথে হাঁটতে, আবার প্রতিষ্ঠিত ক্ষমতার কাঠামোর ভেতরে অস্বস্তিও সৃষ্টি করেছিল। কারণ হাদি ছিলেন এমন এক কণ্ঠ-স্বচ্ছ, দৃঢ় এবং আপসহীন যাকে উপেক্ষা করা যেমন কঠিন, থামানোও তেমনি দুঃসাধ্য।
সেই কালো দিন : ১২ ডিসেম্বর ২০২৫। পল্টনের ব্যস্ত রাস্তায় নির্বাচনি প্রচারণার সময় হাদিকে লক্ষ্য করে গুলি চালানো হয়। মুহূর্তেই তার জীবন থেমে যায় মৃত্যুর কিনারায়। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেন, মোটরসাইকেলে আসা মুখোশধারী বন্দুকধারী খুব কাছ থেকে গুলি চালায়। গুলিটি তার মাথায় আঘাত করে, মস্তিষ্কে মারাত্মক ক্ষতি করে। আহত অবস্থায় তাঁকে দ্রুত ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। পরে এভারকেয়ার হাসপাতাল এবং অবশেষে সিঙ্গাপুরে স্থানান্তর করা হয়। ছয় দিন ধরে তিনি মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে যান। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ১৮ ডিসেম্বর সিঙ্গাপুরে মৃত্যুর কাছে হার মানেন। মাত্র ৩২ বছর বয়সে তার জীবন থেমে যায়।
জাতির শোক : হাদির মৃত্যুসংবাদ ছড়িয়ে পড়তেই বাংলাদেশ যেন স্তব্ধ হয়ে যায়। রাজপথে শোকের ঢেউ, মানুষের চোখে অশ্রু আর ক্ষোভ। কেউ তাঁকে স্মরণ করে নীরব শ্রদ্ধায়, কেউ আবার তার নাম ধরে স্লোগান তোলে। তার মৃত্যুতে যেন প্রতিটি তরুণ নিজের স্বপ্নের মৃত্যু দেখেছে। নোবেলজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার গভীর শোক প্রকাশ করে এবং এক দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করে। কিন্তু রাজপথে শোকের সঙ্গে সঙ্গে ক্ষোভও ছড়িয়ে পড়ে। মানুষ বিশ্বাস করছিল, এটি শুধু একটি হত্যাকাণ্ড নয়; এটি ছিল একটি প্রজন্মের কণ্ঠকে স্তব্ধ করার চেষ্টা।
রাজপথের প্রতিধ্বনি : ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন বড় শহরে ছড়িয়ে পড়ে গণবিক্ষোভ। বিক্ষোভকারীরা গুরুত্বপূর্ণ সড়ক অবরোধ করে, স্লোগানে মুখর করে তোলে নগরজীবন। অনেকেই এটিকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হত্যাকাণ্ড হিসেবে দেখেন এবং বিচারের দাবিতে সোচ্চার হন। ক্ষোভ একপর্যায়ে কোথাও কোথাও তা ধ্বংসাত্মক আকার ধারণ করে। গণমাধ্যম কার্যালয়ে হামলার ঘটনাও ঘটে, যা শুধু শোকের বহিঃপ্রকাশ ছিল না; বরং সেইসব প্রতিষ্ঠানের প্রতি গভীর অবিশ্বাসের প্রতিফলন। এই প্রতিধ্বনি ছিল এক জাতির হৃদয়ের স্পন্দন। মানুষ বলছিল, হাদি হয়তো চলে গেছেন, কিন্তু তার কণ্ঠকে স্তব্ধ করা যায়নি। তার নাম হয়ে উঠেছিল প্রতিরোধের প্রতীক।
রাজনৈতিক ব্যবস্থার ভঙ্গুরতা : শরীফ ওসমান হাদির হত্যাকাণ্ড বাংলাদেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থার ভঙ্গুরতা নগ্ন করে দিয়েছে। তরুণ বাংলাদেশিদের কাছে তিনি ছিলেন এক সম্ভাবনার প্রতীক যে রাজনীতি নীতির ওপর দাঁড়াবে, দলীয় পৃষ্ঠপোষকতার ওপর নয়। তার ওপর হামলা এবং পরবর্তী অস্থিরতা নিয়ন্ত্রণে সরকারের তৎপরতা আইনশৃঙ্খলা ও জবাবদিহির গুরুতর দুর্বলতা সামনে এনেছে।
বিশেষ করে ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠেয় জাতীয় নির্বাচনের প্রাক্কালে রাজনৈতিক সহিংসতার আশঙ্কা আরও ঘনীভূত হয়েছে। যদিও নিরাপত্তা সংস্থাগুলো তদন্ত শুরু করেছে, অভিযুক্তদের ধরতে অভিযান ও পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে, তবুও সাধারণ মানুষের আস্থা ফিরছে না। সমালোচকদের মতে, দৃশ্যমান অগ্রগতির ধীরগতি এই আশঙ্কাকেই জোরদার করছে যে দায়মুক্তির সংস্কৃতিতে রাজনৈতিক সহিংসতা এখনও টিকে আছে।
উত্তরাধিকার ও প্রতীকী শক্তি : শরীফ ওসমান হাদির উত্তরাধিকার গভীর ও বহুমাত্রিক। তার অনুসারীদের কাছে তিনি ছিলেন তারুণ্যের বিদ্রোহ, নৈতিক সততা ও গণতান্ত্রিক আদর্শের প্রতীক—একজন সাহসী নেতা, যিনি একটি বিকৃত ব্যবস্থাকে বদলাতে সর্বস্ব ত্যাগে প্রস্তুত ছিলেন। তার মুখোমুখি ও আপসহীন রাজনীতি অনেক সময় বিতর্কের জন্ম দিলেও, তা এক মেরুকৃত সমাজে ক্ষমতার সামনে সত্য বলার সাহসকে উন্মোচিত করেছে। তার জীবন প্রমাণ করে, নীতির পক্ষে দাঁড়ানো যতই বিপজ্জনক হোক না কেন, তা গণতন্ত্রকে দুর্বল করে না; বরং আরও শক্ত ভিত দেয়। তিনি জীবিত থাকাকালে নিজের রাজনৈতিক ভাবনাগুলোকে নির্বাচনী ময়দানে পুরোপুরি বাস্তবায়নের সুযোগ পাননি। তবে মৃত্যুর পর তার গল্প ব্যক্তিগত উচ্চাকাঙ্ক্ষার সীমা ছাড়িয়ে রূপ নিয়েছে জাতীয় স্মৃতির এক বৃহত্তর আখ্যান হিসেবে যেখানে সাহস, ভয়, প্রতিরোধ এবং রাজনৈতিক অংশগ্রহণের সীমারেখা একসঙ্গে মিশে গেছে।
তরুণ প্রজন্মের জন্য শিক্ষা : হাদির মৃত্যু তরুণ প্রজন্মকে এক কঠিন শিক্ষা দিয়েছে। রাজনীতি শুধু ক্ষমতার খেলা নয়; এটি নৈতিকতার প্রশ্নও। তার জীবন দেখিয়েছে, সত্য বলার সাহসই সবচেয়ে বড় শক্তি। তরুণদের কাছে তিনি হয়ে উঠেছেন এক অনুপ্রেরণা যে রাজনীতি নীতির ওপর দাঁড়ায়, যে প্রতিবাদকে পরিবর্তনের হাতিয়ার বানায়। তার নাম উচ্চারণ মানেই এক অমর স্মৃতিকে জাগিয়ে তোলা। তার গল্প তরুণদের মনে জাগিয়ে দেয় প্রশ্ন- আমরা কি তার স্বপ্নকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারব? আমরা কি তার সাহসকে নিজেদের জীবনে ধারণ করতে পারব?
হাদী হয়তো আর নেই, কিন্তু তার গল্প বেঁচে আছে। তার সাহস, তার আপসহীনতা, তার স্বপ্ন সবকিছুই আজ জাতীয় স্মৃতির অংশ। তিনি আমাদের শিখিয়েছেন, সত্য বলার সাহসই সবচেয়ে বড় শক্তি। তার নাম উচ্চারণ মানেই এক অমর স্মৃতিকে জাগিয়ে তোলা। তার মৃত্যুকে ঘিরে যে শোকের ঢেউ উঠেছিল, তা এখনো স্তব্ধ হয়ে যায়নি। আজও তার নাম ধ্বনিত হয় স্লোগানে, তার ছবি বহন করা হয় মিছিলের সারিতে শুধু স্মৃতির ভার হিসেবে নয়, বরং প্রতিরোধের প্রতীক হিসেবে। তিনি অনুপস্থিত, কিন্তু তার আদর্শ অনড়; সময় এগিয়ে যায়, অথচ তার রেখে যাওয়া প্রশ্নগুলো এখনও বাতাসে ভাসে, উত্তর খোঁজে নতুন কণ্ঠে।
