
নির্বাচন কমিশন গঠনে সংবিধানে যে আইন প্রণয়নের কথা বলা হয়েছে, তা ৫০ বছরে কার্যকর না হলেও গত দুই মেয়াদে রাষ্ট্রপতি যে সার্চ কমিটি গঠন করেছেন, তাতে সাংবিধানিক পদে নিয়োজিতরাই প্রাধান্য পেয়েছেন। আর দুটি সার্চ কমিটিই হয়েছে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে। এবার তৃতীয়বারের মতো আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে রাষ্ট্রপতি সংলাপ শুরু হয়েছে। এই সংলাপ থেকে ওঠে আসা নাম থেকেই সার্চ কমিটি সুপারিশ করে রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠাবে। সেখান থেকে একজনকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও চারজন নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ করবেন রাষ্ট্রপতি। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ শুরু হয়েছে। এরই মধ্যে আটটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে রাষ্ট্রপতি সংলাপ করেছেন। আরও চারটি দলের সঙ্গে সংলাপ করবেন।
আইনমন্ত্রী আনিসুল হকও গত বুধবার (২৯ ডিসেম্বর) রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে কাদের নিয়ে সার্চ কমিটি হবে, তা জানিয়ে দিয়েছেন। গতবারের সার্চ কমিটির আদলেই এবারেরটা হবে বলে তিনি জানিয়েছেন। সার্চ কমিটির প্রধান থাকবেন আপিল বিভাগের একজন বিচারপতি, সদস্য থাকবেন হাইকোর্ট বিভাগের একজন বিচারপতি, মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক, পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান। আর দুইজন থাকবেন সিভিল সোসাইটির সদস্য। আইনমন্ত্রী জানান, সার্চ কমিটিতে রাজনৈতিক দলের কেউ থাকবেন না। নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য ২০১৭ সালে যে ছয় সদস্যবিশিষ্ট সার্চ কমিটি করা হয়, ওই কমিটির চারজনই ছিলেন সাংবিধানিক পদের। কমিটির প্রধান করা হয় আপিল বিভাগের একজন বিচারপতিকে। আর সদস্য থাকেন হাইকোর্ট বিভাগের একজন বিচারপতি, মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক, সরকারি কর্মকমিশনের চেয়ারম্যান এবং দেশের দুইজন বিশিষ্ট নাগরিক। দুইজন বিচারপতি এবং মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক এবং পিএসসির চেয়ারম্যান সংবিধান অনুসারে নিয়োগপ্রাপ্ত হওয়ায়, বলা যায় সার্চ কমিটি একটি অলিখিত সাংবিধানিক কমিটি; যা অনেক শক্তিশালী ও স্বচ্ছ। এবারও এই সাংবিধানিক পদধারীরা সার্চ কমিটিতে থাকছেন। নির্বাচন কমিশন গঠনে আইন করা প্রসঙ্গে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক একাধিকবার বলেছেন, সময় স্বল্পতার কারণেই এখন আইন প্রণয়নের সময় নেই। ফলে রাষ্ট্রপতির সার্চ কমিটির মাধ্যমেই নির্বাচন কমিশন হবে। তিনি বিষয়টি আরও স্পষ্ট করেছেন, ‘যদিও সার্চ কমিটির গেজেটটি আইন নয়, কিন্তু এটা যেহেতু সবার কনসেন্সের মাধ্যমে হয়েছিল। মহামান্য রাষ্ট্রপতি সেটা গেজেট করেছিলেন। সেটা কিন্তু আইনের কাছাকাছি।’ উল্লেখ্য, বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, কয়েকটি বেসরকারি সংস্থা এবং সম্প্রতি ৫৪ জন নাগরিক বিবৃতি দিয়ে নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য সংবিধানে প্রদত্ত আইন প্রণয়নের দাবি জানিয়েছেন। তবে এ নিয়ে বিএনপি যত না চিন্তিত, তার চেয়ে বেশি চিন্তিত সুশাসনের জন্য নাগরিকসহ সুশীল সমাজের একটি অংশ। বিএনপি বরং বলেছে, নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার না হলে শুধু আইন করে নির্বাচন কমিশন গঠন করলে সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও সম্প্রতি সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপচারিতায় সরকারের সঙ্গে একদফা দাবি অর্থাৎ নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার নিয়ে সংলাপে বসার প্রস্তাবও দিয়েছেন। আর সর্বশেষ নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে রাষ্ট্রপতির সংলাপে তারা যাবে না বলে জানিয়ে দিয়েছেন। প্রসঙ্গত সংবিধানে নির্বাচন কমিশন প্রতিষ্ঠার বিষয়টি বলা হয়েছে ১১৮ অনুচ্ছেদে। ‘১১৮ (১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অনধিক চারজন নির্বাচন কমিশনারকে লইয়া বাংলাদেশের একটি নির্বাচন কমিশন থাকিবে এবং উক্ত বিষয়ে প্রণীত কোনো আইনের বিধানাবলী-সাপেক্ষে রাষ্ট্রপতি প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারকে নিয়োগদান করিবেন।’
এখানে উক্ত বিষয়ে প্রণীত আইনের বিধানাবলী সাপেক্ষে রাষ্ট্রপতি প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ অন্য কমিশনারদের নিয়োগ দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু অদ্যাবধি কোনো সরকার নির্বাচন কমিশন গঠনে এই আইন বাস্তবায়ন করেনি। সব সরকারই তাদের পছন্দ মতো নির্বাচন কমিশন গঠন করেছে। ব্যতিক্রম শুরু হয় ২০১২ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেই। সরাসরি রাষ্ট্রপতির পছন্দ মতো নিয়োগ না দিয়ে একটি উচ্চ পর্যায়ের সার্চ কমিটি গঠন করা হয়। এ কমিটির প্রধান থাকেন সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগের একজন বিচারপতি। আর সদস্য হিসেবে থাকেন হাইকোর্ট বিভাগের একজন বিচারপতি, মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক, সরকারি কর্মকমিশনের চেয়ারম্যান। এ সার্চ কমিটির সদস্যরা রাজনৈতিক দল ও সরকারের বিভিন্ন সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আলোচনা করে নাম সংগ্রহ করে প্রতি পদে দুটি করে নামের তালিকা রাষ্ট্রপতির কাছে হস্তান্তর করেন। রাষ্ট্রপতি এ তালিকা থেকে একজন প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও চারজন নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ দেন। ২০১২ সালে ২৩ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান প্রথম চার সদস্যবিশিষ্ট সার্চ কমিটি গঠন করেন। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে প্রজ্ঞাপন জারি করে এই সার্চ কমিটি গঠন হয়। দ্বিতীয় সার্চ কমিটি গঠন করেন বর্তমান রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ ২০১৭ সালের ২৫ জানুয়ারি। এ কমিটি হয় ছয় সদস্যের।
সার্চ কমিটির প্রধান ছিলেন তৎকালীন আপিল বিভাগের বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন। আর সদস্য ছিলেন হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি ওবায়দুল হাসান, মহাহিসাব-নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক, সরকারি কর্মকমিশনের চেয়ারম্যান, শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম ও অধ্যাপক শিরিন আখতার। এ কমিটি কয়েক দফা রাজনৈতিক দল ও সিভিল সোসাইটির লোকজনের সঙ্গে বৈঠক করে ১০ জনের নামের তালিকা তৈরি করে পাঠায় রাষ্ট্রপতির কাছে। তাদের মধ্য থেকে একজনকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও চারজনকে কমিশনার নিয়োগ করেন রাষ্ট্রপতি, যা হলো কেএম নূরুল হুদার নেতৃত্বে বর্তমান কমিশন। আইন, সংবিধান ও নির্বাচন বিশেষজ্ঞরাও মনে করেন, সংবিধানে নির্বাচন কমিশন গঠনে যে আইনের কথা বলা হয়েছে সেটা হলে ভালো।
তবে ৫০ বছরেও সেই আইন বাস্তবায়ন হয়নি। কিন্তু এর বিকল্প হিসেবে রাষ্ট্রপতি সার্চ কমিটি গঠন করে যে কমিশন গঠন করেন তাও গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এবং অনেকটাই সাংবিধানিক ভিত্তিতে মজবুত। কারণ সার্চ কমিটিতে যারা থাকেন তাদের ছয়জনের মধ্যে চারজনই সাংবিধানিক দায়িত্বে নিয়োজিত। সুপ্রিমকোর্টের দুজন বিচারপতি সংবিধান অনুযায়ী নিয়োগপ্রাপ্ত। আর মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক এবং সরকারি কর্মকমিশনের চেয়ারম্যান পদ দুটিও সাংবিধানিক। ফলে বলাই যায় সাংবিধানিক পদে নিয়োজিত ব্যক্তিদের সুপারিশে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন কমিশন গঠন করেন।
সংবিধানের ১২৭(১) অনুচ্ছেদ অনুসারে মহা-হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রককে রাষ্ট্রপতি নিয়োগ দিয়ে থাকেন। আর সংবিধানের ১৩৭ অনুচ্ছেদ অনুসারে সরকারি কর্মকমিশনের সভাপতি নিয়োগ দেন রাষ্ট্রপতি। কাজেই সার্চ কমিটির ছয়জনের মধ্যে চারজনই সাংবিধানিক পদে নিয়োজিত। আর দুজন থাকেন রাষ্ট্রের বিশিষ্ট নাগরিক। তাদের মাধ্যমেই স্বচ্ছ নির্বাচন কমিশন হতে পারে। আইন করে করলেও এর চেয়ে ভালো কিছু হবে না।
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, নির্বাচন কমিশন গঠনে সংবিধানে প্রদত্ত বিধান অনুযায়ী একটা স্থায়ী আইনি কাঠামো দরকার। কিন্তু তা না হওয়া পর্যন্ত যে সার্চ কমিটি গঠন করা হয়, তাদের সুপারিশ এবং রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে নির্বাচন কমিশন গঠন হলে তা শক্তিশালী এবং আরও বেশি গ্রহণযোগ্য হবে।