ঢাকা শুক্রবার, ২৭ জুন ২০২৫, ১৩ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

গুজবের কারণ ও প্রতিরোধ ব্যবস্থা

গুজবের কারণ ও প্রতিরোধ ব্যবস্থা

গুজবের আভিধানিক অর্থ ‘জনরব’ বা ‘ভিত্তিহীন প্রচার’। ইংরেজিতে বলা হয় ‘রিউমার’। এ ভিত্তিহীন প্রচার এতই শক্তিশালী, যা যে কোনো সময় যে কোনো দেশে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ বা রাষ্ট্রের জন্য মারাত্মক বিপর্যয় ডেকে আনে। ইতিহাসে এর অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে। সেই প্রাচীনকাল থেকে আজ অবধি গুজব দাপটের সঙ্গেই প্রচলিত রয়েছে। সময়ের বিবর্তনে গুজব ছড়ানোর ধরন পাল্টেছে; কিন্তু এর পরিসমাপ্তি হয়নি। গুজব বা ভিত্তিহীন প্রচার নিয়ে সমাজবিজ্ঞানী ও মনোবিজ্ঞানীরা অনেক গবেষণা করেছেন। এসব গবেষণা থেকে গুজব সংক্রান্ত অনেক অজানা তথ্য আমরা জানতে পারি।

বিভিন্ন গোষ্ঠীতে বিভক্ত হয়ে সমাজবদ্ধ বসবাস মানুষের স্বাভাবিক ধর্ম। গোষ্ঠীবদ্ধ ও সমাজবদ্ধ হতে মানুষকে সামাজিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে হয়। সামাজিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে মানুষের পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে। এই মিথস্ক্রিয়া সংগঠিত হয় সাংকেতিক চিহ্ন, প্রতীক ও ভাষার মাধ্যমে। একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগের ক্ষেত্রে ও কোনো বিষয়ে অভিন্ন মত গড়ে তুলতে, নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করতে ও সে অনুযায়ী সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ঘটনাবলি নিজেদের অনুকূলে নিতে মানুষের অব্যাহত প্রয়াস বা মিথস্ক্রিয়া সবসময়ই লক্ষ্যণীয়। সমাজবদ্ধ মানুষের স্বার্থ রক্ষার এ প্রয়াস কখনও কোনো গোষ্ঠীর অনুকূল এবং অন্য গোষ্ঠীর প্রতিকূলে যায়। ফলে ব্যক্তিতে-ব্যক্তিতে, গোষ্ঠীতে-গোষ্ঠীতে, সমাজে ও রাষ্ট্রে দ্বন্দ্বের উৎপত্তি হয়। এ দ্বন্দ্বের ফলে ও নিজেদের স্বার্থ রক্ষার্থে এক গোষ্ঠী অন্য গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বিভ্রান্তিমূলক তথ্য ছড়িয়ে তাদের পক্ষে জনমত গঠন করে স্বার্থ রক্ষায় লিপ্ত হয়। এ ধারা বহু পুরোনো এবং এখনও বর্তমান। পৃথিবীর সবদেশেই, সবকালেই এটা লক্ষণীয়।

বিদেশে গুজবসংক্রান্ত একাডেমিক গবেষণা রয়েছে। অনেক বই লেখা হয়েছে। বাংলাদেশে এই ধরনের গবেষণা ও বইয়ের সংখ্যা খুবই কম। ১৯৪৪ সালে প্রকাশিত রবার্ট এইচ নাপ ‘এ সাইকোলজি অব রিউমার’ প্রবন্ধে গুজবকে কেন ছড়ানো হয় অথবা গুজব ছড়ানোর উদ্দেশ্য কী তা ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তিনি ভ্রান্ত আবেগ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ছড়ানো গুজবকে ৩টি ভাগে ভাগ করেছেন। যেমন-১. পাইপ ড্রিম রিউমার : এটি মূলত ছড়ানো হয় ভালো কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে। এ শ্রেণির গুজবে গুজব ছড়ানো ব্যক্তিটি চান গুজবটি যেন সত্য হয়। কারণ এ ধরনের গুজব ছড়ানোর পেছনে থাকে ভালো কোনো উদ্দেশ্য। ২. ভগি বা ফিয়ার রিউমার : এটি সাধারণত ছড়ানো হয় সমাজে আতঙ্ক ছড়ানোর উদ্দেশ্যে; ৩. ওয়েজ ড্রাইভিং এগ্রেশন রিউমার : মূলত এ ধরনের গুজব ছড়ানো হয় প্রতিপক্ষকে ধ্বংস করার উদ্দেশ্য নিয়ে। গুজবের প্রাথমিক কাজ হলো এমন একটা বিষয় যা নিয়ে মানুষের পরিষ্কার ধারণা নেই; কিন্তু আগ্রহ আছে। গুজবে এ ধরনের তথ্যই বেছে নেওয়া হয়, যেখানে মানুষকে বিভ্রান্ত করার সুযোগ রয়েছে।

গর্ডন অলপোর্ট এবং লিও পোস্টম্যান ১৯৪৭ সালে প্রকাশিত ‘দ্য সাইকোলজি অব রিউমার’ গ্রন্থে গুজব ছড়ানোর মনস্তাত্ত্বিক কারণগুলো বর্ণনা করেছেন। এক. অনিশ্চিত পরিস্থিতি : পরিস্থিতি যখন অনিশ্চিত তখন মানুষ গুজব ছড়ায় বা গুজব ছড়ানোর সম্ভাবনা বেড়ে যায়। দুই. উদ্বেগ : মানুষ যখন উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে থাকে, তখনও গুজব ছড়ায় বা গুজবকে গ্রহণ করে। উদ্বেগের সঙ্গে অনিশ্চয়তার গভীর সম্পর্ক রয়েছে। বেশ কিছু গবেষণায় দেখা গেছে যেসব মানুষের মধ্যে বেশি উদ্বেগ কাজ করে তারাই বেশি গুজব ছড়ায়। গবেষণায় এটাও দেখা গেছে যে, খারাপ কোনো ঘটনার গুজব ভালো কোনো ঘটনার গুজবের চেয়ে দ্রুত ছড়ায়। তিন. তথ্যের গুরুত্ব : গুরুত্বপূর্ণ তথ্য, অর্থাৎ রটনাকারী যখন জানে যে এ বিষয়ে তথ্যগুলো মানুষ জানতে চায় অর্থাৎ তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ, তখনই তা ছড়ায়। আর যারা গুজব ছড়ায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তারা সেটা বিশ্বাস করে বলে মনে করেন মনোবিজ্ঞানীরা। চার. অস্পষ্টতা : কোনো বিষয় বা তথ্য সম্পর্কে মানুষের স্পষ্ট ধারণা না থাকলে মানুষ গুজবে কান দেয়। পাঁচ. নিজের ভাবমূর্তি রক্ষা : মানুষ তাদের ভাবমূর্তির সঙ্গে যায়, এমন তথ্যে বিশ্বাস করে এবং সেই গুজবকে সত্য বলে ধরে নেয়। ছয়. ভালো লাগা : অনেক গবেষণায় দেখা গেছে, মানুষ নিজেদের ব্যাপারে ভালো অনুভব করতে চায় এবং সেই জায়গা থেকে গুজব রটায়। সাত. প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে : গবেষকরা বলছেন, অন্যকে নিচু করতেও গুজব রটানো হয়। আট. দৃঢ় সামাজিক অবস্থান : সামাজিক অবস্থানকে শক্ত করতেও অনেকে গুজবের আশ্রয় নেয় বলে জানিয়েছেন গবেষকরা।

তবে গুজবের প্রকারভেদে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ তা বিভিন্নভাবে গ্রহণ করে। অর্থাৎ ব্যক্তিমানসিকতা এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কে বা কারা গুজব ছড়াচ্ছে তার বা তাদের ব্যক্তিত্ব, সামাজিক অবস্থানের ওপর গুজবের বিশ্বাসযোগ্যতা নির্ভর করে। গবেষণার ফলাফল বলছে, কিছু কিছু গুজব নির্দিষ্ট কিছু দলের মানুষের মাধ্যমে দ্রুত ছড়ায়, কারণ তারা হয়তো কোনো একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দল, ধর্ম, মতামতের ওপর বিশ্বাস করে এবং ওই সংক্রান্ত যেকোনো গুজবকে বিশ্বাস করে। মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, একটি নির্দিষ্ট গুজব তখনই দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে, যখন মানুষের মানসিকতা ও দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে তা মিলে যায়। এ কারণে একই গুজব গ্রামাঞ্চলে যতটা দ্রুত ছড়ায় শহরে হয়তো ততোটা ছড়ায় না। তারা আরও বলেন, অনগ্রসর সমাজ ও রাষ্ট্রে গুজব বেশি ছড়ায়। কারণ এসব সমাজে জনসাধারণের শিক্ষার হার কম এবং সঠিক তথ্য প্রাপ্তিরও ঘাটতি রয়েছে। সুতরাং সংবেদনশীল কোনো বিষয়ে গুজব ছড়ানো এসব সমাজে সহজ হয়।

যে সমাজে আবেগ ও বিশ্বাসপ্রবণতা বেশি; গুজব বা জনরব সে সমাজে বেশি ছড়াই। বাংলাদেশের মানুষ প্রচণ্ড আবেগ ও বিশ্বাসপ্রবণ। শোনা কথা ও ধারণাপ্রসূত কথা শোনা ও বলায় তাদের আগ্রহ অনেক বেশি। আর এ অতি আগ্রহের কারণে গুজব ছড়ানো অনেক সহজ হয়। বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী মহল বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বিষয়ে গুজব ছড়িয়ে তাদের স্বার্থ উদ্ধার করতে চায়। বাংলাদেশে ছড়ানো এ ধরনের গুজবের সংখ্যা নেহায়েতই কম নয়। গুজবের ফলে সহিংসতা ও হতাহতের ঘটনা প্রায় সংঘটিত হয়। গুজব ছড়ানোর মাধ্যমেরও পরিবর্তন হয়েছে। আগে মানুষ মুখে মুখে গুজব ছড়াত। এখন বিভিন্ন ইলেকট্রনিক মাধ্যমে গুজব ছড়ানো হয়। গুজব ছড়ানোর সবচেয়ে জনপ্রিয় মাধ্যম এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। বিশেষ করে ফেইসবুক গুজব ছড়ানোর অন্যতম প্লাটফরম হয়ে উঠেছে।

গুজব প্রতিরোধে বিশেষজ্ঞরা স্বাধীন গণমাধ্যমের বিকাশ এবং গণমাধ্যমের ওপর মানুষের আস্থা তৈরির পরামর্শ দেন। এছাড়া কিছু প্রযুক্তিগত পদক্ষেপ নেওয়া যেমন প্রথমত, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের যতগুলো অ্যাপস আছে-যেমন, ফেইসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, মেসেঞ্জার, ইউটিউব, ইনবক্স মেসেজ যা থেকে প্রায়ই গুজব ছড়ানো হয় তা বন্ধ করা। দ্বিতীয়ত, গুজব বা ফেক নিউজ চিহ্নিত করার অ্যাপস সহজলভ্য করা। এখন ফেক নিউজ চিহ্নিত করার জন্য অনেক অ্যাপস তৈরি হয়েছে, যেগুলো স্মার্টফোন বা কম্পিউটারে ইনস্টল করা গেলে গুজব ছড়ানো রোধ করা সম্ভব বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। তৃতীয়ত, সচেতনতা বৃদ্ধি অর্থাৎ কোনটি গুজব আর কোন ধরনের পোস্ট শেয়ার করা যাবে না-এ বিষয়ে মানুষকে সচেতন করা। চতুর্থত, সব শ্রেণির পাঠ্যবইয়ে গুজব সম্পর্কিত পাঠ্যসূচি অন্তর্ভুক্ত করলে আগে থেকেই ছাত্রছাত্রীরা সচেতন হবে এবং গুজব ছড়ানো প্রতিরোধ করা সম্ভব বলেও অনেকে মনে করেন।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত