
শিশুর পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটাতে সাহায্য করে সুস্থ বিনোদন। আর তাকে এই বিনোদনের সঠিক সুযোগ করে দিতে হবে। সুস্থ বিনোদন শিশুর মনকে উৎফুল্ল করে, আকুলতা বাড়ায়। মনের আনন্দ ছাড়া পৃথিবীর সবকিছু মিথ্যা। ঘরে-বাইরে, স্কুলে সবখানেই তাকে পরিপূর্ণ বিনোদনের সুযোগ সৃষ্টি করে দিতে হবে। একজন শিশু কত ভাবে খেলতে পারে। সে কিছু একটা ছুড়ে মারলো, তার অর্থ এই নয় যে, সে এটাকে অবজ্ঞা করছে। বরং শিশু জিনিসটা নিয়ে ভাবছে এটা কত দূর গেল, কীভাবে গেল। জন্মের পর থেকে শিশুদের শারীরিক বৃদ্ধি ও মানসিক বিকাশ ঘটতে থাকে। অন্যেদের সঙ্গে মিশে শিশু বুদ্ধি, আবেগ, জ্ঞান ও বিভিন্ন বিষয়ে দক্ষ হতে থাকে। শিশুর মানসিক বিকাশে সবারই সঙ্গদানের দায়িত্ব রয়েছে। আর শিশুর এই শারীরিক বৃদ্ধি ও মানসিক বিকাশের জন্য খেলাধুলা অপরিহার্য। নিত্যদিনের খেলাধুলা, দৌড়ঝাঁপ শিশুর হাড়, মাসল ও দেহের অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে শক্তিশালী করে। খেলাধুলা শিশুদের শরীরে দ্রুত রক্ত প্রবাহ সৃষ্টি করে। সংযমী ও দায়িত্ববোধ অর্জনে কাজ করে খেলাধুলা। কাজেই শিশুদের জন্য সুস্থ বিনোদনমাধ্যম ও খেলাধুলা অত্যন্ত জরুরি। তবে বাংলাদেশে কী শিশুদের জন্য পর্যাপ্ত সঠিক বিনোদনের সুযোগ আছে? অবসর সময় শিশুরা কীভাবে কাটাচ্ছে অবিভাবকরা কী তা খেয়াল করছে? সরকারের নীতিনির্ধারকেরা কী এ বিষয়ে ভাবে?
বাংলাদেশে, বিশেষ করে শহর অঞ্চলের শিশুদের জন্য যথোপযুক্ত খেলাধুলা ও বিনোদনের সুযোগ সীমিত। নগরায়ণের করাল গ্রাসে হারিয়ে যাচ্ছে শহরের মাঠ-ঘাট। আধুনিকতার ছোঁয়ায় পরিবর্তন এসেছে মানুষের নিত্যকার জীবনবোধে। নগরায়ণের প্রভাবে মানুষ প্রতিদিন বিসর্জন দিচ্ছে নিজেদের নির্মল আনন্দগুলো। বাস্তুবাদী দুনিয়ায় মানুষ যান্ত্রিক জীবনে অভ্যস্ত হচ্ছে দিন দিন। তারই ধারাবাহিকতায় নিষ্পাপ শিশু-কিশোরদের জীবনকেও সংকীর্ণ করেছি আমরা। ফলে আজকের শিশু-কিশোররা বঞ্চিত হচ্ছে উল্লাস আর হৃষ্টতা থেকে।
শহরের আবাসিক এলাকাগুলোতে কিছু মাঠ থাকলেও তা খুবই অপর্যাপ্ত। তবে বর্তমানে শহরগুলোতে বিভিন্ন ইলেকট্রনিক সরঞ্জাম নিয়ে খেলাধুলার জোন রয়েছে, যা সম্পূর্ণ ভার্চুয়াল। শিশুদের এসব প্লে জোনে ছেড়ে দিয়ে বাবা-মা থাকে নিজের মতো করে। শিশুরা এই ধরনের ভার্চুয়াল গেম থেকে কী শিখছে, এগুলা আদৌ তার মানসিক বিকাশে উপযোগী কি-না তার কোনো তোয়াক্কা করছে না অনেক মা-বাবাই। আধুনিকতার ছোঁয়ায় অনেক ধরনের খেলাধুলা লুপ্ত প্রায়। যে বয়সে শিশু কিশোদের ছোটাছুটি করার কথা খোলা প্রান্তরে, সাইক্লিং, সাঁতার কাটা, ঘুরাঘুরি, লাফালাফি, নিয়ে ব্যস্ত থাকার কথা; সে বয়সে তাদের সঙ্গ এখন মোবাইল, টিভি ও কম্পিউটার স্ক্রিন। আগে টিফিনের টাকা বাঁচিয়ে কিশোররা কিনত সাদা স্ট্যাম্প, লাল ট্যাপ, সাদা বল আর বড় সাইজের রঙিন ফুটবল। শখের বাঁশি কিনত আর ফু ফু করে বাজিয়ে বাড়ি মাতাত। এখন টাকা বাঁচায় ভিডিও গেমসের জন্য। মোবাইল আর ইন্টারনেরটের এই সহজলভ্যতা শিশুদের যে কতভাবে ক্ষতি করে তার ইয়ত্তা নেই। পিতা-মাতাদের অনীহা এই ব্যাপারে লক্ষণীয়। শিশুকে বিকল্প বিনোদনের ব্যবস্থা না করে দিয়ে বসিয়ে রাখে মোবাইল ইন্টারনেটের জগতে। ইন্টারনেটের এসব কার্যক্রম শিশুদের মস্তিষ্ককে বিকৃত করে দেয়। শারীরিক মানসিক সব ধরনের ক্ষতিসাধনে সক্ষম ইন্টারনেটের কার্যক্রমগুলো।
বাংলাদেশের শহরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মাঠগুলোও অনেকখানি সীমিত। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে উঠে আসা তথ্য থেকে জানা যায়, ঢাকার প্রায় ৯৫ ভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মাঠ নেই। অধিকাংশ প্রাইভেট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মাঠ থাকে না। খেলাধুলার জন্য যেমন মাঠ নেই, বিনোদনের জন্যও উপযোগী কোনো কার্যক্রম থাকে না। আছে শুধু একঘেয়েমি পড়া। শহরের স্কুলগুলোর একঘেয়ে পড়াশোনা ও অসুস্থ প্রতিযোগিতা শিশুদের সুস্থ বিনোদনের অন্তরায়। ফলে শিশু-কিশোররা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও উপযোগী খেলাধুলা ও বিনোদনের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এদিকে করোনা মহামারির দরুন এক বছরের বেশি সময় ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিশু-কিশোররা অনেকখানি বন্দি জীবন পার করছে। অবসর কাটাতে গুরুতরভাবে ঝুঁকে পড়ছে মোবাইল, কম্পিউটার গেমসের প্রতি।
পক্ষান্তরে তাদের মোবাইল, কম্পিউটার আসক্তি অদূর ভবিষ্যতে শারীরিক মানসিক নানান ধরনের ক্ষতিসাধন করতে পারে। অনেক পিতা-মাতা শিশুদের ইলেকট্রনিক সরঞ্জাম দিয়ে ঘরে বন্দি করে রাখে, যা মোটেও সমীচীন নয়। ভার্চুয়াল জগত শিশু-কিশোরদের সাময়িক আনন্দে রাখলেও তা পরে বিষাদে পরিণত হয়। বন্দি থাকার ফলে শিশুদের মানসিক বিকাশে বাধাগ্রস্ত হয়। খেলাধুলা বা ছোটাছুটি করতে না পারা শিশুরা পরবর্তীকালে নানা জটিলতায় ভোগে।
শিশুদের সুস্থ বিনোদনের অভাবের দায় সরকার ও তার নীতি নির্ধারকরদেরই। পাশাপাশি পিতা-মাতারও দায় রয়েছে। শিশু-কিশোরদের পড়াশোনার উন্নয়ন নিয়ে সরকারের উদ্বেগ থাকলেও তাদের সুস্থ বিনোদন নিয়ে কোনো মহলেই উদ্বেগ লক্ষ করা যায় না। শিশুদের প্রতি এই অবহেলা তাদের নিষ্পাপতাকে নষ্ট করে। তাদের জীবনে অশুভ আর অমঙ্গল ঢুকে পড়ে। আজকের শিশু আগামীর ভবিষ্যৎ। কাজেই ভবিষ্যৎকে রক্ষা করতে সরকার ও তার নীতি-নির্ধারকদের শিশুদের সুস্থ বিনোদনের পন্থা তৈরিতে মনোযোগী হতে হবে।
শিক্ষার্থী
ভাষাবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়