নাগরিকদের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত হোক

প্রকাশ : ২৯ ডিসেম্বর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) সম্প্রতি ‘সিটিজেন পারসেপশন সার্ভে ২০২৫’ শীর্ষক যে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছে, তা দেশের সুশাসন ও সরকারি সেবার প্রকৃত অবস্থার এক ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরেছে। জরিপের তথ্য অনুযায়ী, সেবা নিতে গিয়ে প্রায় ৩২ শতাংশ নাগরিককে সরাসরি ঘুস দিতে হয়েছে। এর চেয়েও উদ্বেগের বিষয় হলো, দেশের অর্ধেকেরও বেশি (৫১ শতাংশ) মানুষ বছরের কোনো না কোনো সময় দুর্নীতির শিকার হয়েছেন। একটি স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসাবে সেবা পাওয়ার অধিকার যখন অর্থের বিনিময়ে কিনতে হয়, তখন তা শুধু অপরাধ নয়, বরং রাষ্ট্রের মৌলিক কাঠামোর ভয়াবহ ব্যর্থতা হিসাবেই পরিগণিত হয়।

প্রতিবেদনে দুর্নীতির যে খতিয়ান উঠে এসেছে, তাতে বিআরটিএ (৬৩.২৯ শতাংশ), আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা (৫৭.৯৬ শতাংশ) এবং পাসপোর্ট অফিসের (৫৭.৪৫ শতাংশ) নাম শীর্ষ তালিকায় থাকাটা নতুন কিছু নয়, তবে অত্যন্ত লজ্জাজনক। এই প্রতিষ্ঠানগুলো সরাসরি জনসেবার সঙ্গে যুক্ত এবং এখান থেকেই সাধারণ মানুষ রাষ্ট্রের স্পর্শ পায়। অথচ এখানেই দুর্নীতির হার সবচেয়ে বেশি। যখন প্রায় ৯৮ শতাংশ ক্ষেত্রে ঘুস হিসাবে সরাসরি ‘নগদ টাকা’ লেনদেনের কথা উঠে আসে, তখন বোঝা যায়, দুর্নীতি এখন আর গোপন কোনো বিষয় নয়, বরং এটি একটি সাধারণ ‘অলিখিত নিয়মে’ পরিণত হয়েছে। জরিপের আরও একটি অন্ধকার দিক হলো, সামাজিক ও রাজনৈতিক বৈষম্য। প্রায় ১৯ শতাংশ মানুষ বৈষম্য ও হয়রানির শিকার হলেও ৯৫ শতাংশের কাছাকাছি ভুক্তভোগী কোথাও অভিযোগ জানাননি। এর পেছনে প্রধান কারণ হলো, ‘প্রতিকার না পাওয়ার শঙ্কা।’ যখন বিচারহীনতার সংস্কৃতি শিকড় গেড়ে বসে, তখন মানুষ অভিযোগ করার সাহস ও আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন।

এছাড়া সরকারি সিদ্ধান্ত গ্রহণে ৭২ শতাংশের বেশি মানুষের কোনো প্রভাব না থাকা প্রমাণ করে, আমাদের গণতান্ত্রিক ও প্রশাসনিক প্রক্রিয়া এখনও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত হতে পারেনি। তবে আশার আলো কিছুটা হলেও দেখা গেছে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবায়। নাগরিকদের একটি বড় অংশ এসব সেবার মান নিয়ে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন। কিন্তু দুর্নীতির মহোৎসবের কাছে এ ইতিবাচক দিকগুলো ঢাকা পড়ে যাচ্ছে। পরিকল্পনা সচিবের বক্তব্যে যে ‘দুর্বৃত্তায়ন’র কথা উঠে এসেছে, তা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। আইন থাকা সত্ত্বেও প্রয়োগের অভাব এবং প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে মারাত্মক বিশৃঙ্খলা আমাদের প্রশাসনিক সক্ষমতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।

দুর্নীতির এই ভয়াল অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে হলে শুধু ডিজিটাল বাংলাদেশ বা স্মার্ট বাংলাদেশের স্লোগান যথেষ্ট নয়, প্রয়োজন কঠোর রাজনৈতিক অঙ্গীকার এবং স্বচ্ছতা। বিবিএসের এই প্রতিবেদনকে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে শুধু একটি কাগুজে দলিল হিসাবে না রেখে, একে সংস্কারের ভিত্তি হিসাবে গ্রহণ করতে হবে। দুর্নীতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর শীর্ষ পর্যায় থেকে নিচ পর্যন্ত জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। সরকারি সেবা পাওয়ার প্রক্রিয়াকে সম্পূর্ণ মানবিক ও দুর্নীতিমুক্ত করতে না পারলে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি কমবে না এবং এসডিজি ১৬-এর লক্ষ্যমাত্রা অর্জন অসম্ভব হয়ে পড়বে। উন্নত রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন তখনই সফল হবে, যখন একজন সাধারণ নাগরিককে পাসপোর্ট অফিসের বারান্দায় কিংবা পুলিশের দরজায় দাঁড়িয়ে ঘুস দেওয়ার কথা চিন্তা করতে হবে না। আমরা আশা করি, সরকার এই জরিপের ফলাফলকে একটি ‘ওয়েক-আপ কল’ হিসাবে নেবে এবং প্রশাসনকে দুর্বৃত্তায়নের জাল থেকে মুক্ত করতে সাহসী পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।