ঢাকা সোমবার, ১৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ৩০ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

ভাষার মাস

ভাষাতেই আমার পরিচয়

রায়হান আহমেদ তপাদার গবেষক ও কলামিস্ট [email protected]
ভাষাতেই আমার পরিচয়

বছর পরিক্রমায় একে একে ১১টি মাস অতিক্রম করে আবার আমাদের মাঝে উপস্থিত হচ্ছে ভাষার মাস ফেব্রুয়ারি। আর তাই তো বলি, একুশ মানে মায়ের মুখের হাসি একুশ আমার মায়ের হাতের রঙিন কাঁচের চুড়ি একুশ আমার প্রিয় ভাষায় স্বাধীন মনের বুলি একুশ আমার কৃষক ভাইয়ের একমুঠো ধান একুশ আমার বাউল মনে সুরের ঐক্যতান। একুশ মানে ফাগুনের আগুনরাঙা ফুল একুশ মানে লক্ষ্য নির্ভুল একুশ মানে রফিক, শফিক, বরকত ও জব্বার একুশ মানে বাঙালি জাতির অহংকার একুশ মানে মায়ের মুখের ভাষা একুশ মানে স্বপ্ন, সাধ ও আশা। একুশ আমার শ্বাস-প্রশ্বাস একুশ তাজা রক্ত একুশ আমার প্রেম যমুনা একুশ আলোর নদী একুশ আমার গোলাপ জরা কৃষ্ণচূড়া ফুল একুশ আমার পলাশ শিমূল বাংলা ভাষার মূল একুশ আমার সবুজ নিশান স্বাধীনতার সুর। একটি দিন সাক্ষী হয়ে গেল সেই ইতিহাসের, কুঁড়ি থেকে ফুল হতে হতে ঝরে যাওয়া জীবনের শত বাঙালির প্রাণের দাবি আদায়ের আন্দোলনের, মায়ের ভাষায় কথা বলার অধিকার প্রতিষ্ঠার। রাষ্ট্রভাষা বাংলা সাক্ষী আজ সেই গৌরবের। মায়ের ভাষার জন্য জীবন বাজি রাখার অনন্য ইতিহাসকে শ্রদ্ধা জানিয়ে ১৯৯৯ সালে ইউনেস্কো একুশে ফেব্রুয়ারি দিনটিকে ঘোষণা করে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে। বছরের এই একটি মাসের জন্য লেখক-পাঠক-পুস্তক ব্যবসায়ীরা আগ্রহভরে প্রতীক্ষায় থাকেন।

তবে দুঃখজনক হলেও সত্য যে, এবার করোনা মহামারির কারণে যথাসময়ে ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’ অনুষ্ঠিত হতে পারছে না। আপাতত গ্রন্থমেলার তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে ২০ মার্চ থেকে, যা চলতে পারে এপ্রিলের প্রথমার্ধ পর্যন্ত। প্রস্তুতিও চলছে সেভাবেই। ইতোমধ্যে দেশে করোনা প্রতিরোধী ভ্যাকসিন প্রদান শুরু হয়েছে। শেষ পর্যন্ত সব কিছুই নির্ভর করবে সার্বিক পরিস্থিতির উন্নতির ওপর। চল্লিশের দশকের এক কবি আক্ষেপ করে লিখেছিলেন, ফুল ফুটুক না ফুটুক আজ বসন্ত। সেই সুরে সুর মিলিয়ে আমরাও বলতে পারি, যথাসময়ে না হলেও এটিও মূলত অমর একুশে গ্রন্থমেলাই। প্রভাত ফেরি না হলেও যেন সমস্বরে গাইতে পারিÑ আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি, কিংবা ‘মোদের গরব মোদের আশা, আমরি বাংলা ভাষা।’

কিন্তু যে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে বায়ান্নতে মাতৃভূমির অকুতোভয় সন্তানরা জীবন দিয়েছিলেন, সে ভাষার শুদ্ধতা রক্ষায় ব্যর্থ হলে পরম গৌরবময় সেই আত্মদান বৃথা যাবে। তাই ভাষাশহীদদের শ্রদ্ধা জানানোর সবচেয়ে বড় উপায় হলো বাংলা ভাষার স্বাতন্ত্র্য ও শুদ্ধতা এবং সৌন্দর্য যাতে অক্ষুণœ থাকে সে লক্ষ্যে সক্রিয় থাকা। মাতৃভাষা সহজাতভাবেই মানুষ আয়ত্ত করে থাকে বটে, যদিও তার চর্চা বা প্রয়োগে সচেতন না হলে সে ভাষার শুদ্ধতা ও বৈশিষ্ট্য বজায় থাকে না। ভাষা ব্যবহারে হেলাফেলা ও অসতর্কতার কারণে শুদ্ধতা হারাতে পারে প্রাণের ভাষা এটা মনে রাখা কর্তব্য।

ভাষার মাস, তাই ভাষার প্রতি ভালোবাসা প্রকাশের পাশাপাশি দায়বদ্ধতা সম্পর্কে সচেতনতার মাসও। ভাষার মাসে মাতৃভাষার প্রতি মানুষের ভালোবাসা জাগিয়ে তোলা এবং ভাষা-সচেতনতা গড়ে তোলার কাজটি তাৎপর্যপূর্ণভাবে শুরু করা এবং তার ধারাবাহিকতা বজায় রাখা প্রয়োজন। নবীন শিক্ষার্থীদের জ্ঞান, আকাক্সক্ষা আর স্বপ্নের আদান-প্রদান মাতৃভাষার মাধ্যমেই সবচেয়ে সফলভাবে সম্পন্ন হতে পারে। আর এটাও অনস্বীকার্য যে, ভাষার ভালোবাসা লালনের মধ্য দিয়ে নিজস্ব ভাষাভাষী মানুষের প্রতি ভালোবাসা ও মমতা তৈরি হয়, যা সুখে-দুঃখে, দুর্যোগ-দুর্বিপাকে একে অন্যকে পাশে রাখে। আশঙ্কার বিষয় হলো, বাংলা ভাষায় ইংরেজিসহ বিদেশি শব্দের প্রবল অনুপ্রবেশ ঘটছে। এ বিষয়ে সতর্কতা জরুরি। লক্ষ্য রাখতে হবে পরিচর্যার অভাবে যেন বাংলা ভাষার বিশুদ্ধতা বজায় থাকে। যে দিবস বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা বাঙালিরাই পালন করত, এখন তা যথাযোগ্য মর্যাদায় পালিত হয় জাতিসংঘের সব সদস্য রাষ্ট্রে। স্মরিত হন বাংলা ভাষার জন্য শহীদ ও সংগ্রামীরা। আজ বাংলা ভাষার শহীদ মিনার স্থান পেয়েছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা সংক্রান্ত জাতিসংঘের অফিসিয়াল সাইটে। নিজের মাতৃভাষার প্রতি সম্মান দেখানোর পাশাপাশি বিশ্বের সব জাতি এখন মনে রাখে বাংলা ভাষাকেও। শুধু কি একুশ তারিখ? গোটা ফেব্রুয়ারি মাসই কি এখন বাংলার ভাষার মাস নয়? সারা ফেব্রুয়ারিজুড়েই মুখর থাকে ঢাকা, কলকাতা, আগরতলা, শিলচরের মতো বাঙালির কেন্দ্রভূমিগুলো মুখর থাকে দূরদেশের বাঙালি অধ্যুষিত জনপদগুলোও।

একুশ যদি মাথা উঁচু করার দিন হয়, তাহলে ফেব্রুয়ারি মাসও নিশ্চয়ই মাথা উঁচু করার মাস। ফেব্রুয়ারি আদতে বাংলা ভাষার ফাগুন, বাংলা ভাষার বসন্ত দিন। রবীন্দ্রনাথের কথাই মনে করিয়ে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী, দেবো আর নেবো, মিলাবো আর মিলবো। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, যা সুন্দর, যা ভালো তার কোনো দেশকাল নেই। একুশের আত্মদানের ভেতর দিয়ে আমরা জাতি হিসেবে বিশ্ব দরবারে মর্যাদার আসন পেয়েছি। এ জন্যই তো ভাষাশহীদের মাসে খবর পেয়েছি, জাতিসংঘ সদর দপ্তরের সামনে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার অনন্য স্বীকৃতির নিদর্শন হিসেবে ভাস্কর্য স্থাপনের মধ্য দিয়ে বাঙালির জাতীয় জীবনে সংযোজিত হচ্ছে এক নতুন অধ্যায়।

আন্তর্জাতিক গৌরব ও সাফল্যের এক নতুন সূচক। ভাষার জন্য লড়াই হয়েছে কমবেশি অনেক দেশেই।

কিন্তু ভাষার জন্য অকাতরে রক্ত দিয়েছে শুধু বাঙালিরা। কোনো জনগোষ্ঠীর ভাষাকে দমন করার প্রবণতা বর্ণবাদী চেতনার সমতুল্য। মার্কিন মহামানব মার্টিন লুথার কিং বর্ণবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করে নোবেল প্রাইজ পেয়েও উগ্র জঙ্গিবাদের হাতে জীবন দিলেন। পাকিস্তান সরকারও তো বর্ণবাদী সরকার ছিল। ওদের মর্মমূলে ছিল বাঙালি বিদ্বেষ। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিও আমাদের জাতীয় জীবনে এই সংকট নেমে এসেছিল। ধর্মের সঙ্গে আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতির সংঘাত বাঁধিয়ে দিয়েছিল। এ সংঘাত থেকে রক্ষা করেছেন একুশের আত্মদানকারীরা। আত্মত্যাগের ওপর সভ্যতার ভিত রচিত হয়।

এ কথা বললে ভুল হবে না যে, বাঙালির সভ্যতার ভিত রচিত হয়েছে একুশের শহীদের আত্মদানের ওপর। ভাষাই মানুষকে মানুষ করে তোলে। নির্মম সত্য কথা। মানুষের ব্যক্তিজীবন, সমাজ জীবন, রাষ্ট্র জীবন ও জাতীয় জীবনের বিকাশ ঘটে ভাষার মাধ্যমে। ভাষা মানুষের বেঁচে থাকার হাতিয়ার। এ হাতিয়ার কেড়ে নিতে চেয়েছিল শাসকরা। রুখে দিয়েছিল ভাষাশহীদরা। যে মানুষের মতো মানুষ হতে হলে চাই মাতৃভাষা, চাই নিজেদের সাহিত্য ও সংস্কৃতি। একুশে ফেব্রুয়ারি ইতিহাসকে সফল করে তুলতে হলে মাতৃভাষা আর মাতৃভাষার সাহিত্যকে আমাদের জীবনের উপযোগী করে গড়ে তুলতে হবে। করতে হবে তাকে সব জ্ঞানের বাহন। একুশের শহীদরা বুকের রক্ত ঢেলে দিয়ে প্রমাণ করেছেন, আমরা জাতি হিসেবে মহত্ত্বভ্রষ্ট নই, প্রাণহীন নই, জীবন্মৃত নই, প্রাণের যে বৈশিষ্ট্য তা আমাদের আছে। প্রাণ দিয়েই আমরা প্রাণের মূল্য রক্ষা করেছি, জীবন দিয়ে জীবনের মর্যাদা খাড়া করেছি। রক্ত দিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করেছি। মানুষ কল্পনা করে, স্বপ্ন দেখে, প্রেমে, বিরহে অশ্রুবর্ষণ করে, বিদ্রোহে প্রতিবাদে জেগে ওঠে মাতৃভাষার মাধ্যমে। ধার করা ভাষায় প-িত হওয়া যায়, মানুষ হওয়া যায় না। ভাষার মাস ফেব্রুয়ারিতে অমর একুশে গ্রন্থমেলার আয়োজন দেশের প্রধান সাংস্কৃতিক ঘটনা। ভাষার মাসজুড়ে জাতীয় মননের প্রতীক বাংলা একাডেমির তত্ত্বাবধানে একাডেমি প্রাঙ্গণ ও অধুনা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আয়োজন হয়ে থাকে প্রাণের গ্রন্থমেলা।

এমনকি লেখক-পাঠকদের প্রকৃত মিলনমেলায় পরিণত হয় এই মেলা। উদযাপিত হয় নতুন বইয়ের মহোৎসব হিসেবে। বছরের আর কোনো সময় বাংলা ভাষায় এত বিপুল সংখ্যক বই প্রকাশ হয় না। সেদিক দিয়ে ভাষার মাস ফেব্রুয়ারিকে হাজারো বইয়ের প্রকাশের মাস হিসেবেও অভিহিত করা চলে। বছরের এই একটি মাসের জন্য লেখক-পাঠক-পুস্তক ব্যবসায়ীরা আগ্রহভরে প্রতীক্ষায় থাকেন। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য, এবার করোনা মহামারির কারণে যথাসময়ে ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’ অনুষ্ঠিত হতে পারছে না। আপাতত গ্রন্থমেলার তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে ২০ মার্চ থেকে, যা চলতে পারে এপ্রিলের প্রথমার্ধ পর্যন্ত। প্রস্তুতিও চলছে সেভাবেই। এরই মধ্যে দেশে করোনা প্রতিরোধী ভ্যাকসিন প্রদান শুরু হয়েছে। শেষ পর্যন্ত সব কিছুই নির্ভর করবে সার্বিক পরিস্থিতির উন্নতির ওপর। চল্লিশের দশকের এক কবি আক্ষেপ করে লিখেছিলেন, ফুল ফুটুক না ফুটুক আজ বসন্ত। সেই সুরে সুর মিলিয়ে আমরাও বলতে পারি, যথাসময়ে না হলেও এটিও মূলত অমর একুশে গ্রন্থমেলাই। প্রভাত ফেরি না হলেও যেন সমস্বরে গাইতে পারি আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি কিংবা ‘মোদের গরব মোদের আশা, আমরি বাংলা ভাষা।’

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত