বাংলাদেশে ডিজিটাল সাক্ষরতা কোন স্তরে?

শাওয়াল খান

প্রকাশ : ১৭ জুলাই ২০২০, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

শুরু থেকে সাক্ষরতা নিজস্ব এক বিবর্তনশৈলীর মধ্য দিয়ে আবর্তিত হচ্ছে। সেই আবর্তনের ইতিহাস দীর্ঘ। মাতৃভাষায় নিজের নাম-ঠিকানা লিখতে পারা পড়তে পারা তথা নিত্যপ্রয়োজনীয় হিসাব-নিকাশ করতে পারার মধ্য দিয়ে যে ধারণার সূচনা, সেটা আজ জীবনের প্রতিটি প্রয়োজনকে স্পর্শ করে নিজেকে একটা নতুন মাত্রা দিয়েছে। সেই নতুন মাত্রার নাম ডিজিটাল সাক্ষরতা দক্ষতা। ডিজিটাল সাক্ষরতা দক্ষতা মানুষকে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিিত করে তোলে, সময়ের দাবি মিটিয়ে সময়কে অতিক্রম করার পথ দেখায় এবং নিজেকে সময়োপযোগী করে প্রস্তুত করার সুযোগ এনে দেয়। এককথায় জীবনযুদ্ধের এক বলিষ্ঠ হাতিয়ার ডিজিটাল সাক্ষরতা দক্ষতা।

বিবর্তনের ধারায় সাক্ষরতা বলতে আজ নিজ নিজ মাতৃভাষার গণ্ডি অতিক্রম করে ডিজিটাল আঙ্গিকে বহুভাষিক অঙ্গনে নিজের দক্ষতা অর্জনকে বোঝায়। সে ধারাবাহিকতায় ২০১৯ সালের আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবসের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয় Literacy and Multilingualism বা বহুভাষিক সাক্ষরতা, উন্নত জীবনের নিশ্চয়তা। কারণ সারা বিশ্বই এখন যোগ্য মানুষের কর্মভূমি। জাতিসংঘের সদস্যভুক্ত ১৯৩টি দেশের অধিকাংশ মানুষ বহুভাষিক। বর্তমান বিশ্বে ৭ হাজার ৯৭টি ভাষা মৌখিক যোগাযোগের জন্য ব্যবহৃত হয়। ২৩টি ভাষা বেশি ব্যবহৃত হয়, বিশ্বের মোট জনসংখ্যার অর্ধেকের বেশি মানুষ এই ২৩টি ভাষায় কথা বলে। তাই মানুষের কর্মপরিধি বিবেচনায় সাক্ষরতার বৈশিষ্ট্য ও পরিধিতেও রূপান্তর ঘটেছে। বিশ্বজুড়ে এখন সাক্ষরতা বলতে ডিজিটাল সাক্ষরতাকে বোঝানো হচ্ছে। ডিজিটাল শব্দের সঙ্গে আন্তর্জাতিক যোগাযোগ নেটওয়ার্ক ইন্টারনেট এবং ইন্টারনেট ব্যবহার উপযোগী যন্ত্রের যোগ রয়েছে, তাই ডিজিটাল সাক্ষরতা বলতে মানুষের দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত (স্মার্টফোনসেট, কম্পিউটার, ট্যাব, ডিজিটাল নোটবুক, ক্যালকুলেটর, ডিজিটাল স্কেল ইত্যাদি) যন্ত্রের ভাষা পড়তে পারা, অনুধাবন করতে পারা এবং দক্ষতার সঙ্গে এসব যন্ত্র ব্যবহারের কৌশল রপ্ত করে তা ব্যবহারিক ক্ষেত্রে প্রয়োগ করতে পারাকে বোঝায়। বিশ্বজুড়ে ডিজিটাল সংস্কৃতির এমনই হাওয়া, দক্ষ ডিজিটাল সাক্ষরতা ছাড়া যেন কিছুই যাবে না পাওয়া। কথাটা একেবারে উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়। ডিজিটাল সাক্ষরতা এখন অতিমাত্রায় জীবন ঘনিষ্ঠ শব্দ, যা জীবনের পরতে পরতে প্রতিটি প্রয়োজনকে ঘিরে আবর্তিত হচ্ছে। ফলে ডিজিটাল সংস্কৃতিকে এড়িয়ে চলা এখন অসম্ভব প্রায়। কিন্তু এই সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে কিছু প্রস্তুতির ব্যাপারও আছে। প্রস্তুতি যাই হোক, বাংলদেশ নিজেকে ডিজিটাল সংস্কৃতিতে শামিল করেছে, ২০২১ সাল নাগাদ বাংলাদেশকে ডিজিটালরূপে পরিণত করার লক্ষ্যে। আর কয়েক মাস পেরোলেই প্রকৃতির ক্ষণ গণনার ধারাবাহিকতায় ২০২১ সালের নাগাল পেয়ে যাব, এরই মধ্যে চারদিকে ডিজিটাল বাংলাদেশ- ডিজিটাল বাংলাদেশ রব উঠলেও সত্যিকারের ডিজিটাল বাংলাদেশের নাগাল পাব কি? প্রশ্ন হচ্ছে বাস্তবতা কি বলে?

একটি দেশের ডিজিটাল সাক্ষরতার সূচকই নির্দেশ করে দেশটি সত্যিকার অর্থে ডিজিটাল কি না। সে ক্ষেত্রে আমাদের সাক্ষরতা সূচক কি বলে? ডিজিটাল সাক্ষরতা অর্জন করতে হলে ন্যূনতম কিছু শর্ত পূরণ করতে হয়। তন্মধ্যে পয়লা শর্ত হচ্ছে, মৌলিক সাক্ষরতায় দক্ষতা অর্জন এবং সাক্ষরতা দক্ষতা চর্চার ক্ষেত্র সম্প্রসারণ। দ্বিতীয়ত, ডিজিটাল শৈলী বা ডিজিটাল কর্মকা- প্রয়োগের সঙ্গে যন্ত্রের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। সেই বিবেচনায় ডিজিটাল সাক্ষরতা চর্চার সরঞ্জাম বা সামগ্রীগুলো সংগ্রহ ও ব্যবহারের আর্থিক এবং ব্যবহারিক সামর্থ্য অর্জন। তৃতীয়ত, ডিজিটাল সংস্কৃতি প্রয়োগ বা ডিজিটাল সাক্ষরতা জ্ঞান চর্চার আদব অর্জন। চতুর্থত, ব্যক্তিগত এবং প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে ডিজিটাল যোগাযোগ বা কার্যক্রম পরিচালনার নিরাপদ সামাজিক প্রেক্ষাপট তৈরি। পঞ্চমত, ডিজিটাল কর্মকাণ্ডের অপপ্রয়োগ রোধকরণ। এসবের একটি শর্তও অপূর্ণ থাকলে ডিজিটাল দেশ গড়ার স্বপ্ন বা ডিজিটাল সাক্ষরতা অর্জন অসার গল্পেরই নামান্তর মাত্র। বাংলাদেশের মৌলিক সাক্ষরতার হার কত? শুধু তাই নয়, অর্জিত সাক্ষরতার দক্ষতা কোন পর্যায়ে সে সূচকই ডিজিটাল সাক্ষরতার সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কিত। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী (Report on Bangladesh Sample Vital Statistics 2018) বর্তমানে দেশের সাক্ষরতার হার ৭৩ দশমিক নয় শতাংশ। অর্থাৎ এখনও ২৬ দশমিক এক শতাংশ লোক নিরক্ষর। এই পরিস্থিতিতে ২০২১ সাল নাগাদ বাংলাদেশ কীভাবে ডিজিটাল বাংলাদেশে পরিণত হবে? যে কোনো ডিজিটাল দেশের মূল চালিকাশক্তি ডিজিটাল প্রযুক্তি। মৌলিক সাক্ষরতায় দক্ষতা অর্জন সম্ভব না হলে ডিজিটাল প্রযুক্তি চালানো জটিলই বটে। সর্বজনীন মৌলিক সাক্ষরতা অর্জনের আগে সমাজের সর্বস্তরে ডিজিটাল প্রযুক্তি সমাজ ব্যবস্থায় বৈষম্য ডেকে আনবে। তাই সর্বাগ্রে আমাদের মৌলিক সাক্ষরতায় গুরুত্ব দিতে হবে। মৌলিক সাক্ষরতায় দক্ষতা অর্জনের মধ্য দিয়েই ডিজিটাল সাক্ষরতা অর্জনের পথ প্রশস্ত হবে। রাষ্ট্রের ডিজিটাল কর্মপদ্ধতির উদ্দেশ্য জনগণের দোরগোড়ায় প্রযুক্তির সাহায্যে সরকারের সেবা পৌঁছে দেওয়া, নাগরিকের জীবনযাত্রাকে সহজ করা। ডিজিটাল সাক্ষরতা অর্জনের মাধ্যমে জনগণ সেই সেবা গ্রহণের জন্য প্রস্তুত হতে পারে, অন্যথায় ভোগান্তিই বাড়বে।

একটি ডিজিটাল কাঠামোর দেশের সরকার ব্যবস্থা পরিচালিত হবে প্রযুক্তিনির্ভর কর্মসূচির মাধ্যমে, ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালিত হবে প্রযুক্তির মাধ্যমে। যেখানে ভূমিব্যবস্থা, কৃষিব্যবস্থা, বিচারব্যবস্থা, শিক্ষাব্যবস্থা, স্বাস্থ্যব্যবস্থা, নিরাপত্তাব্যবস্থা, প্রতিরক্ষাব্যবস্থা, বিনোদনব্যবস্থা, বাজারব্যবস্থা, সব আর্থিকব্যবস্থা, ভ্রমণব্যবস্থা ডিজিটাল হবে সেখানে সরকারি হিসাবে উল্লিখিত ওই ২৬ দশমিক এক শতাংশ নিরক্ষর নাগরিকের কি দশা হবে? শুধু তাই নয়, হিসাবে নির্দেশিত ৭৩ দশমিক ৯ শতাংশ নাগরিকও কি ডিজিটাল সাক্ষরতা জ্ঞানসম্পন্ন? প্রথাগত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত সব মানুষ কি ডিজিটাল সাক্ষরতা জ্ঞানসম্পন্ন? তার কোনো পরিসংখ্যান আমাদের আছে?

দক্ষ মানবসম্পদ উন্নয়নের অন্যতম শর্ত মৌলিক সাক্ষরতা জ্ঞানসম্পন্ন সুস্থ দেহ ও সুস্থ মনের মানুষ তৈরি। এ লক্ষ্যে শিক্ষার সুযোগবঞ্চিত জনগোষ্ঠীকে সাক্ষরজ্ঞান দান, জীবনব্যাপী শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি, কারিগরি ও বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে জীবিকায়নে দক্ষ মানবসম্পদে উন্নীতকরণ, আত্মকর্মসংস্থান তৈরির প্রেক্ষাপট সৃষ্টির যোগ্য করে গড়ে তোলা এবং বিদ্যালয়বহির্ভূত ও ঝরেপড়া শিশুদের শিক্ষার বিকল্প সুযোগ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা আইন ২০১৪ প্রণীত হয়। এ আইনের আলোকে কর্মসূচিও গৃহীত হয়, উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরো সারা দেশে নাগরিক সমাজের সুবিধার্থে বয়সভিত্তিক মৌলিক সাক্ষরতাবিষয়ক কর্মসূচি পরিচালনা করছে, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি)-৪ এবং সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা অনুযায়ী। এসডিজি-৪ এর লক্ষ্য হচ্ছে- অন্তর্ভুক্তিমূলক, সমতাপূর্ণ ও মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা এবং সবার জন্য জীবনব্যাপী শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি। এসডিজির সব লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য সরকার সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা (২০১৬-২০২০) প্রণয়ন করেছে। উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা আইন ২০১৪, সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা এবং এসডিজি-৪ এর গুরুত্ব বিবেচনায় আন্তর্জাতিক ও জাতীয় লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরো পরিকল্পনা অনুযায়ী সাক্ষরতা কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। যেমন-

১. মৌলিক সাক্ষরতা প্রকল্প (৬৪ জেলা) : দেশ থেকে নিরক্ষরতা দূরীকরণের লক্ষ্যে ১৫ এবং তদূর্ধ্ব বয়সী নিরক্ষর নারী-পুরুষকে সাক্ষরতাজ্ঞান প্রদানের জন্য উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরো ‘মৌলিক সাক্ষরতা প্রকল্প (৬৪ জেলা)’ বাস্তবায়ন করছে। এ কর্মসূচির মাধ্যমে দেশের ৬৪ জেলায় নির্বাচিত ২৫০টি উপজেলায় ১৫ থেকে ৪৫ বছর বয়সী ৪৫ লাখ নিরক্ষরকে সাক্ষরতাজ্ঞান প্রদান করা হচ্ছে।

২. চতুর্থ প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচি (পিইডিপি-৪)-এর আওতায় বিদ্যালয়বহির্ভূত শিশুদের জন্য উপানুষ্ঠানিক প্রাথমিক শিক্ষা : সব শিশুর জন্য মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর কর্তৃক ‘চতুর্থ প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচি (পিইডিপি-৪)’ বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির হার শতভাগে উন্নীতকরণ, ঝরেপড়া রোধ এবং মানসম্মত শিক্ষা প্রদানের লক্ষ্যে সরকার বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছে, যেমন- বিনামূল্যে পাঠ্যবই বিতরণ, উপবৃত্তি প্রদান, মিড-ডে মিল, বিদ্যালয়ের অবকাঠামো উন্নয়ন, পর্যাপ্ত শিক্ষক নিয়োগের মাধ্যমে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত কমানো ইত্যাদি।

৩. বিদ্যালয়বহির্ভূত ৮-১৪ বছর ১০ লাখ শিশুকে উপানুষ্ঠানিক প্রাথমিক শিক্ষা প্রদানের উদ্যোগ : প্রাথমিক শিক্ষায় অনেক অগ্রগতি সাধনের পরও সরকারের হিসাব মতে দরিদ্রতা, অনগ্রসরতা, শিশুশ্রম, ভৌগোলিক প্রতিবন্ধকতা ইত্যাদি কারণে এখনও অনেক শিশু বিদ্যালয়বহির্ভূত রয়েছে। উপানুষ্ঠানিক প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থায় এসব শিশুর প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করার জন্য পিইডিপি-৪ এর সাব-কম্পোনেন্ট ২.৫-এর আওতায় ৮-১৪ বছর বয়সী বিদ্যালয়বহির্ভূত ১০ লাখ শিশুকে উপানুষ্ঠানিক প্রাথমিক শিক্ষা প্রদানের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিদ্যালয়বহির্ভূত শিশুদের উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রাথমিক শিক্ষা প্রদানের জন্য উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোকে দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছে। উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরো কর্তৃক এরই মধ্যে ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, সুনামগঞ্জ, গাইবান্ধা ও কিশোরগঞ্জ- এ ছয়টি জেলায় চারটি মডেলে ৮ থেকে ১৪ বছর বয়সী এক লাখ শিশুর শিখন কার্যক্রমের পাইলটিং শুরু করা হয়েছে। বাকি নয় লাখ বিদ্যালয়বহির্ভূত শিশুর শিখন কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন। এই হিসাব আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস ২০১৯ উপলক্ষে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রদত্ত।

৪. উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা বোর্ড : উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা আইন, ২০১৪-এর আলোকে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা বোর্ড প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। বোর্ডের মাধ্যমে উপানুষ্ঠানিক প্রাথমিক শিক্ষা, সাক্ষরতা বা মৌলিক শিক্ষা, প্রি-ভোকেশনাল-১ ও ২ স্তরের পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন করা হবে। বোর্ডের মাধ্যমে সারা দেশে সরকারি-বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠান যারা উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার সঙ্গে জড়িত তাদের প্রতিষ্ঠানের রেজিস্ট্রেশন, শিক্ষকদের যোগ্যতা ও দক্ষতা নিরূপণ, শিক্ষার্থীদের নিবন্ধন, প্রশ্নপত্র প্রণয়ন, পরীক্ষা গ্রহণ ও সনদ প্রদান করা হবে।

৫. উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচি (এনএফইডিপি) : উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রম শুরু থেকেই প্রকল্পনির্ভর কর্মসূচির আওতায় বাস্তবায়ন করা হয়েছে, যে কারণে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা সাব-সেক্টরে কোনো টেকসই প্রাতিষ্ঠানিক ও সাংগঠনিক কাঠামো গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। ফলে দেশে নিরক্ষরতা সম্পূর্ণ দূরীকরণসহ জীবনব্যাপী শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে কাক্সিক্ষত অগ্রগতি সাধিত হয়নি। এই বাস্তবতার নিরিখে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ক্ষেত্রে একটি বৃহৎ কর্মসূচিভিত্তিক প্রস্তাবনা Non-Formal Education Development Program (NFEDP)-প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় হাতে নিয়েছে।

প্রস্তাবিত এই উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচির আওতা বেশ সমৃদ্ধ। যেমন-

* ১৫+ বয়সী ৫০ লাখ নিরক্ষরকে মৌলিক সাক্ষরতা প্রদান করা হবে।

* ১৫-৪৫ বছর বয়সী ১৫ লাখ যুব ও বয়স্ক নব্যসাক্ষরকে দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ প্রদান করা হবে।

* ৮-১৪ বছর বয়সী ১০ লাখ বিদ্যালয়বহির্ভূত শিশুকে উপানুষ্ঠানিক প্রাথমিক শিক্ষা প্রদান করা হবে।

* ৬৪ জেলায় ৬৪টি জীবিকায়ন দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র নির্মাণ করা হবে।

* দেশের প্রতিটি ইউনিয়নে একটি করে এবং কিছু শহর এলাকায় সর্বমোট ৫ হাজার ২৫টি ICT বেইজড স্থায়ী কমিউনিটি লার্নিং সেন্টার (সিএলসি) নির্মাণ করা হবে। সময়ের চাহিদা অনুসারে, নাগরিক সমাজের জীবনমান উন্নয়নে সর্বাগ্রে প্রয়োজন মৌলিক সাক্ষরতা, সেই সঙ্গে ডিজিটাল সাক্ষরতা দক্ষতা অর্জনে পূর্ণ সহায়তা। ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ : রূপকল্প ২০২১’ ও জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি)-এর লক্ষ (কেউ পিছিয়ে থাকবে না) অর্জনে বাংলাদেশ দায়বদ্ধ। কিন্তু আমাদের মৌলিক সাক্ষরতাই এখনও কাক্সিক্ষত পর্যায়ে পৌঁছেনি। মৌলিক সাক্ষরতা কর্মসূচির সফলতার ওপর অনেকখানি নির্ভর করছে অতি নির্ভরশীল ডিজিটাল সাক্ষরতা দক্ষতা।

ডিজিটাল সাক্ষরতার আওতায় কি কর্মসূচিকে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে?

চলমান করোনাকালীন সময়ে দীর্ঘদিন দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ। তাই অনন্যোপায় হয়ে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনলাইনে শিক্ষাক্রম পরিচালনা করতে বাধ্য হচ্ছে। এতে কিন্তু দেশের সর্বত্র সব শিক্ষার্থী সমান সুযোগ পাচ্ছে না। শিক্ষার্থীরা সুযোগ পাচ্ছে না ডিজিটাল সাক্ষরতা অর্জন না করার কারণে নয়, পারিপার্শ্বিক এবং আর্থিক নানা কারণে। শিক্ষার্থীদের ঝরেপড়ার হার কমিয়ে এনে ক্লাসে মনোযোগ বাড়ানোর জন্যে ২০১৩ সাল থেকে শ্রেণিকক্ষে মাল্টিমিডিয়ার সাহায্যে কার্যক্রম শুরু করা হয়। এ জন্য আনুষঙ্গিক সরঞ্জাম যেমন- ল্যাপটপ, প্রজেক্টর, প্রজেক্টর স্ক্রিন, ইন্টারনেট মডেম ও সাউন্ড সিস্টেম (শব্দযন্ত্র) ব্যবহার করে শিক্ষার্থীদের সামনে সংশ্লিষ্ট বিষয় তুলে ধরা হয়। ছবি, গ্রাফিক্স ইত্যাদি ব্যবহারের মাধ্যমে বিষয়টি সুন্দরভাবে উপস্থাপন করা হয় বলে শিক্ষার্থীরা তা সহজেই বুঝতে পারে। পাঠ্যপুস্তকের বিষয়গুলো শিক্ষার্থীদের কাছে আরও আকর্ষণীয় ও সহজবোধ্য করে উপস্থাপন করতে এরই মধ্যে চালু হয়েছে ডিজিটাল কনটেন্ট (বিষয়বস্তু) অথচ তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক শিক্ষা উপকরণ নষ্ট, মাল্টিমিডিয়া শ্রেণিকক্ষ এবং প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকের অভাবে উপজেলায় প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে মাল্টিমিডিয়া সংশ্লিষ্ট সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে শিশু শিক্ষার্থীরা। বিষয়টি নিঃসন্দেহে হতাশজনক, তবে বিষয়টি এখানেই শেষ নয়, দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, এখান থেকেই ধাপে ধাপে ফুটে উঠছে ডিজিটাল প্রতারণা বা হতাশার চিত্র, যা শিশু শিক্ষার্থীদের জিম্মি করে করা হচ্ছে। মাল্টিমিডিয়াভিত্তিক ক্লাস বাধ্যতামূলক হলেও দক্ষ শিক্ষক ও শ্রেণিকক্ষের অভাব এবং মাল্টিমিডিয়ার সরঞ্জামাদি ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়ায় বেশিরভাগ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এই পদ্ধতিতে ক্লাস হচ্ছে না। অথচ মাল্টিমিডিয়া ক্লাস হচ্ছে- এই মর্মে উপজেলা শিক্ষা কার্যালয়ে প্রতিবেদন ঠিকই পাঠানো হচ্ছে। এসব বিস্তারিত উল্লেখ করে দৈনিক প্রথম আলো প্রকাশিত ৩১ জুলাই ২০১৯-এর এক সরেজমিন প্রতিবেদন আমাদের বিস্মিত করেছে। এমন গোলমেলে মাল্টিমিডিয়া শিক্ষা প্রকৃত ডিজিটাল বাংলাদেশ নির্মাণে কি ভূমিকা রাখবে?

বাংলাদেশে ইন্টারনেটের ব্যবহার উল্লেখযোগ্য হারে বেড়ে গেলেও মোট জনসংখ্যার একটি বড় অংশের কাছে ইন্টারনেট সহজলভ্য নয়। এক্ষেত্রে বড় প্রতিবন্ধকতা হলো ডিজিটাল সাক্ষরতাজ্ঞানের অভাব ও মোবাইল ইন্টারনেট ব্যবহারের সুবিধা সম্পর্কে অপর্যাপ্ত ধারণা। সময়ের ধারাবাহিকতায় মানুষের কর্মধারার পরিবর্তন, কর্মপ্রবাহে অধিক মাত্রায় তথ্যপ্রযুক্তির সম্পৃক্ততা সেই সঙ্গে প্রযুক্তি ব্যবহারে গতি সঞ্চারে বাংলাদেশে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ডিজিটাল অবকাঠামো নির্মাণের ক্ষেত্রে ডিজিটাল সাক্ষরতার একটি মৌলিক ভূমিকা রয়েছে। আর প্রযুক্তি ব্যবহারকারীদের ডিজিটাল সাক্ষরতায় দক্ষতা বৃদ্ধির এবং প্রযুক্তির কার্যপরিসর বৃদ্ধির জন্য সরকার, প্রযুক্তি ব্যবহারকারী এবং মোবাইল ফোন অপারেটর যারা প্রযুক্তি পরিষেবার সঙ্গে যুক্ত বা এই ব্যবসা পরিচালনা করছেন তারা সমন্বিতভাবে উদ্যোগ নিয়ে সমাজে ডিজিটাল সাক্ষরতা দক্ষতা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। ইন্টারনেট ব্যবহারে ব্যক্তিগত দক্ষতা বৃদ্ধি এবং নিরাপদ ব্যবহার নিশ্চিতকরণের মধ্যদিয়ে ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠনে যার যার পর্যায় থেকে ভূমিকা রাখা সম্ভব। ডিজিটাল কর্মপ্রবাহে ইন্টারনেটের গতির বিষয়টা যেমন বিবেচ্য তেমনি ইন্টারনেট ব্যবহারের স্বাধীনতার কথাও ভাবতে হবে। বাংলাদেশের সাধারণ নাগরিক ইন্টারনেট ব্যবহারের ক্ষেত্রে কতটা স্বাধীন সে, তাও বিবেচনায় আনতে হবে।

সরকারি হিসাব মতে, দেশের ৭৩ দশমিক ৯ শতাংশ লোক মৌলিক সাক্ষরতাজ্ঞান সম্পন্ন। যদিও দেশের চেহারায় তেমনটা প্রতিফলিত হয় না। মৌলিক সাক্ষরতাজ্ঞান সমৃদ্ধ সব নাগরিক ডিজিটাল সাক্ষরতাজ্ঞান সমৃদ্ধ নয়। শুধু তাই নয় প্রথাগত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত সব মানুষ কি ডিজিটাল সাক্ষরতাজ্ঞান সম্পন্ন?

এখনও অনেক তথাকথিত শিক্ষিত মানুষ আছেন যারা আধুনিক ডিজিটাল কাজকর্মের সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ত করার সক্ষমতা অর্জন করেনি। কারণ প্রতিনিয়ত প্রযুক্তির নতুন নতুন আবির্ভাব। তা হলে আমরা সহজে অনুমান করতে পারি দেশের সামগ্রিক জনগোষ্ঠীর বিরাট একটা অংশ ডিজিটালজ্ঞান সমৃদ্ধ নয় বা প্রযুক্তি ব্যবহারে অভ্যস্ত নয়। জনগোষ্ঠীর বিশাল একটা অংশকে ডিজিটাল সাক্ষরতার বাইরে রেখে আমরা যতই ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার নিমিত্তে ই-গভর্নমেন্ট, ই-কমার্স, টেলি-মেডিসিন সেবা, ই-শিক্ষা কর্মসূচি ইত্যাদি কার্যক্রম মাঠে-ময়দানে ছড়িয়ে দিই না কেন, তা কি সর্বসাধারণের জন্য সমান সুযোগ এবং নাগরিক অধিকার চর্চায় সমতা আনতে সক্ষম হবে? নাগরিক অধিকার বলে বৈষম্যহীন জ্ঞানমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থার কল্যাণ সব নাগরিককে কি সমানভাবে স্পর্শ করবে? নাকি নতুন করে নতুন উদ্যমে সমাজে ডিজিটাল ডিভাইড তৈরি করবে? ইন্টারনেট ব্যবহারের স্বাধীনতা, সক্ষমতা, নিরবচ্ছিন্ন ইন্টারনেট প্রাপ্তির নিশ্চয়তা এবং ইন্টারনেট ও স্মার্টফোন ব্যবহারকারীদের মধ্যে ডিজিটাল কর্মসূচির বিস্তরণ ঘটানো সম্ভব নাহলে সমাজে প্রযুক্তিগত অর্থাৎ ডিজিটাল বৈষম্য দারুণভাবে ক্ষতিকর প্রভাব বিস্তার করবে। ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আইসিটি বিভাগের বরাতে জানতে পারি, বর্তমানে দেশে প্রায় ১৫ কোটির বেশি মোবাইল ফোন গ্রাহক এবং ৯ কোটির বেশি ইন্টারনেট ব্যবহারকারী রয়েছেন। ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের ৮ কোটির বেশিরভাগ গ্রাহকই তাদের মোবাইল ফোনের মাধ্যমে এটি ব্যবহার করে থাকেন। প্রশ্ন হচ্ছে, ১৫ কোটি গ্রাহক মানেই ১৫ কোটি মানুষের কাছে মোবাইল পৌঁছেছে এমনটা ধরে নেওয়ার কোনো অবকাশ নেই। কারণ একেকজন গ্রাহক একাধিক মোবাইল ফোনের গ্রাহক হতে পারেন বিধি মোতাবেক। সেই সুবাদে একেকজন ধনাঢ্য ব্যক্তি একাধিক মোবাইল ফোনের গ্রাহক বা সংগ্রাহক। অনেক দরিদ্র নাগরিক আছেন, যাদের বরাতে এসবের একটাও জোটেনি, যা আইসিটি বিভাগের হিসাবে উল্লেখ নেই। অর্থাৎ হিসাবটা এখানেও গোলমেলে।

আমাদের সবাইকে যার যার প্রয়োজন অনুসারে প্রযুক্তি ব্যবহারের সক্ষমতা অর্জন করতে হবে, এটা সময়ের দাবি। এখন ইন্টারনেটের মাধ্যমে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির রেজিস্ট্রেশন বানিবন্ধন যেমন করা যাচ্ছে, তেমনি পরীক্ষার ফলও প্রকাশ করা হচ্ছে। বিভিন্ন ধরনের অফিসিয়াল বা সরকারি ফরম সংগ্রহ, ট্যাক্স বা আয়কর রিটার্ন দাখিল, টেন্ডার বা দরপত্রে অংশগ্রহণ, জমির পর্চা, খাজনা প্রাপ্তি বা পরিশোধ ইত্যাদি কাজকর্ম, নিত্যপণ্যের কেনাকাটা অনলাইনেই সম্পন্ন করা যাচ্ছে। এদিক থেকে সমাজের সুবিধাপ্রাপ্ত তরুণ প্রজন্ম অনেকটা এগিয়ে। তারা ক্লাউড কম্পিউটিং, থ্রিডি প্রিন্টিং, বিগ ডাটা, অগমেন্টেড রিয়্যালিটি, ভার্চুয়াল রিয়েলিটি, ভিডিও গেমস, অ্যানিমেশন, হরেক রকম নিত্যনতুন মোবাইল অ্যাপসের সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ত করছে এবং নিজেদের সক্ষম করে গড়ে তুলছে অভিজ্ঞতা অর্জনের মধ্য দিয়ে। ডিজিটাল জ্ঞানে পারদর্শী না হয়ে উপায় নেই, কারণ বিশ্ব এখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, রোবোটিকস, আইওটি (ইন্টারনেট অব থিংকস), বিগ ডাটা এবং ফাইভজি মোবাইল ব্রডব্যান্ডকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে কাজের প্রয়োজনে।

ডিজিটাল সাক্ষরতা, মৌলিক সাক্ষরতা, আধুনিক প্রযুক্তি এসব শুধু শিক্ষার সম্প্রসারণ, ব্যবসা-বাণিজ্যের সম্প্রসারণ কিংবা আধুনিক যোগাযোগের মোক্ষম হাতিয়ারই নয়, ব্যক্তিক এবং সামাজিক জীবনমান উন্নয়নের একএকটি শক্তিশালী প্রভাবকও। বৈশ্বিক কিংবা অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে ডিজিটাল কানেক্টিভিটির এ জমানায় সাক্ষরতা কিংবা মৌলিক সাক্ষরতা দক্ষতা- এসবের কোনোটাকেই বাদ দিয়ে জীবন নির্বাহ করা অসম্ভব প্রায়।

* শাওয়াল খান

সাহিত্যিক ও শিক্ষাকর্মী