মাটি বা মৃত্তিকা হলো পৃথিবীর উপরিভাগের নরম আবরণ, যা পরিবেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। বর্তমানে এই মহামূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদ নানাভাবে দূষিত হচ্ছে। মাটির ওপরের স্তরের উৎকর্ষ মানের ওপর মাটির উর্বরতা ও উৎপাদনশীলতা নির্ভর করে। কিন্তু মানুষ সৃষ্ট বিভিন্ন দূষণের ফলে মাটির ওপরের স্তরের পুষ্টি পদার্থগুলো অপসারিত হচ্ছে, মাটিতে বসবাসকারী বিভিন্ন অণুজীবের দৈনন্দিন ক্রিয়া-কলাপে ব্যাঘাত ঘটছে এবং মাটিতে বাইরের বিভিন্ন জৈব ও অজৈব উপাদানের সংযোজন ঘটছে। যার ফলে মাটির উর্বরতা ও উৎপাদনশীলতা দিন দিন নষ্ট হচ্ছে। অর্থাৎ প্রতিনিয়ত মাটি দূষিত হচ্ছে। মাটি দূষণ প্রতিরোধ ও প্রতিকারে নানা ধরনের প্রযুক্তি ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে জৈবপ্রযুক্তি (বায়োটেকনোলজি) ব্যবহার করতে পারলে মাটির উর্বরতা এবং উৎপাদনশীলতা দুটোই বৃদ্ধি পাবে তথা মাটির গুণাগুণ বজায় থাকবে।
যে প্রযুক্তির সাহায্যে কোনো জীবকোষ, অণুজীব বা তার অংশবিশেষ ব্যবহার করে নতুন কোনো বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন জীবের উদ্ভাবন বা উক্ত জীব থেকে প্রক্রিয়াজাত বা উপজাত দ্রব্য প্রস্তুত করা যায়, সে প্রযুক্তিকে জৈব প্রযুক্তি বলে। অর্থাৎ জৈব প্রযুক্তি হলো মানুষের পক্ষে কার্যকারী উৎপাদনের জন্য সজীব জীবজগতের ব্যবহার। জীববিজ্ঞান, রসায়ন বিজ্ঞান ও কারিগরি বিজ্ঞানের সুসংহত ব্যবহারে গড়ে উঠেছে এই বিষয়টি। বিশেষ করে এই প্রযুক্তি কৃষি, খাদ্য বিজ্ঞান এবং ওষুধ শিল্পে ব্যবহৃত হয়। মাটি দূষণ নিরসনেও জৈব প্রযুক্তির বিভিন্ন প্রয়োগ মাটিকে করবে দূষণমুক্ত। মাটির দূষিত পদার্থগুলো দূরীকরণে জৈব প্রযুক্তির বিভিন্ন প্রয়োগ মাটিকে করে তুলবে দূষণমুক্ত। মাটি দূষণ নিরসনে বিভিন্ন জৈবিক প্রযুক্তি যেমন বায়োরিমেডিয়েশন, ফাইটোরিমেডিয়েশন ইত্যাদির প্রয়োগ করা যেতে পারে। যা খুব একটা কঠিন বিষয় নয় এবং তুলনামূলক কম খরচেই করা যায়। এটি বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল দেশে অত্যন্ত ফলপ্রসূ পদ্ধতি হতে পারে।
মাটি দূষণ বলতে মানুষের ক্রিয়াকলাপের ফলে মাটিদূষণ, মাটি ক্ষয়, মরু বিস্তার, মাটির লবণাক্তকরণ প্রভৃতি পরিবেশের সার্বিক গুণমান হ্রাসকে বোঝায়। মাটিতে দূষণ সৃষ্টিকারী বিভিন্ন সজীব ও অজীব উপাদান রয়েছে। বিভিন্ন রোগ সৃষ্টিকারী ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, প্রোটোজোয়া, কৃমি প্রভৃতি সজীব উপাদান এবং সালফেট, ফসফেট, ভারী ধাতু, লবণ, এসিড ইত্যাদি অজীব উপাদান। এছাড়া ক্লোরিন, কীটনাশক, প্লাস্টিক, পলিথিন ইত্যাদি জৈব দূষক রয়েছে। আধুনিক কৃষির অন্যতম উপাদান হলো রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার। বর্তমানে এর অতিরিক্ত ব্যবহার মাটি দূষণের অন্যতম কারণ। শহর ও শিল্প-কারখানার দূষিত বর্জ্যরে সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাবে এরা মাটির সঙ্গে মিশে প্রতিনিয়ত মাটির দূষণ ঘটাচ্ছে। বৃষ্টির পানি থেকে আগত কার্বন ডাই-অক্সাইড, সালফার ডাই-অক্সাইড প্রভৃতি মাটিতে মিশ্রিত হয়ে মাটির এসিড দূষণ ঘটায়। তাছাড়া তেজস্ক্রিয় বর্জ্য পদার্থগুলো মাটিতে পুঁতে ফেলা; সিসা, দস্তা, ক্যাডমিয়াম প্রভৃতি বিষাক্ত ধাতু মাটিতে অপসারণ করা; পলিথিন জাতীয় দ্রব্য মাটিতে পুতে ফেলা; খনিজ তেলের মিশ্রণসহ আরও অনেক কারণে মাটির দূষিত হচ্ছে। যার ফলে দিন দিন মাটি ব্যবহারের অনুপযুক্ত হয়ে যাচ্ছে। মাটির এসব দূষণ রোধ করার জন্য তেমন কোনো পদ্ধতি ব্যবহার করা হচ্ছে না। জৈবপ্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে মাটির এসব দূষণ রোধ করা যায় এবং মাটিকে পুনরায় ব্যবহার উপযোগী করে তোলা যায়।
দূষিত মাাটিকে জীবাণুমুক্ত করার প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে ইন-সিটু প্রক্রিয়া অর্থাৎ যে স্থানের মাটি দূষিত হয়, সে স্থানেই দূষণমুক্ত করা এবং অফসাইট প্রক্রিয়া বা মাটিকে স্থানান্তরিত করে তারপর দূষণমুক্ত করা। দূষিত মাটি জীবাণুমুক্ত করার জন্য সবচেয়ে প্রচলিত পদ্ধতি হলো মাটি অপসারণ করা এবং ল্যান্ডফিলিং, যা শুধু দূষিত মাটিকে একটি নির্দিষ্ট স্থানে সীমাবদ্ধ করে; কিন্তু জীবাণুমুক্ত করার জন্য কিছুই করে না। কাজেই এ পদ্ধতিতে মাটিকে দূষণমুক্ত করাটা যথাযথ নয়। কিছু উল্লেখযোগ্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে অনিয়ন্ত্রিতভাবে ক্রমবর্ধমান মাটি দূষণের সীমা নির্ধারণের জন্য প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি। নিয়ন্ত্রিত পরিবেশগত অবস্থার অধীনে ক্ষতিকারক বিষাক্ত বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য জৈব প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনগুলো পরিবেশগত আইনের পাশাপাশি জনসাধারণের গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি করবে কারণ এগুলো মাটি দূষণ হ্রাসের কার্যকর মাধ্যম। সম্প্রতি এই প্রক্রিয়াটি এমনভাবে পুনর্গঠিত হয়েছে, যাতে এটি অত্যন্ত কার্যকরীভাবে মাটি দূষণকে স্থির করতে পারে এবং পরবর্তী সময়ে তা নিরাময় করে মাটিকে দূষণমুক্ত ও ব্যবহার উপযোগী করে তোলে।
মাটির প্লাস্টিক দূষণ বর্তমানে একটি বড় সমস্যা। এ সমস্যা সমাধানেও জৈব প্রযুক্তি ব্যবহার করা যায়। সিউডোমোনাস গ্রুপের কিছু ব্যাকটেরিয়া প্লাস্টিক জাতীয় বর্জ্যকে ধ্বংস করতে পারে। এ জাতীয় অণুজীবগুলোকে ব্যবহার করে মাটির প্লাস্টিক দূষণ রোধ করা যায়। অন্যথায় প্লাস্টিক হাজার বছর ধরে মাটির নিচে চাপা থাকবে। যার ফলে মাটির নিচে প্লাস্টিকের স্তর সৃষ্টি হবে; জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের কারণ হয়ে দাঁড়াবে। ফাইটোরিমেডিয়েশনের মাধ্যমে মাটির দূষিত পদার্থ দূর করা যায়। মাটির দূষিত পদার্থ দূরীকরণে উদ্ভিদ ব্যবহৃত হলে তাকে ফাইটোরিমেডিয়েশন বলে। এ প্রক্রিয়ায় কিছু উদ্ভিদ মাটির দূষিত পদার্থগুলোকে আহরণ করে। বিভিন্ন দূষিত রাসায়নিক পদার্থ, ভারী ধাতু ইত্যাদিকে মাটি থেকে অপসারিত করে, যার ফলশ্রুতিতে মাটি হয়ে ওঠে দূষণমুক্ত ও উর্বর।
মাটি দূষণ রোধ করার জন্য একটি বায়োলজিক্যাল টুল হচ্ছে বায়োরিমেডিয়েশন। বায়োরিমেডিয়েশনকে বর্তমানে বায়োটেকনোলজির এক বিশেষ প্রয়োগ হিসেবে বিবেচনা করা হয়, যা পরিবেশ সুরক্ষায় অত্যন্ত কার্যকরী সমাধান। এই প্রযুক্তিতে প্রাকৃতিকভাবে বায়ু, পানি এবং মাটি দূষণকারী বস্তুকে অপসারণের জন্য অণুজীব ব্যবহার করা হয়। অর্থাৎ, বায়োরিমেডিয়েশন হচ্ছে একটি প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া যা ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক এবং উদ্ভিদের ওপর নির্ভর করে বিভিন্ন দূষিত পদার্থ পরিবর্তন করে মাটি, পানি বা বায়ুকে দূষণমুক্ত করে। বায়োরিমেডিয়েশনের সময় অণুজীবগুলো মাটির রাসায়নিক দূষককে শক্তির উৎস হিসেবে ব্যবহার করে এবং জারণ-বিজারণ বিক্রিয়ার মাধ্যমে মাটির দূষককে অণুজীবের ব্যবহারযোগ্য শক্তিতে পরিণত করে। যার ফলে পরিবেশে ফিরে আসা বাই প্রোডাক্ট সাধারণত প্যারেন্ট দূষণকারীর চেয়ে কম বিষাক্ত আকারে থাকে। বায়োরিমেডিয়েশন এর জন্য তিনটি প্রাথমিক উপাদান হলো : ১. দূষক এর উপস্থিতি, ২. একটি ইলেকট্রন গ্রহণকারী এবং ৩. অণুজীবের উপস্থিতি যা নির্দিষ্ট দূষণকারীকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে সক্ষম। বায়োরিমেডিয়েশন বা ফাইটোরিমেডিয়েশন মাটির বিভিন্ন জৈবিক উপাদান এবং সবুজ উদ্ভিদ ব্যবহার করে দূষিত মাটির দূষণ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। এই প্রযুক্তি নির্দিষ্ট মাইক্রোফ্লায়া বা মাইক্রোবিয়াল কনসোর্টিয়াম বৃদ্ধির দিকে মনোনিবেশ করে যা দূষিত মাটির কাক্সিক্ষত ক্রিয়াকলাপ সম্পাদনে সক্ষম। এটি মাটির তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রণ করে, কার্যকর টার্মিনাল ইলেকট্রন যোগ করে এবং পুষ্টি উপাদান যোগ করে। এভাবে বায়োরিমেডিয়েশনের মাধ্যমে ক্ষতিকারক জৈব দূষণকারীদের দ্রুত মাটিতে পরিবেশগতভাবে এবং অত্যন্ত নিরাপদ উপায়ে হ্রাস করার জন্য অণুজীবকে উদ্দীপিত করা হয়। এই প্রক্রিয়ায় জড়িত অণুজীবগুলো জৈব যৌগের বিপাকের মাধ্যমে শক্তি এবং কার্বন গ্রহণ করে। বায়োরিমেডিয়েশন এর মাধ্যমে বিপজ্জনক দূষকগুলোকেও কম বিপজ্জনক রাসায়নিক পদার্থে রূপান্তরিত করা যায়, যেখানে বায়োডিগ্রেডেশন এবং বায়োট্রান্সফরমেশন জড়িত।
বায়োরিমেডিয়েশন এবং ফাইটোরিমেডিয়েশন প্রযুক্তিগুলো সাধারণত ব্যবহৃত হয় পরিবেশগত বায়েটেকনোলজির অধীনে। এ প্রযুক্তিগুলো সুন্দরভাবে ব্যবস্থাপনার পদ্ধতিসহ পরিষ্কার করার প্রযুক্তির সঙ্গে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, যা প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহার করে দূষিত ও বিষাক্ত পরিবেশকে নিরাপদ ও পরিষ্কার অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে পারে। বর্তমানে এ প্রযুক্তিগুলোর প্রয়োগ ক্রমবর্ধমান দূষিত এলাকা দূষণমুক্ত করার জন্য আরও পরিবেশবান্ধব হয়েছে এবং ব্যয় কমানোর দিকে পরিচালিত হচ্ছে।
বিজ্ঞানের নানা অবদানের দরুন আমাদের দৈনন্দিন সব সমস্যার সমাধান নিমিষেই খুঁজে পাচ্ছি। মাটি দূষণ বর্তমানে উল্লেখযোগ্য একটি সমস্যা যার প্রতিকার এবং প্রতিরোধ অত্যন্ত জরুরি।
জীববিজ্ঞানের ওপর ভিত্তি করে নির্মিত প্রযুক্তিগুলো ব্যবহার করে সহজেই মাটি দূষণ সমস্যার সমাধান করা যায়। এক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয় অণুজীব, এনজাইম, ব্যাকটেরিয়া, উদ্ভিদ ইত্যাদি। অভিনব কৌশলের মাধ্যমে পরিবেশের এ উপাদানগুলোকে কাজে লাগিয়ে মাটি দূষণ নিরসন করা যায়। যদিও সাধারণ মানুষের জৈবপ্রযুক্তি সম্পর্কে পরিপূর্ণ ধারণা নেই সেক্ষেত্রে আমরা বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের সহায়তায় তাদের এ সম্পর্কে পূর্ণ ধারণা দিতে পারি। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে মাটি দূষণ নিরসনে জৈবপ্রযুক্তির বিশদ ব্যবহার সবচেয়ে কার্যকর, অর্থনৈতিক এবং পরিবেশবান্ধব হাতিয়ার।