গাছ যে শুধু অক্সিজেন দেয় তা নয়, আমরা সবাই জানি প্রকৃতপক্ষে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন জলবায়ু পরিবর্তনসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় গাছ বিশেষ ভূমিকাও পালন করে থাকে। অথচ বিভিন্ন কারণে গাছের সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে, যদিও সরকার বৃক্ষরোপণ এর ওপর বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করেছে। গাছের সার্বিক অবদান মূল্যায়ন করে সবার উচিত বৃক্ষরোপণে উৎসাহিত হওয়া এবং অপরকে উৎসাহিত করা। মাটির ক্ষয় রোধ ঠেকাতে গাছ বিশেষ ভূমিকা রাখে। গাছ আমাদের জন্য যে বিশেষ ভূমিকা রাখে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য প্রধান একটি বিষয় হচ্ছে, গাছ অক্সিজেন ত্যাগ করে এবং কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করে। গাছের অভাবে অক্সিজেন যদি দিন দিন এভাবে কমতে থাকে তাহলে একসময় কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ অতিরিক্ত হারে বেড়ে যাবে, যা মানব জাতির জন্য খুবই ভয়াবহ বিষয়। মানবজীবনে ও পরিবেশ সংরক্ষণে বৃক্ষের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। বাংলাদেশের সুন্দরবন দীর্ঘদিন ধরেই সবার কাছে জনপ্রিয়তা অর্জন করে আসছে। এছাড়া মধুপুর ও ভাওয়ালেরগড়, সিলেট, চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামেও বনাঞ্চল রয়েছে। প্রাকৃতির ভারসাম্য রক্ষার জন্য দেশের আয়তনের এক-চতুর্থাংশ বনভূমি থাকা প্রয়োজন। কিন্তু বর্তমানে দেশে মাত্র ১৬.৪৬ শতাংশ বনভূমি রয়েছে, যা আমাদের দেশের পরিবেশ রক্ষায় একেবারেই অপর্যাপ্ত পরিমাণ হিসেবে বিবেচিত। প্রয়োজনীয় বৃক্ষের অভাবে দেশের কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ দিন দিন বেড়েই চলেছে। তাছাড়া আমাদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য অতি প্রয়োজনীয় অক্সিকেজন বৃক্ষ থেকেই পাওয়া যায়। ২০১৫ সালের প্যারিস জলবায়ু চুক্তি সম্পাদনের পর পাঁচ বছর চলছে। এরই মধ্যে বহু দেশ চুক্তির অনেক শর্ত বাস্তবায়ন করা শুরু করেছে। তবুও বায়ুম-লের উষ্ণতা হ্রাস পাচ্ছে না। দিন দিন বরং বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে নানা সংকট সৃষ্টি হচ্ছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদন মতে, বিশ্বে বায়ুদূষণের মাত্রা ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছেছে। বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ৯০ শতাংশই দূষিত বায়ু নিতে বাধ্য হয়। এ কারণে বছরে ৭০ লাখ মানুষ দূষণের শিকার হয়ে নানা রোগে মারা যায়।’ অপরদিকে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ায় অন্তত ৮০ কোটি মানুষ ক্ষতির মুখে পড়বে বলে এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে বিশ্ব ব্যাংক। ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য কয়েক দশকের মধ্যে অর্থনৈতিক ক্ষতি হতে পারে সবচেয়ে বেশি। নেমে যেতে পারে জীবনযাত্রার মানও। এই ক্ষতি ভারতে সব থেকে বেশি বলেও জানিয়েছে সংস্থাটি। বিশ্বব্যাংক প্রকাশিত ‘সাউথ এশিয়ান্স হট-স্পটস› শীর্ষক প্রতিবেদনে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকা এলাকাগুলোকে হটস্পট হিসেবে উল্লেখ করা হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০৫০ সাল নাগাদ দক্ষিণ এশিয়ার কয়েক কোটি মানুষ ঝুঁকির মুখে পড়বে। যার মধ্যে বাংলাদেশের রয়েছে ১৩ কোটি মানুষ। সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে ভারত। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রায় ৬০ কোটি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে প্রতিবেদনে উঠে আসে। বিশ্লেষকরা বলছেন, দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তর দেশ ভারতে জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত ক্ষতি প্রতিবেশী দেশগুলোকেও সমানভাবে ভোগাবে। তাই জীবন যাত্রার মান উন্নয়নে নজর দেওয়ার পাশাপাশি পরিবেশ রক্ষা নিয়েও ভাবা চাই। আমাদের দেশ পৃথিবীর অন্যতম প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ দেশ। এদেশে প্রতি বছরই অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, নদীভাঙন ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগ হানা দেয় এবং এতে দেশে ব্যাপক জানমালের ক্ষতি হয়। নদীভাঙন, জলোচ্ছ্বাস ও বন্যায় বহু মানুষ গৃহহীন ও সর্বস্বান্ত হয়ে রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন শহরে এসে মানবেতর জীবন যাপন করে। কাজেই এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে বাঁচতে হলে বনায়ন তথা বৃক্ষরোপণের কোনো বিকল্প নেই।
দেশে যত বেশি গাছ-বৃক্ষ থাকবে, আবহাওয়া তত বেশি শীতল থাকবে এবং অধিক পরিমাণে বৃষ্টিপাত হবে। যে দেশে তালগাছ, নারিকেল গাছ ও সুপারি গাছ বেশি থাকবে, সে দেশের মানুষ বজ্রপাত থেকে রক্ষা পাবে। কারণ উঁচু গাছ মানুষকে বজ্রপাত থেকে রক্ষা করে। বিশ্বের অনেক দেশে বর্তমানে বজ্রপাত থেকে বাঁচার জন্য উঁচু গাছ লাগানো হচ্ছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় একদিকে লাগানো হচ্ছে, আবার অন্যদিকে কেটে ফেলা হচ্ছে। অথচ আমাদের দেশ ও জাতির স্বার্থে দেশে শতকরা ২৫ ভাগ বনভূমি সৃষ্টি করার উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। এ ব্যাপারে সরকারের আরও তৎপর হওয়া উচিত। সরকারি উদ্যোগে খাস জমি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং সরকারি-বেসরকারি অফিস আদালতের আঙিনায় বেশি করে গাছ লাগাতে হবে। আমরা সবাই নিজেদের বাড়ির আঙিনায় এবং খোলা জায়গায় অধিক পরিমাণে গাছ লাগাব। আমরা আমাদের দেশে সবুজ বেষ্টনী গড়ে তুলব। তাহলে আমরা প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে অনেকটা রক্ষা পাব। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বার্থে অবশ্যই এ কাজটি আমাদের করতে হবে। পৃথিবীকে পরিবেশ বিপর্যয় থেকে রক্ষা করতে হলে বেশি করে গাছ লাগাতে হবে এবং দেশে দেশে সবুজ বেষ্টনী গড়ে তুলতে হবে। নতুবা পৃথিবী উত্তপ্ত হয়ে মানুষ এবং প্রাণিজগতের বসবাসের অনুপযোগী হয়ে যাবে। তাই পরিবেশ বিজ্ঞানীরা বিশ্ববাসীকে দেশে দেশে সবুজ বেষ্টনী গড়ে তোলার জন্য আহ্বান জানাচ্ছেন। কাজেই বর্তমানে বিশ্বের প্রতিটি দেশে বনায়ন কর্মসূচি জোরদার করা হচ্ছে এবং বেশি করে বৃক্ষরোপণ করা হচ্ছে। এক সময় এই পৃথিবীতে প্রচুর বনজঙ্গল ছিল, কিন্তু মানুষ নিজেদের প্রয়োজনে অর্থাৎ জনবসতি গড়ে তোলার জন্য এবং চাষাবাদ করার জন্য গাছ-বৃক্ষ কেটে বনভূমিকে উজাড় করেছিল। যার ফলে পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেতে লাগল এবং নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ বিশ্ববাসীকে ভোগাতে লাগল।
বর্তমানে সারা বিশ্বের ক্রমবর্ধমান প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন বন্যা, খরা, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, নদীভাঙন ইত্যাদি অবশ্যই বিশ্বের পরিবেশ বিপর্যয়ের ফল। কাজেই পরিবেশকে বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করতে হলে এবং পরিবেশের ভারসাম্য ফিরিয়ে আনতে হলে বিশ্বের প্রতিটি দেশে অধিক হারে গাছ লাগাতে হবে। তাহলে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করা যাবে। মনে রাখতে হবে গাছ মানুষের পরম বন্ধু। মানব জীবনে গাছের প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য। গাছ মানুষের উপকার ছাড়া কোনো ক্ষতি করে না। গাছের বহুমুখী উপকারিতা রয়েছে, যা বর্ণনা করে শেষ করা যাবে না। আমাদের বেঁচে থাকার জন্য যে অক্সিজেনের প্রয়োজন, আমরা গাছ থেকে সেই অক্সিজেন পাই। গাছ ক্ষতিকর কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করে এবং উপকারী অক্সিজেন পরিত্যাগ করে। গাছ পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখে এবং পরিবেশকে শীতল রাখে। যে দেশে গাছপালা বেশি, সেদেশে বৃষ্টিপাত বেশি হয়। পক্ষান্তরে যে দেশে গাছপালা কম সে দেশে বৃষ্টিপাত কম হয়। কাজেই আমাদের পরিবেশ ঠিক রাখার জন্য গাছের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। গাছের আর্থিক উপকারিতাও অপরিসীম। গাছ থেকে আমরা নানা প্রকার ফলমূল পাই, যাতে প্রচুর ভিটামিন রয়েছে। এই ফল আমরা খাই এবং বিক্রি করেও টাকা-পয়সা অর্জন করে থাকি। গাছের কাঠ দ্বারা প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র এবং ঘরবাড়ি তৈরি করা হয়। গাছের ডাল-পালা এবং কাঠ জ্বালানি হিসাবেও ব্যবহার করা হয়। গাছ বিক্রি করে প্রচুর টাকা লাভ করা যায়। একটি গাছ বড় হলে ১৫ থেকে ২০ হাজার, এমনকি লাখ টাকায়ও বিক্রি হয়। প্রতিটি দেশের মোট আয়তনের শতকরা ২৫ ভাগ বনভূমি থাকা প্রয়োজন। কিন্তু আমাদের দেশসহ বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই শতকরা ২৫ ভাগ বনভূমি নেই। যার ফলে, এসব দেশে ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগ নেমে আসে।
আমাদের দেশে এমনিতেই বনভূমি কম। তারপরও আমাদের দেশের কিছুসংখ্যক দুষ্কৃতকারী গাছপালা কেটে বনভূমিকে উজাড় করে। দুষ্কৃতকারীরা বন বিভাগের দুর্নীতিবাজ কর্মচারীদের সঙ্গে যোগসাজশে বনভূমি ধ্বংস করে দেশের সর্বনাশ করছে। তারা বনরক্ষীদের সহযোগিতায় গাছ কেটে রাতের আঁধারে বাইরে পাচার করছে। বন বিভাগের অসাধু কর্মচারীরা ঘুষের বিনিময়ে দুষ্কৃতকারীদের বনভূমি ধ্বংস করতে সহায়তা করছে। তারা রক্ষক হয়ে ভক্ষকের ভূমিকা পালন করছে। কাজেই বন বিভাগের দুর্নীতিবাজ কর্মচারী এবং দুষ্কৃতকারীদের কঠোর শাস্তি দিয়ে দেশের বনাঞ্চলকে রক্ষা করতে হবে। নতুবা দেশের বনভূমি উজাড় হয়ে যাবে, যা দেশের জন্য মহাবিপদ ডেকে আনবে। বনখেকো গনীর দুর্নীতির কথা আমরা শুনেছি, সে দেশের বনভূমি উজাড় করতে দুষ্কৃতকারীদের সহায়তা করেছিল। এভাবে আরও বহু গনী সৃষ্টি হচ্ছে, যারা দেশের সর্বনাশ করছে। কাজেই এদের ছাড় দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। বৃক্ষরোপণের আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে কর্মসংস্থান। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধির কারণে কর্মসংস্থান ক্রমান্বয়ে সংকোচিত হয়ে আসছে বিশ্বময়। ফলে নতুন এক মহাসংকট সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে সারা দুনিয়ায়। এই অবস্থায় বৃক্ষ রোপণ বিকল্প কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে নিঃসন্দেহে। বৃক্ষ রোপণ, এর পরিচর্যা এবং এর ব্যবহার ইত্যাদি কর্মকা-ে কোটি কোটি মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। তাই সমগ্র বিশ্বে সমস্বরে আওয়াজ তোলা আবশ্যক গাছ লাগান, পরিবেশ বাঁচান এবং তা করতে হবে পরিকল্পিতভাবে। সর্বোপরি বাংলাদেশসহ সব দেশের বনাঞ্চল দখল রোধ, দখলি স্থান উদ্ধার এবং বনাঞ্চলে প্রয়োজনীয় বৃক্ষরোপণ ও বৃক্ষনিধন বন্ধ করার জন্য কঠোর পন্থা গ্রহণ করা আবশ্যক।