শীতকালে বাংলার অবহেলিত কৃষকের আর্তনাদ

ড. মো. আনোয়ার হোসেন

প্রকাশ : ২৯ ডিসেম্বর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

ভোরের কুয়াশাচ্ছন্ন চাদর যখন প্রকৃতিকে মুড়িয়ে দেয়, যখন হাড়কাঁপানো শীতে অধিকাংশ মানুষ লেপ-কম্বলের ওমে উষ্ণতা খোঁজে, ঠিক তখনই থরথর কাঁপুনি নিয়ে কর্দমাক্ত মাঠে নামেন বাংলার একজন কৃষক। মাঘের হাড়কাঁপানো হিমেল হাওয়া যার হাড়ের ভেতর গিয়ে বিঁধে, সেই মানুষটিই আমাদের অন্ন জোগানদাতা। বাংলার চিরায়ত লোকজ ঐতিহ্যে শীত উৎসবের ঋতু হলেও, কৃষকের জীবনে এটি এক অমানবিক সংগ্রামের অধ্যায়। যার ঘামে ভেজা মাটিতে আমাদের থালায় অন্ন জোটে, সেই কৃষকের জীবন কেন জীর্ণ, কেন তার দুচোখে শুধুই হাহাকার ? কৃষক আমাদের সমাজের মেরুদণ্ড হলেও তাদের জীবন চরম অবহেলা আর বঞ্চনায় কাটে। বিশেষ করে শীত মৌসুমে তাদের কষ্ট বর্ণনাতীত।

কৃষক প্রকৃতির সেবক। তীব্র গরম, অবিরাম বর্ষা কিংবা হাড়কাঁপানো শীত- কোনোটিই তাকে মাঠ থেকে দূরে রাখতে পারে না। তারা শীতের কুয়াশার চাদর ভেদ করে বীজতলা তৈরি ও চারা রোপণ করেন। বর্ষায় হাঁটু সমান কাদা-পানিতে ভিজে ধান রোপণ করেন। গ্রীষ্মকালে প্রখর রোদে পুড়ে ফসল কাটা ও মাড়াই করেন। এই আত্মত্যাগকে শুধু পেশা বলা যায় না, বরং এটি মানবজাতির প্রতি এক মহান সেবা।

বাংলাদেশের অধিকাংশ কৃষকই প্রান্তিক। তাদের নিজস্ব জমি নেই বললেই চলে; অধিকাংশ বর্গা চাষি। সার, বীজ, কীটনাশক ও সেচের উচ্চমূল্য মেটাতে গিয়ে তারা মহাজন বা এনজিওর কাছে ঋণী হয়ে পড়েন। ফসল কাটার পর ঋণের টাকা পরিশোধ করতেই তাদের আয়ের সিংহভাগ চলে যায়। সঞ্চয় করার মতো উদ্বৃত্ত অর্থ তাদের হাতে থাকে না বলেই তারা ‘নুন আনতে পান্তা ফুরায়’ অবস্থায় দিনাতিপাত করেন।

বাংলাদেশের কৃষকরা অন্যতম শীত প্রবণ এলাকা উত্তরবঙ্গে (রংপুর, দিনাজপুর, কুড়িগ্রাম, পঞ্চগড়) শীত মৌসুমেও সবচেয়ে বেশি কর্মব্যস্ত থাকেন। এছাড়া বৃহত্তর ময়মনসিংহ ও যশোর অঞ্চলে শীতকালীন শাকসবজি ও আলু চাষের ব্যাপকতা দেখা যায়। উত্তরবঙ্গের কৃষক তীব্র শীতের প্রকোপ সহ্য করেই দেশের প্রধান খাদ্যভান্ডার সচল রাখেন।

দুঃখজনক বিষয় হলো, বাংলাদেশের কৃষক যেন দারিদ্র্যের উত্তরাধিকারী, কৃষকের সন্তানও গরিব কৃষক বনে যান। এটি রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতার কারণে একটি দুষ্টুচক্র। অর্থাভাবে কৃষকের সন্তানরা উচ্চশিক্ষা পায় না। ছোটবেলা থেকেই তারা বাবার সঙ্গে মাঠে কাজ করতে বাধ্য হয়। কারিগরি শিক্ষা বা বিকল্প কর্মসংস্থানের অভাব এবং পুঁজির অভাবে তারা পৈতৃক পেশা অর্থাৎ কৃষিতেই আটকে থাকে। এভাবে দারিদ্র্য এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে সঞ্চালিত হয়।

বাংলাদেশের অধিকাংশ কৃষকের বসতি ও স্বাস্থ্যের জীর্ণ দশা, কারণ সামান্য আয়ে পেটের ভাত জোগানোই যেখানে দায়, সেখানে ঘর মেরামত বিলাসিতা। বাঁশের বেড়া আর পুরনো টিনের ছাউনি দিয়ে তৈরি তাদের ঘরগুলো শীতের হিম হাওয়া আটকাতে ব্যর্থ।

বাংলাদেশের অধিকাংশ কৃষক ভগ্ন স্বাস্থ্যের অধিকারী। পুষ্টিহীনতা, হাড়ভাঙা খাটুনি এবং কনকনে ঠান্ডায় কাদা-পানিতে কাজ করায় কৃষকরা বাত-ব্যথা, নিউমোনিয়া ও শ্বাসকষ্টজনিত রোগে ভোগেন। অনেকে তীব্র শীতে প্যারালাইজড হয়ে দুর্ভিক্ষের কবলে পরেন। চিকিৎসার টাকা না থাকায় তারা ঝাড়ফুঁক বা হাতুড়ে ডাক্তারের ওপর নির্ভর করেন, যা তাদের স্বাস্থ্যকে আরও ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়।

বাংলাদেশে শীতকালে ভোরে সেচ দেওয়া বা চারা রোপণের সময় কৃষকের গায়ে পর্যাপ্ত গরম কাপড় থাকে না। একটি পাতলা চাদর বা ছেঁড়া সোয়েটারই তাদের একমাত্র সম্বল। অধিকাংশ কৃষকই পুরনো ও সস্তা কাপড়ের ওপর নির্ভরশীল। হাড়কাঁপানো শীতে উন্নত মানের শীতবস্ত্র তাদের কাছে স্বপ্নের মতো।

বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিকভাবে কৃষকদের অবদানের স্বীকৃতি কাগজে-কলমে থাকলেও বাস্তবে তারা চরম অবহেলিত। সরকারি কৃষি কর্মকর্তা বা স্বাস্থ্যসেবা প্রান্তিক কৃষকের দোরগোড়ায় পৌঁছায় না। তারা কোনো ‘ভোট ব্যাংক’ বা শক্তিশালী রাজনৈতিক গোষ্ঠী নয় বলে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে তাদের কণ্ঠস্বর সবসময় ক্ষীণ থেকে যায়।

বাংলাদেশে শীতকালে ফলন বেশি হওয়ায় বাজারে সবজির সরবরাহ বেড়ে যায়। কিন্তু পচনশীল পণ্য সংরক্ষণের জন্য পর্যাপ্ত হিমাগার (ঈড়ষফ ঝঃড়ৎধমব) নেই। মধ্যস্বত্বভোগী বা ফড়িয়াদের সিন্ডিকেটের কারণে কৃষক মাঠপর্যায়ে দাম পায় না। ফলে খুচরা বাজারে দাম বেশি থাকলেও কৃষক অনেক সময় ১-২ টাকা কেজি দরেও সবজি বিক্রি করতে বাধ্য হন, যা তাদের উৎপাদন খরচের অর্ধেকও নয়।

বাংলাদেশে এই শীতে আলু চাষিদের মাথায় যেন মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা। এ সময় আলুর মূল্য পানির মূল্য হতে কম বলা যেতে পারে। অন্যদিকে এ বছর আলু বীজের উচ্চমূল্য, সারের সংকট এবং শেষ সময়ে অতিবৃষ্টি বা নাবি ধসা রোগের কারণে ফলন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে বাজারদর উৎপাদন খরচের চেয়ে নিচে নেমে যাওয়ায় চাষিরা ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। হিমাগারে আলু রাখার চড়া ভাড়াও তাদের কষ্টের অন্যতম কারণ।

বাংলাদেশের গরিব কৃষকদের জন্য জনসাধারণ ও ধনীদের করণীয় নির্ধারণ করা উচিত। আমার দৃষ্টিকোণ থেকে কয়েকটি করণীয় সংক্ষিপ্ত আকারে উল্লেখ করা হলো-

প্রথমত, আমরা যে খাবার খাচ্ছি, তার জন্য কৃষকের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া।

দ্বিতীয়ত, সম্ভব হলে সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে পণ্য কেনা যাতে মধ্যস্বত্বভোগীরা লাভ নিতে না পারে।

তৃতীয়ত, ধনীদের উচিত দানের অর্থ দিয়ে কৃষকদের মধ্যে উন্নত শীতবস্ত্র ও বিনামূল্যে ওষুধ বিতরণ করা। গ্রামভিত্তিক ‘কৃষক সহায়তা তহবিল’ গঠন করা যেতে পারে।

চতুর্থ, বাংলাদেশের সামর্থ্যবানদের উচিত শীত মৌসুমে কৃষকদের জন্য বিশেষায়িত ওয়াটারপ্রুফ এবং থার্মাল পোশাক বিতরণ করা। যেহেতু তাদের কাদা-পানিতে কাজ করতে হয়, তাই সাধারণ কম্বল বা সোয়েটার ভিজে গেলে আরও ঠান্ডা লাগে। তাদের জন্য রেইনকোট সদৃশ উষ্ণ পোশাক কাজের গতি বাড়াতে এবং স্বাস্থ্য সুরক্ষায় সহায়ক হবে।

দরিদ্র কৃষকদের জন্য বাংলাদেশ সরকারের উচিত- সুদবিহীন কৃষি ঋণের সুদ বিতরণ করার জন্য নির্দেশনা প্রদান করা, ইউনিয়ন পর্যায়ে হিমাগার স্থাপন এবং সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে ফসল কেনা নিশ্চিত করা। অতীব দুঃখের বিষয় হলো, সেবা করার নামে বাংলাদেশের অধিকাংশ এনজিও চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ নেয়। কিস্তি দেওয়ার চাপে কৃষক অনেক সময় আগাম ফসল কম দামে বিক্রি করে দেন।

ড. মো. আনোয়ার হোসেন

প্রাবন্ধিক, কথা সাহিত্যিক