ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২৬ জুন ২০২৫, ১২ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

মাদক প্রতিরোধে পারিবারিক সচেতনতা জরুরি

রিদুয়ান ইসলাম
মাদক প্রতিরোধে পারিবারিক সচেতনতা জরুরি

সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ছে মরণঘাতী মাদক। কিশোর থেকে শুরু করে অনেক বয়োবৃদ্ধও এখন মাদক নিচ্ছে। যার ফলে সমাজ থেকে শুরু করে পুরো রাষ্ট্রের উন্নয়নে বিঘিœত ঘটছে। সরকারের জিরো টলারেন্স নীতি প্রয়োগ, যৌথ বাহিনীর অভিযান করেও কমানো যাচ্ছে না মাদকের ব্যবহার। যার প্রধান কারণ মাদকের সহজলভ্যতা। মাদক হলো একটি ভেষজদ্রব্য যা গ্রহণের ফলে একজন স্বাভাবিক ব্যক্তির শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তন এবং আসক্তির সৃষ্টি করে। মাদক দ্রব্যে বেদনানাশক কর্মের সঙ্গে জড়িত থাকে তন্দ্রাচ্ছন্নতা, খিটখিটে মেজাজ, রক্তচাপ, মানসিক অস্বস্তি ইত্যাদি। মাদকদ্রব্য গ্রহণে মানুষের মানসিক ও শারীরিক পরিবর্তনে উল্লেখযোগ্য নেতিবাচক প্রভাব দেখা দেয় এবং দ্রব্যের ওপর নির্ভরশীলতা সৃষ্টির পাশাপাশি দ্রব্যগুলো গ্রহণের পরিমাণ ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে এবং এ অবস্থাকে বলে মাদকাসক্তি আর যে গ্রহণ করে তাকে বলে মাদকাসক্ত। বর্তমান সময়ে মাদক ব্যবসায়ীরা স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীর টার্গেট করে মাদক বিক্রি করছে। করোনা পরিস্থিতির কারণে শিক্ষার্থীরাও বাড়িতে অবসর সময় কাটাচ্ছে আর ঝুঁকে পড়ছে মাদকের দিকে। প্রথমে বন্ধুর প্রলোভনে দুই একদিন অনিচ্ছায় মাদক গ্রহণ। তারপর ধীরে ধীরে আসক্তি বেড়ে গেলে নিজ ইচ্ছাতেই, কোনো না কোনোভাবে সেবন করছে মাদক। অনেকে আবার স্মার্ট হওয়ার জন্যও স্বইচ্ছায় মাদক গ্রহণ করে; কিন্তু পরে আর এটা বের হয়ে আসতে পারে না। এখন শুধু শহরে নয়, প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলেও মাদক বিরাজমান।

মাদকাসক্তের সংখ্যা বিবেচনায় বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম। বাংলাদেশের গবেষকরা বলছেন, সারা বাংলায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে ৭৩ লাখ মাদকাসক্ত রয়েছে। দেশের ১৮ কোটি জনগোষ্ঠীর মধ্যে তা কতটা ভয়াবহ, তা সহজেই অনুমেয়। বাংলাদেশের মোট গ্রামের সংখ্যা আর মাদকাসক্তের সংখ্যা যদি অনুপাতে বের করা হয়, তাহলে আঁতকে ওঠার মতো একটা বিষয়। দেশের ৬৮ হাজার গ্রামের মধ্যে প্রায় প্রতিটিতে গড়ে ১০৭ জন মাদকাসক্ত পাওয়া যাবে। কতটা ভয়াবহ অবস্থা একবার ভেবে দেখলে বোঝা যায়। গবেষকরা এটাও বলছেন যে, মাদকাসক্তের প্রায় ৯১ শতাংশই কিশোর, যুবক, তরুণ। আর পুরো মাদকাসক্তের ১০ থেকে ১৫ শতাংশ নারী।

নিউরো পরীক্ষায় দেখা গেছে, একজন ব্যক্তি যখন মাদক গ্রহণ করে তখন তার মস্তিষ্কের ডোপেমিন নামক নিউরোট্রান্সমিটার অত্যন্ত বেশি পরিমাণে বৃদ্ধি পায়, যা তাকে মাদকের আনন্দ দেয় এবং তা পরে মাদক সেবনে উৎসাহিত করে। কিন্তু যারা দীর্ঘদিন ধরে মাদক গ্রহণ করে তাদের ক্ষেত্রে আবার ঘটে উল্টোটা। অর্থাৎ একনাগাড়ে মাদক নেওয়ার পরে যে ডোপেমিন মাদকের আনন্দ দিত তা একসময় কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলে। তখন তারা মাদকের আনন্দটুকু পায় না এবং পরে তারা আর নেশার জন্য মাদক গ্রহণ করে না, অভ্যাসের জন্যই করে থাকে। কিন্তু সেখান থেকে বেরিয়ে আসা খুব কঠিন।

প্রথম পর্যায়ে মাদক মানুষকে এতটাই আনন্দ দেয় যে, মজাদার খাদ্য গ্রহণ, পানীয় পান বা যৌনমিলনের মতো কর্মকা-ও তার কাছে মøান হয়ে ওঠে। কারণ এ ছোট ছোট আনন্দ মানুষ নিউরোট্রান্সমিটার অর্থাৎ ডোপেমিন এর সাহায্যেই পেয়ে থাকে। কিন্তু মাদকাসক্তের সঙ্গে এ আনন্দ পাল্লা দিয়ে কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলে এবং মাদকই হয়ে ওঠে মাদকাসক্ত ব্যক্তির একমাত্র চিন্তা-চেতনা। বর্তমানে মাদক এতটা সহজলভ্য হওয়ায় আমাদের দেশে মাদকের ভয়াবহ রূপ দেখতে হচ্ছে। বেশিরভাগ মাদকদ্রব্যই আসে বিদেশ থেকে। দেশের সীমান্তবর্তী এলাকাগুলো দিয়ে অবৈধভাবে দেশে ঢুকছে মাদক। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা হেয়ালি করে থাকে। ফলে, মাদককারবারি ও গডফাদাররা পার পেয়ে যায়। তাদের পর্যাপ্ত শাস্তি নিশ্চিত করা সরকারের একান্ত কাম্য। তা না হলে খুব অচিরেই আমাদের সোনার বাংলা শ্মশানে পরিণত হবে।

মাদক প্রতিরোধে সমাজ এবং পরিবারের রয়েছে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। পারিবারিক ও সামাজিক সচেতনতা শিক্ষা, বন্ধু নির্বাচন, দায়িত্বশীলতা, প্রতিটি ইউনিয়ন বা থানাভিত্তিক মাদকবিরোধী সংগঠন ইত্যাদি হতে পারে মাদক প্রতিরোধ বা প্রতিকারের বিষয়বস্তু। এছাড়া আমরা একটা ইংরেজি প্রবাদ বাক্য অনুশীলন করতে পারি, ‘প্রিভেনশন ইজ বেটার দেন কিউর’। অর্থাৎ ‘প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ উত্তম’। তেমনই আমাদের সমাজের প্রতিটি যুবক, যুবতী, তরুণদের প্রতি বিশেষ সচেতনতার সঙ্গে নজর রাখতে হবে। তারা যেন কোনোভাবেই মাদকের সান্নিধ্যে যেতে না পারে, সে বিষয়ে নজর রাখতে হবে। তাদের সামাজিক কর্মকা-ে, মাদকের কুফলতা, ধর্মীয় শিক্ষা, শরীরচর্চা ইত্যাদি বিষয়ে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। খেলাধুলায় মনোনিবেশ, মাদকমুক্ত পরিবেশ গড়ার লক্ষ্যে উজ্জীবিত করতে হবে।

একজন সন্তান তার পারিবারিক পরিবেশ থেকে অনেক কিছু শিখে থাকে। তাই পরিবারকে হতে হবে ধূমপানমুক্ত। সন্তান কোথায় যায়, কাদের সঙ্গে মেশে এসব বিষয়ে সজাগ থাকতে হবে পরিবারকে! সন্তানদের সঙ্গে খোলামেলা ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। যাতে তারা নিজ থেকেই তাদের দৈনন্দিন কার্যাবলি সম্পর্কে আলোচনা করতে পারে। পরিবারের প্রতিটি সদস্যকে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে, সবার আলোচনা ধৈর্য ধরে শুনতে হবে এবং পরিবারের প্রতিটি সদস্যকে গুড প্যারেন্ডিং বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করতে হবে। মাদকাসক্ত ও মাদককারবারিরা আমাদের পরিবার, সমাজের আশপাশেই বসবাস করে। আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিকে বাঁচাতে আসুন আমরাও মাদকের বিরুদ্ধে সোচ্চার হই।

শিক্ষার্থী

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

riduanislam1325@gmail.com

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত