প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ০৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২১
নিষ্পাপ শিশুর পরবর্তী পর্যায় হলো কিশোর। জীবনের এ গুরুত্বপূর্ণ সময়টি নিজেকে গড়ে তোলার সময় হলেও সঠিক সিদ্ধান্তটি তারা নিতে পারে না। তাই এ সময়ে ভালো কাজগুলো জীবন গড়ার জন্য যেমন সহায়ক, তেমনি মন্দ কাজগুলো জীবন ধ্বংস করতে যথেষ্ট ভূমিকা রাখে। কিশোররা এসময় বড় রাজনৈতিক গডফাদারদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে না বুঝেই অপরাধের হাতিয়ার হয়ে ওঠে। মূলত ১৪-২০ বছরের কিশোরদের মধ্যে জীবন গড়ার যে শক্তি থাকে, তা অবৈধ কাজের হাতিয়ার রূপে ব্যবহার করে একশ্রেণির গডফাদার। ফলে পাড়ায় পাড়ায় গড়ে ওঠে গ্যাং কালচার।
গ্যাং একটি ইংরেজি শব্দ, যার বাংলা অর্থ মিলিত হওয়া বা ঐক্যবদ্ধ হওয়া। আগে এ ঐক্যবদ্ধতা ছিল ভালো কাজের জন্য; কিন্তু বর্তমানে ঐক্যবদ্ধ হয় সন্ত্রাসী কার্যক্রম বা অবৈধ শক্তিপ্রয়োগের জন্য। যখন কিশোররা নিজেদের স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ হয়, তখন তাকে কিশোর গ্যাং বলে। কিশোর গ্যাংগুলো মূলত স্কুল-কলেজের ঝরেপড়া ছাত্রদের মাধ্যমে গড়ে ওঠে। প্রথমে নিজেদের অন্য কোনো সম্ভাব্য আক্রমণ থেকে রক্ষা করার জন্য গ্যাং তৈরি করলেও তা ধীরে ধীরে সন্ত্রাসী কার্যক্রমে সঙ্গে জড়িত হয়, এমনকি হত্যাকা- পর্যন্ত সংঘটিত করে ফেলে। একটি কিশোর গ্যাং ১৪-২০ বছর বয়সী ১০-২০ জন করে সদস্য নিয়ে গড়ে ওঠে। কেউ স্বপ্রণোদিত হয়ে, কেউ বা বলপ্রয়োগের কারণে গ্যাং সদস্য হয়ে থাকে।
কিশোর গ্যাংগুলোর অন্যতম কাজ হচ্ছে, যে কোনো ধরনের অবৈধ কার্যক্রম পরিচালনা করা, গডফাদারদের সহযোগিতায় এলাকায় গ্যাংশক্তি বৃদ্ধি করা। নিজেদের জানান দিতে দিতে দেওয়ালে দেওয়ালে গ্রাফিতি আঁকা, পাড়া-মহল্লা ভাগ করে নেওয়া এবং নিজস্ব গ্যাংয়ের শক্তি প্রদর্শন করা।
কিশোররা বিভিন্ন কারণে গ্যাং কালচারের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে, তার মধ্যে রয়েছেÑ পারিবারিক শিক্ষার অভাব বা পরিবার তার সন্তানদের চরিত্র গঠনের শিক্ষা না দেওয়া। অনেক পরিবারের বড় সদস্যদের অনৈতিক কর্মকা-ে জড়িত থাকা। অথবা বাবা-মা উভয়েরই কর্মব্যস্ততার কারণে কিশোদের পারিবারিক শিক্ষা না পাওয়া। পারিবারিক বা সামাজিক বিভিন্ন অন্যায় দেখে বড়দের চুপ থাকা। এছাড়া পর্যাপ্ত ধর্মীয় শিক্ষা অভাব এবং মুরুব্বিদের না মানার কারণেও কিশোররা অনৈতিক কর্মকা-ে ঝুঁকে পড়ার সুযোগ পাচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোর অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারের কারণে গ্যাং কালচারে যুক্ত হচ্ছে কিশোররা।
কিশোর গ্যাং প্রথম জনসম্মুখে আসে ২০১৭ সালে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার উত্তরা স্কুল পড়ুয়া এক কিশোর আদনান কবিরকে পিটিয়ে হত্যা করার পর। পুলিশ ওই ঘটনাটি তদন্ত করে জানতে পারে, ওই গ্যাংটির লিডার আছে এবং এর সদস্যরা স্থানীয় একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়ে। অনেক আলোচিত বরগুনার রিফাত শরিফ হত্যাকা-টিও কিশোর গ্যাংয়ের মাধ্যমে হয়েছিল। এ ঘটনাগুলোর পর পুলিশ কিশোর গ্যাং দমনে মাঠে নামে। পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) ইন্সপেক্টর জুয়েল মিয়া বলেছেন, এ কিশোররা সংঘবদ্ধ হওয়ায় অনেকেই মনে করেন, এদের পেছনে কোনো প্রভাবশালী ব্যক্তি রয়েছে। ফলে এদের বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস পায় না। র্যাবের কর্মকর্তা মুফতি মাহমুদ খান বলেছেন, গ্যাংয়ের সদস্যরা মাদকের সঙ্গে জড়িত। আর পাড়া-মহল্লায় বিভিন্ন জায়গায় লম্বা সময় ধরে বসে থেকে যৌনহয়রানি করে। এদের সঙ্গে চলতে চলতে ভালো ছেলেরাও অপরাধে জড়িয়ে যায়।
কিশোর অপরাধ দমনে সমাজকল্যাণমন্ত্রীর নেতৃত্বে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন একটি শিশুকল্যাণ বোর্ড রয়েছে। এ বোর্ডে জাতীয় সংসদের স্পিকার কর্তৃক মনোনীত একজন সরকার ও বিরোধীদলীয় সংসদ সদস্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ ১৭ মন্ত্রণালয় ও বিভাগের এবং বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সংস্থা ও সংগঠনের রয়েছে, তবে সমাজকল্যাণ সচিব বলেনÑ শিশুদের অপরাধ জড়িত থাকার ব্যাপারে কোনো গবেষণা করা হয়নি।
বিগত অনেকগুলো কিশোর গ্যাং অপরাধের কারণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিভিন্ন জায়গায় অভিযান পরিচালনা করেন, শুধু হাতিরপুল থানাতেই আটক করা হয় ৮৮ জনকে; কিন্তু ৮০ জনের অপরাধ না পাওয়ায় ছেড়ে দেয়। সমাজবিজ্ঞানীরা মনে করেন, ধর্মীয় মূল্যবোধ, পারিবারিক গুরুত্ব, আচরণ নিয়ন্ত্রণ করার মতো বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে, কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে। এমনকি বিভিন্ন স্কুল-কলেজ ক্যাম্পাসে অপরাধমূলক কাজের ধরন, পরিমাণ এবং শাস্তি সম্পর্কে আলোচনা করতে হবে। শিক্ষক ও অভিভাবকদের কিশোরদের সম্পর্কে আচরণ নিয়ন্ত্রণ জন্য প্রশিক্ষণ দিতে হবে। কোনো কিশোর সরাসরি প্রচলিত আইনবিরোধী কাজে জড়িত থাকলে, পুলিশকে অবগত করতে হবে।
একলাশপুর, ফরিদগঞ্জ, চাঁদপুর