ত্রয়োদশ নির্বাচন : রাষ্ট্র, রাজনীতি ও সমাজের সম্মিলিত অগ্নিপরীক্ষা
ফাইজুল ইসলাম
প্রকাশ : ২৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

আসন্ন ত্রয়োদশ সাংসদ নির্বাচনকে ঘিরে জনগণের মধ্যে নতুন আশার সঞ্চার হয়েছে। বিগত বছরগুলোর পর জনগণ আবার চেয়েছে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হোক। একটি জরিপে দেখা যায়, সমানসংখ্যক নারী প্রার্থী মনোনয়নের পক্ষে জনসমর্থন উল্লেখযোগ্য হারে রয়েছে। আবার কিছুটা বেশি নারী মনোনয়নের পক্ষে সমর্থনও বাড়ছে বিগত সংসদ নির্বাচনের থেকে। অথচ একটি বড় অংশ যাদের জনসমর্থন অনেক বেশি আগের চেয়ে কম নারী মনোনয়ন বা একেবারেই না দেওয়ার পক্ষে মত দিয়েছে এমন অনেকেই- যা আমাদের সমাজের দ্বিধাবিভক্ত মানসিকতাকেই প্রতিফলিত করে আক্ষরিকভাবেই। সংবিধানের ২৭, ২৮ ও ৬৫ অনুচ্ছেদের আলোকে সমতা, ন্যায্যতা, বৈষম্যহীনতা এবং সংসদে প্রতিনিধিত্বের যে অঙ্গীকার বা দায়বদ্ধতা তা শুধু সংরক্ষিত আসনের মাধ্যমে পূরণ হয় না আদতে। রাজনৈতিক দলের মনোনয়ন প্রক্রিয়ায় নারীর অন্তর্ভুক্তি বাড়ানো একটি সময়ের দাবি- এটি সাংবিধানিক নৈতিকতার অংশ সভ্যতার এই ক্রান্তিলগ্নে। আমি যদি ধরে নিই ত্রয়োদশ নির্বাচন যদি সত্যিই নতুন মানদ- স্থাপন করতে চায় তবে দলীয় মনোনয়ন থেকে নির্বাচনি প্রচার কার্যক্রম এর অংশ হোক- সব স্তরেই নারীর অংশগ্রহণ দৃশ্যমান করতে হবে, কারণ বড় একটা অংশকে নামমাত্র পঞ্চাশটি আসনে বিভক্ত করা বৈষম্যের শামিল।
সরকারের সাফল্য-ব্যর্থতা ও সংস্কারের প্রশ্ন : জরিপে সরকারের দেশ চালানো নিয়ে সন্তুষ্টি ও অসন্তুষ্টির মিশ্র চিত্র ও প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়। জনগণ মনে করে অর্থনীতি, অবকাঠামো, সামাজিক সুরক্ষা- কিছু ক্ষেত্রে ভালো অগ্রগতি থাকলেও দ্রব্যমূল্য, কর্মসংস্থান, সুশাসন, আইনশশৃঙ্খলা ও দুর্নীতির প্রশ্নে হতাশা প্রকটভাবে দেখা যায়। বর্তমান সংস্কারে আরও সফল হতে না পারার দায় মূলত কার এই প্রশ্নে মতভেদ থাকলেও একটি বিষয় স্পষ্ট সংস্কার রাজনৈতিক সদিচ্ছা জনগণের সহায়তা, ঐক্যবদ্ধ প্রতিক্রিয়া ও প্রতিষ্ঠানগত সক্ষমতার সমন্বয় ছাড়া সম্ভব নয়।
বাংলাদেশ সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদে জনগণের ঐকান্তিক সার্বভৌমত্বের কথা বলা হয়েছে অর্থাৎ রাষ্ট্রযন্ত্রের আধুনিক সংস্কার মানে জনগণের আস্থার সংস্কার হবে তার আশার চূড়ান্ত প্রতিফলন ঘটিয়ে। রাজনৈতিক দার্শনিকরা মনে করেন, Before the formal adjudication the incumbent government has the responsibility to ensure the situation of lwa enforcing agencies, rule of lwa and access to legal protection from the required authority. Otherwise during the election,it will be undermined due elements of injustice. নির্বাচনপূর্ব সংস্কার- বিশেষত নির্বাচন কমিশনের সক্ষমতা, তার গ্রহণযোগ্যতা এবং বিচারিক জবাবদিহি- এই তিনটি স্তম্ভ খুব বেশি মজবুত না হলে ভোটের গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ থাকবে, ব্যর্থ হবে সরকারের উন্নয়ন পসরা।
ধর্মভিত্তিক রাজনীতি ও সাংবিধানিক ধর্মনিরপেক্ষতা : ধর্মভিত্তিক দলের প্রভাব বাড়ছে কি না এ ব্যাপারে ভালো বলতে পারবে দেশের তৃণমূল- এ প্রশ্নে জনমত উদ্বিগ্ন সকল দলের মধ্যেই। সংবিধানের প্রস্তাবনায় ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ পুনঃস্থাপিত হলেও বাস্তব রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার খুব একটা নতুন নয়। পাকিস্তানে কোন সরকার এক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলে, ডিজেল মাওলানা হত একমাত্র হাতিয়ার, এ দলে দলবল নিয়ে যোগ দিত এরাই হত সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। সমস্যা ধর্ম নয়; সমস্যা হলো রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারণে ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার বানিয়ে স্বার্থ হাসিল করা। আমি মনে করি ত্রয়োদশ নির্বাচন যদি শান্তিপূর্ণ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক হতে চায় তবে প্রচার-প্রচারণায় ঘৃণাভাষা, বিদ্বেষমূলক ভাষা, ধর্মকে ঢাল হিসেবে বানিয়ে প্রচারণা, বিভাজনমূলক বক্তব্য এবং সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা- এসব বিষয়ে জিরো টলারেন্স নীতি অপরিহার্য এবং সরকারকে অবশ্যই নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে।
সেনাবাহিনীর ভূমিকা : সংবিধানসম্মত সীমা : নির্বাচনকালীন আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সবচেয়ে বড় ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারে সেনাবাহিনী আমাদের সংবিধান অনুযায়ী সশস্ত্র বাহিনী বেসামরিক কর্তৃত্বের অধীন।এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সহায়ক ভূমিকা থাকতে পারে; কিন্তু নির্বাচনি ব্যবস্থাপনায় সিদ্ধান্তমূলক ভূমিকা আদৌ নয়, আমাদের রাজনৈতিক চর্চাও নেই এ ব্যাপারে। জনগণের আস্থা ফেরাতে হলে দায়িত্বের সীমারেখা স্পষ্ট করা জরুরি বলে আমি মনে করি- এটি গণতন্ত্রের জন্য যেমন প্রয়োজন সর্বাত্মকভাবে, তেমনি সশস্ত্র বাহিনীর পেশাদারিত্ব রক্ষার জন্যও আশু প্রয়োজন।
আয়-ব্যয় ও জীবনের বাস্তবতা : মানুষের আয় বেড়েছে নাকি কমেছে- এই প্রশ্নে হতাশার সুর স্পষ্ট হওয়া জরুত। কারণ সংবিধানের ১৫ অনুচ্ছেদে মৌলিক চাহিদা পূরণের রাষ্ট্রীয় দায়ের কথা বলা হয়েছে; কিন্তু তা জুডিশিয়ালি এনফোরসিয়াবল না। ভোটাররা যখন পকেটের কষ্টে নাকাল হয়ে আছেন, তখন উন্নয়নের বয়ান তাদের কাছে অর্থহীন শোনায় এবং শোনাবে। আশার কথা হল ত্রয়োদশ নির্বাচনে যে দলই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করুক না কেন, তাদের ইশতেহারে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, বেকারদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি, সামাজিক নিরাপত্তা এবং সামাজিক সুরক্ষার বাস্তবসম্মত রূপরেখা থাকতে হবে সকল দলের ইশতেহারে।
নির্বাচন কমিশন ও মাঠের সমতা : কোন দলের বেশি আসন জেতার সম্ভাবনা এটা সবচেয়ে বড় প্রশ্ন- এ নিয়ে জনমত থাকলেও নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব হলো মাঠ সমান রাখা আমাদের প্রয়োজনে। সংবিধানের ১১৮ অনুচ্ছেদ নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীন ও শক্তিশালী করার নির্দেশ দেয় নির্বাচনকালীন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করার জন্য। তাদের কাজ হবে মনোনয়ন যাচাই, আচরণবিধি প্রয়োগ, প্রশাসনের নিরপেক্ষতা- এসব ক্ষেত্রে দৃশ্যমান কঠোরতা না থাকলে নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হবে এবং তা হবে আমাদের জন্য বিপ্লোবোত্তর সবচেয়ে বড় হতাশা। তাদের আরো কাজ হবে মিডিয়ার স্বাধীনতা ও নাগরিক পর্যবেক্ষণ নিশ্চিত করা।
নতুন সংবিধানের আলোকে- কী অর্থে ‘নতুন’? ‘নতুন সংবিধান’ কথাটি অনেকে আক্ষরিক অর্থে নিতে হবে। বাস্তবে প্রয়োজন ‘নতুন সাংবিধানিক চর্চা’। সংবিধান সংশোধন একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া যা নির্বাচনের আগে সম্ভব, না ; কিন্তু তার আগেই আইন প্রয়োগ, গণভোট, প্রতিষ্ঠানগত স্বাধীনতা এবং রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরিবর্তন আনা সম্ভব বলে আমি মনে করি। ত্রয়োদশ নির্বাচন এই ‘নতুন চর্চা’র পরীক্ষাগার হতে পারে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, যেখানে স্বচ্ছতা, অংশগ্রহণ, সুশাসন ও জবাবদিহি হবে প্রধান মাপকাঠি, সেই সঙ্গে এই সরকারের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
আশার জায়গা, হতাশার শিক্ষা : আশা আছে কারণ জনগণ এখন প্রশ্ন করছে, সব জানতে চাইছে, জরিপে মত দিচ্ছে, প্রতিনিধিত্ব ও সংস্কারের দাবি তুলছে তৃণমূল থেকে। হতাশা আছে- কারণ আগের অভিজ্ঞতা আস্থা ক্ষয় করেছে ঠিকই। কিন্তু গণতন্ত্রের সৌন্দর্য এখানেই যে সবাই সবার সমালোচনা করতে পারবে- এটি আত্মসংশোধনের সুযোগ দেয় সবাইকে। রাজনৈতিক দলগুলো যদি নারী প্রতিনিধিত্ব বাড়ায় তাদের দলে, ধর্মীয় বিভাজন এড়িয়ে চলে নির্বাচনকে প্রধান্য দিয়ে, অর্থনৈতিক বাস্তবতায় মনোযোগ দেয় এবং সাংবিধানিক সীমা মানে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, তবে আগামীর সংসদ নির্বাচন একটি ইতিবাচক মোড় নিবে রাজনৈতিকভাবে।
এছাড়াও ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন বাংলাদেশের জন্য একটি অগ্নিপরীক্ষা হবে আগামীর দিনে- সংবিধান কতটা জীবন্ত ও অর্থবহ হবে, প্রতিষ্ঠানগুলো কতটা সক্ষম হবে, আর রাজনীতি কতটা দায়িত্বশীল হবে তার পরীক্ষা হবে আগামীর নির্বাচনে। জনগণের জরিপ আমাদের দেখিয়েছে জনগণ শুধু ভোট দিতে নয়, তারা চায় ভালো শাসন, জনগণের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা যেন সফল হয়, সমতা ও মর্যাদা পেতে চায়। এই চাওয়াকে উপেক্ষা করলে হতাশা আরও গভীর হবে সামনের দিনগুলোতে; সম্মান জানালে আশা হবে আরও শক্তিশালী। আমরা বলতে চাই রাষ্ট্র, রাজনীতি ও সমাজ- তিনের সম্মিলিত প্রজ্ঞাতেই এই নির্বাচন হতে পারে সত্যিকার অর্থে জাতীয় ও সাংবিধানিক সংস্কৃতির সবচেয়ে বড় মানদ-।
ফাইজুল ইসলাম
লেকচারার, আইন বিভাগ, প্রাইম ইউনিভার্সিটি
