স্বাগতম ২০২৬ : নতুন বছরে নতুন শুরুর অঙ্গীকার
ড. মো. আনোয়ার হোসেন
প্রকাশ : ৩১ ডিসেম্বর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

শুভ নববর্ষ!
ইংরেজি নববর্ষ বা ‘নিউ ইয়ার্স ডে’ হলো গ্রেগোরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী বছরের প্রথম দিন। ২০২৬ সালের প্রথম দিনটি বিশ্বজুড়ে নব উদ্দীপনা এবং পরিবর্তনের অঙ্গীকার নিয়ে উপস্থিত হচ্ছে। এটি শুধু ক্যালেন্ডারের পাতা পরিবর্তন নয়, বরং ব্যক্তিগত ও বৈশ্বিক লক্ষ্য নির্ধারণের একটি মাহেন্দ্রক্ষণ। বর্তমান বিশ্বের অস্থিরতা কাটিয়ে ২০২৬ সালকে মানবতা ও প্রযুক্তির এক অনন্য সমন্বয় হিসেবে দেখা হচ্ছে।
ইংরেজি নববর্ষের ইতিহাস প্রায় ৪,০০০ বছরের পুরনো। প্রাচীন মেসোপটেমীয় (ব্যাবিলন) সভ্যতায় প্রথম নববর্ষ পালন শুরু হয়। পরবর্তীতে রোমান সম্রাট জুলিয়াস সিজার খ্রিষ্টপূর্ব ৪৬ অব্দে ‘জুলিয়ান ক্যালেন্ডার’ প্রবর্তন করেন এবং ১ জানুয়ারিকে বছরের প্রথম দিন হিসেবে ঘোষণা করেন। রোমানদের দেবতা ‘জানুস’ (যার দুটি মুখণ্ডএকটি পেছনের দিকে বা অতীতে, অন্যটি সামনের দিকে বা ভবিষ্যতে) এর নামানুসারে জানুয়ারি মাসের নামকরণ করা হয়। পরবর্তীতে ১৫৮২ সালে পোপ গ্রেগরি অষ্টম গ্রেগোরিয়ান ক্যালেন্ডার প্রবর্তনের মাধ্যমে একে বর্তমান রূপ দান করেন।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নিজস্ব সংস্কৃতিতে নববর্ষ পালিত হয়। নিউ ইয়র্কের ‘টাইমস স্কয়ারে’ বিশাল বল ড্রপ করা হয়, সিডনির হারবার ব্রিজে চলে দৃষ্টিনন্দন আতশবাজি। জাপানের মানুষ মন্দিরে গিয়ে ১০৮ বার ঘণ্টা বাজিয়ে অশুভ শক্তি দূর করে। স্পেনে নববর্ষের মধ্যরাতে ঘড়ির কাঁটার সাথে তাল মিলিয়ে ১২টি আঙ্গুর খাওয়ার প্রথা রয়েছে। অন্যদিকে স্কটল্যান্ডে ‘হগমানে’ উৎসবে আগুনের খেলা এবং প্রথম অতিথি আসার (ফাস্ট ফুটিং) রীতি প্রচলিত। ২০২৬ সালের নববর্ষ বিশ্বব্যাপী কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার চরম উৎকর্ষ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার সংকল্প নিয়ে পালিত হচ্ছে। বাংলাদেশে এ বছর নববর্ষের আমেজ কিছুটা ভিন্ন, কারণ এখানে জাতীয় সংসদ নির্বাচন স্পর্শ করার এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ফেরানোর চেষ্টা চলছে। ইংরেজি নববর্ষের অনেক ব্যতিক্রমী দিকও রয়েছে। নিচে চারটি বিষয় শেয়ার করা হল-
১. ইথিওপিয়া তাদের নিজস্ব ক্যালেন্ডার ব্যবহার করে, ফলে তারা ১১ই সেপ্টেম্বর নববর্ষ পালন করে। ২. প্রাচীনকালে নববর্ষে রোমানরা একে অপরকে ডুমুর এবং মধু উপহার দিত। ৩. প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপ কিরিবাতি বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে নববর্ষকে স্বাগত জানায়। ৪. নববর্ষের সংকল্প বা ‘Nwe Year’s Resolution’ করার প্রথা ব্যাবিলিনীয়দের সময় থেকে চলে আসছে। এ পর্যায়ে নববর্ষ উপলক্ষে বিশ্ববাসীর জন্য শুভেচ্ছা নিয়ে আসছি-
হে ধরিত্রীর সন্তান, ২০২৬-এর এই শুভলগ্নে আপনাদের জানাই আন্তর্জাতিক মাদকবিরোধী সংগঠন ফ্রিডম ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্টি অ্যালকোহলের পক্ষ থেকে রক্তিম শুভেচ্ছা। মাদকের বিষবাষ্প যেন আর কোনো মায়ের বুক খালি না করে, কোনো তরুণের স্বপ্ন যেন ক্ষতিকর নেশায় বিলীন না হয়। আসুন, আমরা গ্লাসে মদের বদলে বন্ধুত্বের সুধা নিয়ে একতাবদ্ধ হই। একটি সচেতন ভোর আপনার পরিবারের মুখে হাসি ফোটাতে পারে, এক ফোঁটা অ্যালকোহলমুক্ত জীবন দিতে পারে চিরস্থায়ী সুখ। আজই শপথ নিন, নিজেকে ভালোবাসুন, নিজের শরীরকে মন্দিরের মতো পবিত্র রাখুন। সকলে হাতে হাত রেখে গড়ুন মাদকমুক্ত এক শান্তিময় পৃথিবী। এ ধাপে আসছি নববর্ষ ২০২৬-এ বাংলাদেশ প্রসঙ্গ নিয়ে। বাংলাদেশে এবার নববর্ষ পালনে নিরাপত্তার পাশাপাশি সচেতনতার ওপর বিশেষ জোর দেওয়া হচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি, রমনা ও হাতিরঝিলে তরুণদের জমায়েত থাকলেও আশা করা যাচ্ছে, এবার তা থাকছে সুশৃঙ্খল। বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন ঘরোয়া এবং উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে রবীন্দ্র-নজরুল সঙ্গীত ও লোকজ অনুষ্ঠানের আয়োজন করছে। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে তরুণরা ভার্চুয়ালি শুভেচ্ছা বিনিময় করছে এবং সামাজিক স্বেচ্ছাসেবী কাজে লিপ্ত হচ্ছে।
বিশ্ববাসীর জন্য এ নববর্ষে স্বস্তির বিষয় হলো- যুদ্ধ-বিগ্রহের ক্লান্তির মধ্যেও বিশ্ববাসী এখন ডিজিটাল সংযুক্তির মাধ্যমে শান্তির বার্তা প্রচার করছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এখন কেবল বিশৃঙ্খলা নয়, উৎসব নয়, বরং মানবতার পক্ষে আওয়াজ তোলার প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এবার আতশবাজির বদলে লেজার শো এবং পরিবেশবান্ধব উদযাপনের প্রতি মানুষের ঝোঁক বেড়েছে। তারুণ্যের জয়গান আর নবীন-প্রবীণের মেলবন্ধনে ২০২৬-এর নববর্ষ এক নতুন মাত্রা পেতে যাচ্ছে।
উপরোল্লেখিত কারণে, বিশেষ করে আমাদের কিশোর ও তরুণ প্রজন্মকে মনে রাখতে হবে, ইংরেজি নববর্ষের রাতে উচ্চশব্দের আতশবাজি এবং ককটেল বিস্ফোরণ জনজীবনে চরম দুর্ভোগ সৃষ্টি করে। বিশেষ করে হার্টের রোগী, বয়স্ক ব্যক্তি এবং শিশুদের জন্য এই তীব্র শব্দ মৃত্যুর কারণ হতে পারে। অবলা পশুপাখিরা আতঙ্কে দিগি¦দিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছোটাছুটি করে এবং অনেক সময় মারা যায়। আপনার সাময়িক আনন্দ যেন অন্য কারো জন্য জীবননাশের হুমকি না হয়, তা ভাবা জরুরি। আনন্দ হোক সৃজনশীল ও শান্তিময়, যা সবাইকে স্বস্তি দেবে।
আমাদের আরো মনে রাখা দরকার যে, উৎসব হোক হৃদয়ের টানে, শব্দের তাণ্ডবে নয়। আতশবাজি ও ককটেল ফুটিয়ে অসুস্থ মানুষকে ঝুঁকির মুখে ফেলবেন না। আইন মেনে চলুন এবং প্রতিবেশীর প্রশান্তির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন। আসুন, আমরা উচ্চশব্দমুক্ত একটি সুস্থ ও সুন্দর নববর্ষ উপহার দিই। বিবেকের তাড়নায় এই ধ্বংসাত্মক সংস্কৃতিকে আমরা আজই বিদায় জানাই।
যেহেতু নববর্ষ মানেই নব আনন্দ উদ্ভাসিত হওয়া, সেহেতু এ পর্যায়ে আসছি নববর্ষের মজাদার রম্য রচনা- ‘নতুন বছরের রেজোলিউশন’ নিয়ে-
প্রতি বছর ১ জানুয়ারি সকালে আমরা সবাই যেন একেকজন সাধু বনে যাই! ডায়েরি খুলে লিখি- ‘কাল থেকে ভোরে উঠব’, ‘ফাস্টফুড ছাড়ব’ আর ‘ফেসবুক কম চালাব’। কিন্তু ঘড়িতে সকাল ১০টা বাজতেই ডায়েরিটা বালিশের নিচে চলে যায়, আর পিৎজা অর্ডারের নোটিফিকেশন বেজে ওঠে। আমাদের ব্যায়াম করার সিদ্ধান্তগুলো তো জিম মালিকদের পকেট ভরার জন্যই নেওয়া হয়, কারণ সাত দিনের বেশি আমাদের আর সেখানে দেখা যায় না। অনেকে আবার শপথ নেন ‘এ বছর কারো গিবত করব না’, অথচ বন্ধুদের দেখলে প্রথম বাক্যটিই হয়- ’শুনছিস, ও কি করেছে?’ আসলে আমাদের নববর্ষের রেজোলিউশনগুলো অনেকটা ডায়েট চার্টের মতো, যা শুধু পড়ার জন্যই বানানো হয়, মানার জন্য নয়। তবুও আমরা প্রতি বছর নতুন করে স্বপ্ন দেখি, কারণ স্বপ্ন দেখতে তো আর টাকা লাগে না! নিবন্ধটির এই স্তরে ইংরেজি নববর্ষের সঙ্গে প্রাসঙ্গিক ইংরেজি না জানা’ শৌখিন মানুষদের নিয়ে আরেকটি রম্য ছোট গল্প নিচে দেওয়া হলো-
* বছরের বাকি ৩৬৪ দিন আকাশ খাঁটি বাংলায় বাতাসে গতিতে কথা বললেও, প্রতিবছর ১লা জানুয়ারি ভোরে ঘুম থেকে উঠেই তার ভেতর কোনো এক বিলেতি ‘সাহেব’ ভর করে।
* আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দাঁত মাজতে মাজতে সে নিজেকে নিজে উইশ করে, ‘গুড মর্নিং সেলফ, টুডে ইজ এ নিউ ইয়ার অফ মাই লাইফ!’
* ব্রেকফাস্ট টেবিলে আম্মুকে গিয়ে বলে, ‘মাদার, গিভ মি সাম ব্রেড অ্যান্ড এগ পোচ, বিকজ টুডে ইজ ভেরি ফ্রেশ ডে।’
* দিনশেষে যখন সে ক্লান্ত হয়ে বিছানায় যায়, তখন বিড়বিড় করে বলে, ‘ভেরি টায়ার্ড ডে, বাট ভেরি সাকসেসফুল ইংলিশ স্পিকিং ডে!’
আকাশ ভুল ইংরেজি বলা সত্ত্বেও ২০২৬ সালের নতুন ইংরেজি নববর্ষকে কেন্দ্র করে ইংরেজি শেখার আগ্রহ নিয়ে ঘটনার শেষাংশ নিচে তুলে ধরা হলো:
২০২৬ সালের নববর্ষের সকালে আকাশ প্রতিজ্ঞা করল যে, ভুল হোক বা ঠিক, সে আজ থেকে ইংরেজিতেই কথা বলবে। বন্ধুদের সাথে দেখা হতেই সে ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে বলল, ‘নিউ ইয়ার, নিউ মি, আই স্পিক ইংলিশ অল ডে!’ তার ব্যাকরণগত ভুল দেখে অনেকে হাসাহাসি করলেও আকাশ দমে না গিয়ে সবার সাথে ইংরেজিতে আড্ডা চালিয়ে গেল। সে বিশ্বাস করে যে, ভুল করতে করতেই একদিন সে এই ভাষায় দক্ষ হয়ে উঠবে এবং জড়তা কাটিয়ে ফেলবে। দিনশেষে আকাশ বুঝল, নতুন বছরের এই ছোট প্রচেষ্টাটিই ভবিষ্যতে তাকে সাবলীলভাবে ইংরেজি বলতে সাহায্য করবে।
নববর্ষে আমরা অন্তরের অন্তস্থল থেকে কামনা করি যে, ২০২৬ সাল আসুক বারুদ আর কামানের গর্জন ছাপিয়ে শান্তির সাদা পায়রা হয়ে। পৃথিবীর বুক থেকে যুদ্ধের কালো ছায়া মুছে গিয়ে মানুষে মানুষে ভেদাভেদ ঘুচে যাক। একটি শিশুও যেন খাবারের অভাবে না কাঁদে। কোনো সীমান্ত যেন মানুষের মধ্যে দেওয়াল না তোলে। সম্প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে আমরা গড়ে তুলব এক বৈষম্যহীন নতুন বিশ্ব। ২০২৬ হোক ভাতৃত্বের বছর, যেখানে ভালোবাসাই হবে মানুষের একমাত্র পরিচয়। এই আমাদের প্রত্যাশা, এই আমাদের আগামীর প্রার্থনা।
আমরা আশাবাদী হতে চাই, ২০২৬ সালে আমরা এমন এক বাংলাদেশ পাব যেখানে রাজনীতির নামে কোনো হানাহানি থাকবে না। ধনী ও গরিবের মধ্যকার আকাশচুম্বী ব্যবধান কমে আসবে, অন্ন মিলবে প্রতিটি সাধারণ মানুষের ঘরে। প্রতিটি নাগরিকের কণ্ঠস্বর হবে মর্যাদাপূর্ণ এবং বিচারব্যবস্থা হবে মানবিক ও ন্যায়ের প্রতীক। অনৈক্য দূর হয়ে জাতীয় স্বার্থে সবাই হবে একতাবদ্ধ, গড়ে উঠবে দুর্ভেদ্য ভাতৃত্ব। আধুনিক প্রযুক্তি আর দেশপ্রেমের সমন্বয়ে বাংলাদেশ হবে বিশ্বের রোল মডেল। ২০২৬ হোক আমাদের পুনর্জাগরণের বছর, যেখানে মানুষ মানুষের জন্য নিবেদিত হবে। এই স্বপ্নের লাল-সবুজ পতাকা উড়বে সুউচ্ছ গৌরবে।
পরিশেষে আবারো আশাবাদী হয়ে বলতে চাই, ইংরেজি নববর্ষ আমাদের কেবল একটি নতুন দিন দেয় না, দেয় জীবনকে নতুন করে সাজানোর একটি সুযোগ। ২০২৫ এবং ২০২৬ সালের এই সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আমাদের দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হওয়া উচিত- আমরা আর ধ্বংস নয়, সৃষ্টির পথে হাঁটব। মাদক, ইভটিজিং, যৌতুক হিংসা আর যুদ্ধকে বিদায় জানিয়ে আমরা একে অপরের হাত ধরব। পৃথিবীটা আমাদের সবার, আর এই পৃথিবীকে বাসযোগ্য রাখার দায়িত্বও আমাদেরই। মনে রাখব, একটি সুন্দর আগামী আমাদের একটি সঠিক সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করছে। আসুন, আমরা মাদককে না বলি, মানবতাকে হ্যাঁ বলি এবং ভালোবাসার চাদরে মুড়িয়ে দিই এই ধরিত্রীর প্রতিটি প্রাণ। ইংরেজি নববর্ষের এই পবিত্র লগ্নে এটাই হোক আমাদের পরম শিক্ষা ও চিরস্থায়ী অঙ্গীকার।
ড. মো. আনোয়ার হোসেন
প্রাবন্ধিক, কথা সাহিত্যিক, প্রেসিডেন্ট আন্তর্জাতিক মাদকবিরোধী সংগঠন ফ্রিডম ইন্টারন্যাশনাল এন্টি অ্যালকোহল
