ঢাকা মঙ্গলবার, ২৪ জুন ২০২৫, ১০ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

বেকারত্ব ও আমাদের যুবসমাজ

বেকারত্ব ও আমাদের যুবসমাজ

১৯৭১ সালে ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর বাংলাদেশের জন্ম হয়। মুক্তিযুদ্ধে সর্বস্তরের লোকজন অংশগ্রহণ করে। বাংলাদেশের যুবসমাজ এক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। যেকোনো দেশের অধিকার আদায়, যেকোনো আন্দোলনে, দেশের উন্নয়নে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখে যুবসমাজ। কিন্তু আমাদের যুবসমাজের বিরাট একটা অংশ বেকার। বেসরকারি সংস্থার তথ্যমতে বাংলাদেশে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর এক-তৃতীয়াংশ বেকার। দিন দিন বেকারত্বের সমস্যা বাংলাদেশে মহামারির মতো বৃদ্ধি পাচ্ছে।

বেকারত্বের অন্যতম কারণগুলো যদি আমরা বিশ্লেষণ করি তাহলে দেখতে পাই চাকরির বাজারের চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে বড় ধরনের সমন্বয়হীনতা রয়েছে। চাকরির বাজারে যে চাহিদা রয়েছে, সে রকম লোক আমরা তৈরি করতে পারছি না। আবার প্রতি বছর যেসব শিক্ষিত লোক চাকরির বাজারে যুক্ত হচ্ছেন, তাদের উপযোগী চাকরি নেই। গত কয়েক বছরে দেশে স্নাতক পাস শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। কারণ, দেশে প্রতিনিয়ত সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বাড়ছে। কয়েক বছর আগেও বছরে দুই থেকে আড়াই লাখ শিক্ষার্থী স্নাতক বা স্নাতকোত্তর পাস করে চাকরির বাজারে যুক্ত হতেন। এখন সে সংখ্যা মাত্রাতিরিক্ত হারে বেড়ে গেছে। আমাদের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে বেশির ভাগ শিক্ষিত চাকরিপ্রার্থী শহরে সম্মানজনক চাকরি করতে চান। কিন্তু শহরে যত চাকরিপ্রার্থী প্রতি বছর তৈরি হচ্ছে, সে পরিমাণ চাকরির সুযোগ তৈরি হচ্ছে না। দেশে বর্তমানে চাকরির সুযোগ বাড়ছে উৎপাদনশীল ও কৃষি খাতে। দুটি খাতে আবার স্নাতক বা স্নাতকোত্তর পাস তরুণদের কাজের সুযোগ কম। এ দুই খাতে কারিগরিভাবে দক্ষ লোকের চাহিদা বেশি। কিন্তু যেসব শিক্ষিত যুবক চাকরির বাজারে রয়েছেন, তারা এসব কাজে নিজেদের যুক্ত করতে চান না। বাংলাদেশের শিক্ষাপদ্ধতি কর্মবিমুখ হওয়ায় কারণেও আজ দেশের বড় একটা অংশ বেকার। আমাদের প্রচলিত শিক্ষাপদ্ধতি তেমন একটা কাজে আসে না। ফলে, আমাদের দেশে প্রতি বছর প্রচুর পরিমাণে অদক্ষ লোকজন তৈরি হচ্ছে। অত্যাধিক জনগোষ্ঠীও আমাদের দেশের বেকারত্বের অন্যতম কারণ। বাংলাদেশের জনসংখ্যা যে হারে বাড়ছে সে হারে আমাদের চাকরির পদ শূন্য হচ্ছে না।

বেকার সমস্যা সমাধানের অনেক পথ আমাদের সামনে খোলা আছে। সরকারি চাকরি না পেলেও যুবকরা বৃত্তিমূলক বা কারিগরি বিষয়ে ডিগ্রিধারীরা অর্জিত শিক্ষাকে কাজে লাগিয়ে আত্মকর্মসংস্থান করতে পারে। কারিগরি বিষয়ে শিক্ষিত ব্যক্তিদের ব্যাংকও এখন ঋণ সুবিধা প্রদান করছে। কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত জনশক্তি দেশের উন্নয়নে যেমনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করে, তেমনি এই জনশক্তিকে বিদেশে রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রাও আয় করা সম্ভব। ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, ফিলিপাইন, থাইল্যান্ড তাদের কারিগরি শিক্ষিত জনশক্তিকে বিদেশে বিশেষত মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে রপ্তানি করে নিজেদের বেকার সমস্যা বহুলাংশে হ্রাস করতে সক্ষম হয়েছে। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর মধ্যে চীন, জাপান, কোরিয়া, তাইওয়ান প্রভৃতি শিল্পোন্নত দেশের শিক্ষিত জনশক্তির অধিকাংশই কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে দেশকে উন্নতির শীর্ষে পৌঁছে দিচ্ছে। সেজন্য বলা চলে, বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান বেকার সমস্যার সমাধান করতে হলে কারিগরি শিক্ষার প্রতি অধিকতর গুরুত্বারোপ করতে হবে, প্রতিষ্ঠা করতে হবে আরও অধিক সংখ্যক কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এতে করে দেশের সার্বিক উন্নয়নের গতি ত্বরান্বিত হবেÑ হ্রাস পাবে বেকার সমস্যা। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, বর্তমান যুগ বিজ্ঞানের যুগ, কারিগরি জ্ঞানের যুগ। আর এই কারিগরি জ্ঞানই বেকারত্বের অভিশাপ থেকে দেশকে যেমনি মুক্ত করতে পারে, তেমনি দেশের অর্থনৈতিক অবস্থাও দ্রুত পাল্টে দিতে সক্ষম।

বর্তমানে যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সবকিছু বদলে যাচ্ছে। বেকার সমস্যা সমাধানের জন্য এখন অন্যতম মাধ্যমে হতে পারে আউটসোর্সিং। আউটসোর্সিংয়ে বাংলাদেশের অবস্থান আশাব্যঞ্জক। দেশের অনেক তরুণ-তরুণী লেখাপড়ার পাশাপাশি ফ্রিল্যান্সার হিসেবে আউটসোর্সিংয়ের কাজ করছেন। অনেকেই দেশের শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা করে চাকরির আশায় না থেকে আউটসোর্সিং শুরু করেছেন। আউটসোর্সিংয়ের কাজ করতে গিয়ে অনেকে নতুন নতুন প্রোগ্রামিং, ওয়েব ডিজাইনিং ও গ্রাফিক্সের কাজ শিখছেন। এতে, প্রকৃতপক্ষে তরুণদের সামর্থ্য দিন দিন বাড়ছে। আউটসোর্সিং শেখানোর জন্য বর্তমানে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা কাজ করছে। যে-কেউ চাইলে এখন নিজেদের আউটসোর্সিংয়ে যুক্ত করতে পারেন। বাংলাদেশ থেকে বেকারত্ব দূর করা স্বল্পসময়ের মধ্যে সম্ভব নয়। এর জন্য প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে জনসংখ্যা বৃদ্ধি রোধ এবং অর্থনৈতিক কাঠামোগত পরিবর্তনে। প্রয়োজনে কর্মমুখী শিক্ষাবিস্তার, কুটিরশিল্পের প্রসারসহ আত্মকর্মসংস্থানমূলক বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন। উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ বাড়ালে কর্মসংস্থানের সুযোগও বাড়বে। যে যে কাজ ভালো পারে, সে কাজে তাকে নিয়োগ দিতে হবে। দেশের তরুণদের উৎসাহিত করতে হবে। উদ্যোক্তা তৈরির জন্য সরকারিভাবে লোন দিতে হবে। শিক্ষার ব্যাপক প্রসার ঘটিয়ে বৃত্তিমূলক, কারিগরি ও কৃষিশিক্ষার ওপর জোর দিতে হবে। কৃষিক্ষেত্রে কর্মসংস্থানের জন্য সার, বীজ, যন্ত্রাংশ, কীটনাশক প্রভৃতির বাজার সম্প্রসারণ; হাঁস-মুরগি ও গবাদিপশু পালন, মাছ চাষ, বনায়ন ইত্যাদির মাধ্যমে কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করতে হবে। ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প এবং বিদেশি বিনিয়োগের লক্ষ্যে গ্যাস ও বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। ক্ষুদ্র শিল্প এবং বিভিন্ন প্রচলিত-অপ্রচলিত খাতে মহিলা ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষণ ও ঋণ সহায়তা প্রদান করতে হবে। সর্বোপরি, এসব লক্ষ্য বাস্তবায়নে সরকারি-বেসরকারি সংস্থাসহ রাজনৈতিক দলগুলোকেও এগিয়ে আসতে হবে।

শিক্ষার্থী

ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়

joydebray208@gmail.com

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত