অনলাইনে জুয়ার মহামারি
আরিফুল ইসলাম রাফি
প্রকাশ : ২৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

অনলাইনে জুয়ার মহামারি এখন আর কোনো বিচ্ছিন্ন সামাজিক ব্যাধি নয়, এটি ধীরে ধীরে একটি নীরব জাতীয় সংকটে রূপ নিয়েছে। প্রযুক্তির অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে মানুষের জীবনে যেমন সহজতা এসেছে, তেমনি সেই প্রযুক্তির অন্ধকার দিকও ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে।
এক সময় জুয়া ছিল নির্দিষ্ট কিছু জায়গা, গোপন আসর কিংবা সীমিত মানুষের মধ্যে আবদ্ধ। আজ সেই জুয়া স্মার্টফোনের পর্দায় ঢুকে পড়েছে, মানুষের হাতের মুঠোয় বন্দি হয়ে গেছে। সকাল থেকে রাত, ঘুমানোর আগমুহূর্ত পর্যন্ত মানুষ এখন এক ক্লিক দূরত্বে জুয়ার দুনিয়ায় প্রবেশ করতে পারছে। এই সহজলভ্যতাই অনলাইন জুয়াকে মহামারির মতো ছড়িয়ে দিয়েছে।
অনলাইন জুয়ার সবচেয়ে ভয়ংকর দিক হলো, এটি নিজেকে খেলাধুলা, বিনোদন কিংবা সহজ আয়ের মোড়কে উপস্থাপন করে। ফুটবল ম্যাচ, ক্রিকেট টুর্নামেন্ট, ক্যাসিনো গেম, লুডু; সবকিছুই আজ অ্যাপের ভেতর ঢুকে গেছে।
ব্যবহারকারীদের আকৃষ্ট করতে দেওয়া হচ্ছে ফ্রি বোনাস, ক্যাশব্যাক, আকর্ষণীয় বিজ্ঞাপন। তরুণদের সামনে এই জুয়া কোনো অপরাধ বা নৈতিক বিচ্যুতি হিসেবে নয়, বরং আধুনিক ও স্মার্ট বিনোদন হিসেবে হাজির হচ্ছে। ফলে তারা বুঝতেই পারছে না কখন এই খেলাই তাদের জীবনের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিচ্ছে।
বাংলাদেশের মতো দেশে অনলাইন জুয়া আরও বেশি বিপজ্জনক হয়ে উঠছে সামাজিক বাস্তবতার কারণে। বেকারত্ব, আর্থিক অনিশ্চয়তা, দ্রুত বড়লোক হওয়ার স্বপ্ন; সব মিলিয়ে তরুণ সমাজ মানসিকভাবে দুর্বল এক অবস্থানে দাঁড়িয়ে আছে। অনলাইন জুয়া সেই দুর্বলতার সুযোগ নেয়।
একশ টাকা দিয়ে শুরু হওয়া খেলাটি কখন যে হাজার, তারপর লাখ টাকায় পৌঁছে যায়, তা খেলোয়াড় নিজেও টের পায় না। হারলে মনে হয়, ‘আরেকবার খেললেই হয়তো সব উঠে আসবে।’ এই মানসিক ফাঁদই জুয়ার মূল শক্তি। মানুষ হারতে হারতে আরও বেশি ঝুঁকি নেয়, আর সেই ঝুঁকিই তাকে সর্বনাশের দিকে ঠেলে দেয়।
অনলাইন জুয়ার আরেকটি মারাত্মক দিক হলো, এটি পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন ভেঙে দিচ্ছে। যে তরুণটি একসময় পরিবারের হাল ধরার স্বপ্ন দেখত, সে আজ ঋণের বোঝায় নুয়ে পড়ছে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, জুয়া খেলতে গিয়ে মানুষ ধার নিচ্ছে, সুদের টাকা নিচ্ছে, এমনকি চুরি ও প্রতারণার পথেও হাঁটছে। সংসারে অশান্তি বাড়ছে, বিশ্বাস ভেঙে যাচ্ছে। স্ত্রী স্বামীর ওপর আস্থা হারাচ্ছে, বাবা-মা সন্তানকে চিনতে পারছে না।
একটি অ্যাপের ভেতরের এই ভার্চুয়াল খেলাই বাস্তব জীবনে বাস্তব ধ্বংস ডেকে আনছে।
মানসিক স্বাস্থ্যের দিক থেকেও অনলাইন জুয়া ভয়াবহ ক্ষতি করছে। দীর্ঘ সময় পর্দার সামনে বসে থাকা, টানা হারার হতাশা, আবার জয়ের মিথ্যা আশায় বাঁচা; সব মিলিয়ে একজন মানুষ ধীরে ধীরে মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে। উদ্বেগ, বিষণ্নতা, অনিদ্রা, রাগ; এসব এখন নিয়মিত সঙ্গী হয়ে ওঠে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, জুয়া-আসক্ত ব্যক্তি নিজের ব্যর্থতার দায় পরিবার বা সমাজের ওপর চাপাতে শুরু করে। এই মানসিক অস্থিরতা কখনও কখনও আত্মহত্যার মতো চরম সিদ্ধান্তের দিকেও ঠেলে দেয়, যা সমাজের জন্য এক গভীর ট্র্যাজেডি। অনলাইন জুয়া সমাজে অন্যান্য অপরাধ বৃদ্ধিতেও ভূমিকা রাখছে। চুরি, ইভটিজিং, মাদক, ছিনতাই, ধর্ষণসহ সমাজের নানা অপরাধের অন্যতম কারণ এই অনলাইন জুয়া।
সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো, অনলাইন জুয়ার বিস্তারে একটি শক্তিশালী চক্র সক্রিয় রয়েছে। দেশি-বিদেশি সার্ভার, ভুয়া ওয়েবসাইট, বেনামী লেনদেন; সবকিছু মিলিয়ে এটি এখন একটি সংগঠিত অপরাধে পরিণত হয়েছে। মোবাইল ব্যাংকিং ও ডিজিটাল লেনদেন ব্যবস্থাকে ব্যবহার করে খুব সহজেই টাকা আদান-প্রদান হচ্ছে। অনেক সময় সাধারণ মানুষ বুঝতেই পারে না, তারা যে অ্যাপে টাকা দিচ্ছে, সেটি আসলে কোন দেশের, কারা চালাচ্ছে, বা সেই টাকা কোথায় যাচ্ছে। রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ দুর্বল হলে এই চক্র আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে।
আইন আছে, নিষেধাজ্ঞা আছে; কিন্তু বাস্তব প্রয়োগে বড় ঘাটতি রয়ে গেছে। অনলাইন জুয়া যেহেতু চোখে দেখা যায় না, তাই এটিকে নিয়ন্ত্রণ করাও কঠিন হয়ে পড়ে। অনেক সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বা নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো প্রযুক্তিগত দিক থেকে পিছিয়ে থাকে। অন্যদিকে, জুয়া চক্র প্রযুক্তিকে নিজেদের পক্ষে ব্যবহার করে দ্রুত রূপ বদলায়, নতুন অ্যাপ আনে, নতুন কৌশল নেয়। এই অসম লড়াইয়ে সাধারণ মানুষই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
তবে এই সংকট থেকে উত্তরণের পথ একেবারে বন্ধ নয়। প্রথমত, পরিবারকে সচেতন হতে হবে। সন্তান কী করছে, কোন অ্যাপ ব্যবহার করছে, কীভাবে টাকা খরচ করছে; এসব বিষয়ে খোঁজ রাখা জরুরি। দ্বিতীয়ত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অনলাইন জুয়ার ক্ষতিকর দিক নিয়ে আলোচনা ও সচেতনতা বাড়াতে হবে। শুধু আইন দিয়ে নয়, নৈতিক শিক্ষা ও সামাজিক মূল্যবোধ দিয়েও এই আসক্তির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। পাশাপাশি রাষ্ট্রকে প্রযুক্তিগত সক্ষমতা বাড়িয়ে অনলাইন জুয়ার বিরুদ্ধে কঠোর ও কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।
অনলাইনে জুয়ার মহামারি আসলে আমাদের সময়ের এক কঠিন পরীক্ষা। এটি শুধু কিছু ব্যক্তির পতনের গল্প নয়, এটি একটি প্রজন্মের ভবিষ্যৎ প্রশ্নের মুখে ফেলে দিচ্ছে।
এখনই যদি আমরা এই সমস্যাকে গভীরভাবে না দেখি, যদি এটিকে ব্যক্তিগত দুর্বলতা বলে এড়িয়ে যাই, তাহলে সামনে আরও বড় সামাজিক বিপর্যয় অপেক্ষা করছে। প্রযুক্তি আমাদের হাতিয়ার হতে পারে, কিন্তু সেই প্রযুক্তি যদি আমাদের সর্বনাশের কারণ হয়ে দাঁড়ায়, তবে সময় এসেছে থামার, ভাবার এবং সম্মিলিতভাবে প্রতিরোধ গড়ে তোলার।
আরিফুল ইসলাম রাফি
শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ
