সভ্যতার উষালগ্ন থেকে মানুষের নিরন্তর প্রয়াস উন্নয়ন অভিমুখী। উন্নয়নের প্রয়োজনে মানুষ প্রকৃতি ও পরিবেশকে ব্যবহার করছে, চেষ্টা করে যাচ্ছে তার উপর উত্তরোত্তর নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধি করতে। মাটি, পানি, খনিজসম্পদ, জলবায়ু, গাছপালা, জীবজন্তু, ফলমূল ইত্যাদি সবই এই প্রকৃতি ও পরিবেশের অন্তর্গত। একথা বাস্তব সত্য যে, প্রকৃতি ও পরিবেশের ওপর মানুষের নিয়ন্ত্রণ অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় এখন অনেক গুণ বেশি। তাই মার্কিন অর্থনীতিবিদ Arthur Lewis সত্তরের দশকে উন্নয়নকে সংজ্ঞায়িত করতে গিয়ে বলেন, উন্নয়ন হচ্ছে মানুষের পছন্দ বা বাছাই (Options) করার ক্ষমতা বৃদ্ধি করা। এক সময় মানুষ হেঁটে অথবা গাধা-ঘোড়ার পিঠে চড়ে ঘুরে বেড়াত। আজ রেলগাড়ি, মোটরগাড়ি, উড়োজাহাজ ইত্যাদির যে কোনোটাতে কম সময়ে যাতায়াত করতে পারে দূরে কিংবা কাছে। মানুষের এই যে পছন্দ বা বাছাই করার ক্ষমতা বাড়ানোর প্রচেষ্টা শুধু প্রকৃতি ও পরিবেশকে (extensive) বিস্তৃত ও নিবিড়ভাবে (intensive) ব্যবহারের মাধ্যমেই সম্ভব হচ্ছে। তাই মানুষের নিরন্তর উন্নয়ন প্রচেষ্টার আরেক নাম হচ্ছে প্রকৃতি ও পরিবেশের নানা রকম (diverse) ব্যবহার। আমরা জানি, প্রাকৃতিক নিয়মেই প্রকৃতি ও পরিবেশ টিকে থাকে। মানুষের উন্নয়ন প্রচেষ্টা যদি এই নিয়ম ভঙ্গের কারণ হয় অথবা এই নিয়মে বাধা সৃষ্টি করে তখন পরিবেশের ভারসাম্য বিঘিত হয়। মানুষের জীবনযাপনের অনুকূল পরিবেশ তখন প্রতিকূলে চলে যেতে পারে। অথচ দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য এই যে, নিকট অতীতে মানুষ প্রায় সব উন্নয়ন কৌশল ও কর্মসূচিগুলোয় শুধু অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির কথাই চিন্তা করত। প্রকৃতি ও পরিবেশের ওপর সে কৌশল ও কর্মসূচির কী প্রভাব পড়বে সেটা নিয়ে মাথাব্যথা ছিল না। আজ পরিবেশের কথা বিবেচনা করে উন্নয়নকে কীভাবে পরিবেশসম্মত বা পরিবেশ-বৎসল (Enveronment-Friendly) করা যায় সে ব্যাপারে চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। অন্য কথায়, এমন উন্নয়ন কৌশল ও কর্মসূচির কথা বলা হচ্ছে যা পরিবেশকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে না অথচ ক্ষতিগ্রস্ত করলেও যতটুকু সম্ভব কম করবে। যার ফলে এমন পরিবেশ বজায় থাকবে যা শুধু এই প্রজন্মের জন্য নয়, আগামী প্রজন্মের জন্যও থাকবে নিরাপদ ও অনুকূল। পরিবেশসম্মত বা পরিবেশ-বৎসল এই উন্নয়নকেই বলা হয় টেকসই উন্নয়ন বা Sustainable development।
একথা সবাই জানেন, পৃথিবীতে জনসংখ্যা দ্রুতহারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাড়ছে খাদ্যদ্রব্যসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় বিভিন্ন কৃষি ও শিল্পজাত পণ্যের চাহিদা। ফলে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে কৃষিতে ব্যবহৃত হচ্ছে নতুন নতুন প্রযুক্তি। শিল্প-কারখানারও ব্যাপক প্রসার ঘটছে। এসবের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাড়ছে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার ও শিল্পবর্জ্য। যেখানে অন্য কোনো উৎস থেকে শক্তি আহরণ সম্ভব নয়, সেখানে পুড়ছে কাঠ, বাঁশ ইত্যাদি। ফলে বন উজাড় হচ্ছে, বাতাসে কার্বনডাই-অক্সাইডসহ অন্যান্য ক্ষতিকারক গ্যাসের মাত্রাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। এসবের প্রভাব পড়ছে প্রকৃতি ও পরিবেশের উপর। বৃষ্টি কমছে, ভূমিধস বাড়ছে, মরুকরণ প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হচ্ছে, ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা বাড়ছে, বাড়ছে সমুদ্রপৃষ্টের উচ্চতা এবং বন্যা ও জলোচ্ছ্বাসের ব্যাপকতা। তবে মনে রাখা দরকার যে, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক বহুবিধ কারণও এই সার্বিক আত্মঘাতী প্রক্রিয়ার সঙ্গে ওতোপ্রোতভাবে জড়িত। প্রকৃতি ও পরিবেশের ওপর উন্নয়ন কার্যক্রমের বিরূপ প্রভাবের এ প্রক্রিয়াটি একটু বিশদভাবে আলোচনা করা যেতে পারে।
তবে স্বস্তির বিষয় এই যে, বাংলাদেশের মতো অনেক উন্নয়নশীল দেশের ক্ষেত্রে উল্লেখিত সমস্যাবলী এখনও প্রকট আকার ধারণ করেনি। তার অর্থ অবশ্য এই নয় যে, আমরা এ সমস্যা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত ও নিরাপদ দূরত্বে আছি। কেননা একটু গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে বুঝা যাবে, বাংলাদেশের প্রকৃতি ও পরিবেশ এবং জীববৈচিত্র্য ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার প্রক্রিয়া এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেছে। গত ২০ বছরে বাংলাদেশে প্রায় ৯০ লাখ লোক নদীভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ।
বাংলাদেশে নির্মাণ ও যাতায়াত খাত শিল্প-কারখানা স্থাপন, বাসস্থান নির্মাণ, রাস্তাঘাট উন্নয়ন ইত্যাদি প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে ইটের চাহিদাও বহুলাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে নতুন নতুন ইটখোলা সৃষ্টি হচ্ছে, যা একদিকে চাষযোগ্য জমি ও উর্বর মাটি নষ্ট করছে, অন্যদিকে ইট পোড়াতে প্রচুর কাঠ ব্যবহারের ফলে বন-জঙ্গল উজাড় হচ্ছে, ইটের ভাটার কালো ধোঁয়া পরিবেশ দূষণে অবদান রাখছে। অথচ আমরা জানি, এই বন উজাড়করণের ফল খুবই মারাত্মক। কেননা এর ফলে বৃষ্টিপাত কমে যায়। ভূমিধস বাড়ে, মাটির নিচের পানির স্তর নেমে যায়, মাটির পানি ধারণক্ষমতা হ্রাস পায় ও উর্বরতা নষ্ট হয়। তাছাড়া, রাজধানীসহ বাংলাদেশের শহরাঞ্চলে যানবাহন থেকে নিঃসৃত কালো ধোঁয়ায় বায়ুদূষণের মাত্রা আংশকাজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে বলে অভিজ্ঞমহল মনে করছেন। পলিথিন ব্যাগের ব্যবহারও এরই মধ্যে সবাইকে ভাবিয়ে তুলেছে, যা অনতিবিলম্বে নিষিদ্ধ করার কথা অনেকে ভাবছেন। বিশেষজ্ঞরা কথা বলেছেন। প্রতিশ্রুতি দেওয়া হচ্ছে কিন্তু কার্যকর হচ্ছে না।
উন্নয়নের নামে ভূমি ও পানির মতো মৌলিক প্রাকৃতিক উপাদানকেও মানবজাতি কীভাবে যে ক্ষতিগ্রস্ত করছে তার বর্ণনা দেওয়া সত্যিই দুরূহ। বাড়তি জনসংখ্যার আবাসনের জন্য একদিকে চাষযোগ্য জমি, পাহাড় ইত্যাদি রূপান্তরিত হচ্ছে মানুষের আবাসস্থলে, অন্যদিকে সবুজ বিপ্লবের নামে ভূমি সাশ্রয়ী প্রযুক্তির যেমন উচ্চ ফলনশীল ধান, সেচ, রাসায়নিক সার, কীটনাশক ঔষধ ব্যবহার বৃদ্ধির ফলে মাটির নিচের পানির স্তর বিশেষ করে গভীর/অগভীর নলকূপ ব্যবহারের কারণে ক্রমশ নেমে যাচ্ছে। রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ঔষধের যথেচ্ছ ব্যবহারের ফলে পানি দূষিত হচ্ছে এবং পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষাকারী বিভিন্ন প্রজাতির পোকা-মাকড়, কীট-পতঙ্গ, উদ্ভিদ অবলুপ্ত হচ্ছে, দেশীয় বিভিন্ন প্রজাতির ফসলের মিশ্র চাষের পরিবর্তে বারবার একই প্রজাতির উচ্চ ফলনশীল ফসল ব্যবহারের (Monoculture) কারণে জমির উর্বরতা ও কৃষির উৎপাদনশীলতা হ্রাস পাচ্ছে। এতে উৎপাদন খরচও উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। আজ বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বহু দেশে সবুজ বিপ্লব রূপান্তরিত হয়েছে ‘ধূসর বিপ্লবে’। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে লবণাক্ততা বৃদ্ধি ও উত্তরবঙ্গের মরুকরণ এসবই হচ্ছে মানবসৃষ্ট তথাকথিত উন্নয়ন কার্যক্রমের কয়েকটা মোটা দাগের কুফল।
এদিকে অতীতে পানি বিদ্যুৎ উৎপাদন, সেচ, বন্যা নিয়ন্ত্রণ, মৎস্য উন্নয়ন ইত্যাদির উদ্দেশ্যে সারা বিশ্বে যে বড় বড় পানিধারা ও বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে তার প্রভাব এখন মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছেছে। কেননা এসব উচ্চাকাক্সক্ষী বহুমুখী প্রকল্প গ্রহণের ফলে একদিকে কোটি কোটি মানুষ গৃহহারা হয়েছে, লাখ লাখ একর চাষযোগ্য জমি পানির নিচে ডুবে গেছে। অন্যদিকে ভূমিধস, বন উজাড়করণ, মরুকরণ, লবণাক্ততা বৃদ্ধি, বৃষ্টিপাত হ্রাস ইত্যাদির কারণে জীববৈচিত্র্যে পড়েছে বিরূপ প্রতিক্রিয়া এবং প্রকল্প এলাকার মানুষের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনেও এসেছে ব্যাপক অশুভ পরিবর্তন। ভারতের পশ্চিমবঙ্গে নির্মিত ফারাক্কা বাঁধ বাংলাদেশের ওপর কী প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে তা আজ সবারই জানা। এদিকে খবর পাওয়া যাচ্ছে, যেসব নদী ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে তাতে বাঁধ দিয়ে ভারত পানি আটকানোর চেষ্টা চালাচ্ছে এতে পরিস্থিতি আরও মারাত্মক আকার ধারণ করবে বলে বিশেষজ্ঞরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
পরিশেষে বাংলাদেশে কীভাবে টেকসই উন্নয়ন (Sustainable Devolopment) নিশ্চিত করা যায় সে ব্যাপারে কয়েকটি পরামর্শ উপস্থাপন করে আমার প্রবন্ধ শেষ করব। * দক্ষতার সঙ্গে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে এবং কয়লা ও তেলের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে প্রাকৃতিক গ্যাসের ব্যবহার বৃদ্ধি করতে হবে। * ডিজেল ও পেট্রলের পরিবর্তে যানবাহনে সিএনজি গ্যাসের ব্যবহার বাড়াতে হবে এবং ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন চলাচল নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। * শিল্প-কারখানা স্থাপন, গৃহায়ন ও রাস্তাঘাট নির্মাণে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে যাতে করে পরিবেশ দূষিত না হয় এবং এলাকার ভূ-প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। * শিল্পবর্জ্য re-cycling-এর ব্যবস্থা করতে হবে। * টেকসই কৃষি উন্নয়ন নিশ্চিত করার জন্য ভূ-গর্ভস্থ পানির পরিবর্তে মাটির উপরিভাগে পানির ব্যবহার বৃদ্ধি, রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ঔষধের পরিমিত ব্যবহার এবং দেশীয় বিভিন্ন জাতের ফসলের মিশ্র চাষ নিশ্চিত করতে হবে। সরকারি উদ্যোগে এসব বিষয়ে কৃষকের সচেতনতা বাড়াতে প্রচারকার্য জোরদার করতে হবে। * সামাজিক বনায়ন বাড়াতে হবে এবং এর সুফল সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করতে হবে। যত বেশি সম্ভব গাছের চারা রোপণ করে রক্ষণাবেক্ষণের মাধ্যমে তা বড় করে বনাঞ্চলের পরিমাণ বৃদ্ধি করতে হবে। * নদ-নদী, খাল-বিল, হাওর-বাঁওড়, জলমহাল ও প্রাকৃতিক জলাশয়গুলো বিনষ্ট করা যাবে না এবং এসবের পরিমিত ব্যবহার নিশ্চিতকরণের জন্য মধ্যস্বত্বভোগীর হস্তক্ষেপ বন্ধ করতে হবে। * পরিবেশ আইন সংযোজন ও সংশোধন করে পরিবেশ দূষণকারীদের শাস্তির বিধান চালু করতে হবে। * করাতকল বিধিমালা ২০১২-এর সংশোধন করে করাতকল স্থাপনে কঠোর ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে, পাশাপাশি অবৈধ করাতকল উচ্ছেদের ব্যবস্থা করতে হবে। * National Environmental Managerment Action plan (NEMAP)-এর আওতায় মন্ত্রণালয় সমন্বয়ের পদক্ষেপ নিতে হবে যাতে করে সরকারি কোনো সিদ্ধান্ত পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের ক্ষতির কারণ না হয়।