গণতন্ত্র বনাম স্বৈরতন্ত্র : একুশ শতকের বাস্তব চিত্র

আরিফুল ইসলাম রাফি, শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ

প্রকাশ : ২৩ ডিসেম্বর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

২১ শতকের রাজনীতি এমন এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে, যেখানে বিশ্বের সর্বাধিক আলোচিত দুই রাজনৈতিক ব্যবস্থা- গণতন্ত্র ও স্বৈরতন্ত্র নতুন করে পরস্পরের মুখোমুখি। মানবসভ্যতার দীর্ঘ ইতিহাসে নানা ধরনের শাসনব্যবস্থার উত্থান-পতন দেখেছি আমরা। রাজতন্ত্র থেকে সামন্ততন্ত্র, উপনিবেশবাদ থেকে জাতীয়তাবাদ, সামরিক শাসন থেকে গণতন্ত্র; সবই সময়ের চাহিদা অনুযায়ী পরিবর্তিত হয়েছে। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যে ধারণাটি সর্বাধিক গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিল, তা হলো গণতন্ত্র। মনে করা হয়েছিল, গণতন্ত্রই মানবমুক্তির পথ, রাষ্ট্রের জবাবদিহি ও নাগরিক স্বাধীনতার সর্বোচ্চ নিশ্চয়তা। কিন্তু ২১শ’ শতকে এসে সেই ধারণার ভিত্তি যেন কেঁপে উঠতে শুরু করেছে।

আজকের বিশ্বে গণতন্ত্র আছে, কিন্তু তার অন্তরস্থ প্রাণশক্তি কমে গেছে। বহু দেশে নির্বাচন হয়, সংসদ আছে, বিচারব্যবস্থার কাঠামো আছে, কিন্তু সেই কাঠামোগুলো কার্যকর নয় বা কার্যকর হলেও ক্ষমতাকেন্দ্রিক দলীয় স্বার্থের কাছে দুর্বল। গণতন্ত্রের ভিত্তি তিনটি: জনগণের অংশগ্রহণ, সরকারের জবাবদিহি এবং নাগরিক স্বাধীনতা। এই তিনটিই বিভিন্নভাবে চাপে পড়েছে। জনসাধারণ রাজনৈতিকভাবে সচেতন হলেও সিদ্ধান্ত গ্রহণে তাদের প্রভাব কমছে। কারণ, অর্থনৈতিক বৈষম্য রাজনীতিকে ধনীদের হাতে কেন্দ্রীভূত করেছে। নির্বাচনে অংশ নিতে অর্থ প্রয়োজন, প্রচারযুদ্ধ পরিচালনা করতে অর্থ প্রয়োজন। ফলে রাজনীতি ধীরে ধীরে সাধারণ মানুষের হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে।

এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে প্রযুক্তিনির্ভর নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও ডেটা-ভিত্তিক নজরদারি এখন রাষ্ট্র ও কর্পোরেট উভয়ের হাতে মানুষের ব্যক্তিগত জীবনকে উন্মুক্ত করে দিয়েছে। গণতন্ত্র যেখানে নাগরিক স্বাধীনতা ও গোপনীয়তা রক্ষা করার কথা বলে, সেখানে প্রযুক্তি ব্যবহারের অজুহাতে নাগরিকের ওপর রাষ্ট্রীয় নজরদারি বাড়ছে। আরেক বিপদ এসেছে ভুয়া তথ্য ও প্রোপাগান্ডা থেকে। গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি সত্য; কিন্তু আজ সত্য ও মিথ্যার পার্থক্যকে অস্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। ভুয়া খবরের সুনামিতে সমাজ বিভক্ত হচ্ছে, মানুষ বাস্তবতার বদলে আবেগ ও ষড়যন্ত্র তত্ত্বকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। এর ফলেই জনপ্রিয়তাবাদী নেতাদের উত্থান ঘটছে, যারা জটিল সমস্যার সহজ সমাধান দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে জনতাকে আবেগের দোলনায় ভাসায়। এদের লক্ষ্য সাধারণত বিচারব্যবস্থা দুর্বল করা, গণমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করা, এবং গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের ওপর মানুষের আস্থা কমিয়ে দেওয়া। ফলে গণতন্ত্র থেকে জন্ম নেয় এক ধরনের অদৃশ্য স্বৈরতন্ত্র, যাকে বলা যায় ‘গোপন স্বৈরতন্ত্র’, যেখানে ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন হয় কিন্তু গণতন্ত্রের মুখোশ অটুট থাকে।

অন্যদিকে স্বৈরতন্ত্রও বদলে গেছে। একসময় স্বৈরতন্ত্র মানেই ছিল রক্তচোষা একনায়ক, সেনাবাহিনীর ট্যাংক, রাজনৈতিক দমন-পীড়ন, সেন্সরশিপ। সেই চিত্র এখনও আছে, কিন্তু একে বলা যায় ২০শ শতকের স্বৈরতন্ত্র। ২১শ শতকে স্বৈরতন্ত্র অনেক বেশি চতুর, কৌশলী এবং প্রযুক্তিনির্ভর। এখন স্বৈরতন্ত্রের প্রধান কৌশল হলো, গণতন্ত্রকে দেখানো, কিন্তু ভিতর থেকে তাকে নিষ্ক্রিয় করে দেওয়া। একটি সরকার জনমত জরিপ করে, নির্বাচন আয়োজন করে, সংসদ চালায়; তবে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে এমনভাবে, যাতে আসল সিদ্ধান্ত সবসময় ক্ষমতাসীনদের হাতে থাকে। বিরোধী দল থাকে, কিন্তু দুর্বল; গণমাধ্যম থাকে, কিন্তু ক্ষমতার কাছে জবাবদিহি করতে পারে না; বিচারব্যবস্থা থাকে, কিন্তু স্বাধীন নয়। একে বলা হয় ‘হাইব্রিড রেজিম’ অর্থাৎ গণতন্ত্র ও স্বৈরতন্ত্রের মিশ্র শাসনব্যবস্থা। বাহ্যিকভাবে গণতন্ত্র, ভেতরে স্বৈরতন্ত্র।

বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে এই দুই ধারার সংঘাত ভিন্নভাবে প্রকাশ পাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে গণতন্ত্র আছে, কিন্তু রাজনৈতিক মেরুকরণ ভয়ঙ্করভাবে বেড়েছে। আমেরিকায় জাতিগত বিভাজন, অর্থনৈতিক বৈষম্য, কর্পোরেট শক্তির আধিপত্য এবং পপুলিস্ট রাজনীতির উত্থান গণতন্ত্রের ভিত্তিকে দুর্বল করছে। ইউরোপেও অভিবাসন সংকট ও জাতীয়তাবাদী রাজনীতির উত্থান গণতন্ত্রের স্থিতি প্রশ্নবিদ্ধ করছে। একসময় ইউরোপ-আমেরিকা যে উদাহরণ দেখিয়ে বিশ্বের অন্যান্য দেশে গণতন্ত্র প্রচার করত, আজ তারা নিজেরাই গণতন্ত্রের সংকটে পড়েছে।

মধ্যপ্রাচ্যে গণতন্ত্র কখনই গভীরভাবে শেকড় গাঁড়তে পারেনি।