মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতার বড় চালিকাশক্তি ছিল কিছু বিশেষ আদর্শ, উদ্দেশ্য ও চেতনা। একটি অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক, শোষণ-বৈষম্যহীন এবং উন্নত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা, ব্যক্তিগত লাভ-লোভকে পরিহার করে দেশ ও মানুষের লাভ স্বার্থই ছিল স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম লক্ষ্য। মুক্তিযুদ্ধের উদ্দেশ্য ছিল একটি ন্যায়সঙ্গত এবং সমতাভিত্তিক দেশ ও সমাজ গঠন। তাই আমাদের সংবিধানের শুরুতেই বলা হয়েছে প্রজাতন্ত্র তথা রাষ্ট্রের মালিক জনগণ।
আজ অর্ধশতাব্দী বছর পেছনে ফেলে এসে উপলব্ধি করতে হচ্ছে, আমাদের মৌলিক অর্থনৈতিক উন্নতির সূচক বাড়লেও নৈতিক মূল্যবোধের চরম অবক্ষয়ে অধোগতি দেখা দিয়েছে সামাজিক নিরাপত্তা সূচকে। এর কারণ কর্তৃত্বপরায়ণতা লোভ ও দুর্নীতি। ফলে ঘটেনি কাক্সিক্ষত পরিবর্তন ঔপনিবেশিক আমলের ‘প্রভু-ভৃত্য’ আচরণিক বৈশিষ্ট্যের।
সামাজিক নিরাপত্তা হচ্ছে এমন একটি ব্যবস্থা, যা বিভিন্ন কর্মসূচি এবং আইনগত উদ্যোগের মাধ্যমে সমাজের মানুষের মধ্যে পরস্পর সহাবস্থান এবং সম্প্রীতির একটি সুষম পরিবেশ তৈরি করে। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক ও সামাজিক দুর্যোগের ফলে মানুষের মধ্যে সংঘটিত অনাকাক্সিক্ষত অবস্থা মোকাবিলা, বিভিন্ন আইনি সহায়তা এবং অসুস্থতা, বেকারত্ব, শিল্পদুর্ঘটনা ইত্যাদি ক্ষেত্রেও মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় প্রয়োজনীয় সহায়তা করা।
সামাজিক নিরাপত্তা আধুনিক কল্যাণরাষ্ট্রের সামাজিক নীতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। মৌল মানবিক চাহিদা যাদের অপূরিত থাকে, যারা বিপর্যয় রোধ করতে পারে না; অর্থাৎ দরিদ্র, বেকার, অসুস্থ, প্রতিবন্ধী, বিধবা, এতিম, পঙ্গুসৈনিক, ভিক্ষুক, ভবঘুরে, নির্ভরশীল, বয়স্ক ও পরিত্যক্ত মহিলা ও শিশুরা এ নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় পড়বে।
বাংলাদেশের মতো ক্ষুদ্র একটি দেশে প্রায় দুই কোটি মানুষ সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। প্রতিটি বাজেটেই সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বড় অঙ্কের বরাদ্দ থাকে। নিরাপত্তা বেষ্টনীর নামে দেওয়া হয় সামাজিক সাহায্য।
সমাজসেবা অধিদপ্তর ও অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতা থেকে জানা গেছে, ২৩টি মন্ত্রণালয়ের অধীনে সরকারের ১৪৩টি সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি রয়েছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে মোট ৯৫ হাজার ৫৭৪ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির মধ্যে প্রতিবন্ধী ভাতা, বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা ভাতা, বয়স্ক ভাতাসহ দারিদ্র্য দূরীকরণ, অনগ্রসর জনগোষ্ঠী ও তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীর ভাতা, শিক্ষা উপবৃত্তি, প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসনের বেশকিছু সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে থাকে সমাজসেবা অধিদপ্তর। তবে সরাসরি ভাতা দেওয়ার ১৩টি কর্মসূচি পালন করে এ অধিদপ্তর।
সমাজসেবা অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, সারা দেশের সব জেলা-উপজেলায় ভাতা কর্মসূচি বাস্তবায়ন হচ্ছে। এলাকার জনসংখ্যার ভিত্তিতে ভাতার বরাদ্দ করা হয়ে থাকে।
প্রসঙ্গত, ২০১৯ সালে বেসরকারি এক গবেষণায় ভাতাভোগীদের ওপর অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলা হয়েছে, টাকা কম হলেও ভাতার ইতিবাচক প্রভাব রয়েছে। ভাতাভোগীরা এ টাকা দিয়ে ওষুধসহ প্রয়োজনীয় কিছু কেনাকাটা করতে পারেন বলে পরিবারে তাদের ক্ষমতায়ন হয়। সামাজিক নিরাপত্তার আওতায় রয়েছেন মোট দাবিদারের মাত্র ২৫ ভাগ মানুষ। যে কারণে ভাতার অর্থ ও ভাতাভোগীর সংখ্যা বাড়ানোর ওপরও জোর দেওয়া হয়।
সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা ও বৈষম্যরোধে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে থাকে সামাজিক নিরাপত্তা খাত। সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচি প্রকৃত গরিবের নিরাপদ বাজেট বরাদ্দ হওয়া উচিত। কিন্তু বাংলাদেশ উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত নানা কৃত্রিম বাধার সম্মুখীন হয়। এসব বাধার পাহাড় ডিঙাতে নিরাপদ বেষ্টনীর বেড়া, খুঁটিগুলো দুর্নীতির জালপাতে। এমনকি সামান্য দুস্থ-বিধবা-বয়স্ক ভাতা পেতে ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার-চেয়ারম্যানের কাছে ঘুরতে ঘুরতে জীবনপাত করা শুধু নয়, দিতে হয় মোটা দাগের সেলামি! তাতেও জুটে না ব্যক্তি দাসত্বগিরি না করলে।
তেমনি ৯৮ হাজার গ্রামের অন্যতম একটি গ্রাম নতুন বগাদিয়া, যা রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের সংসদীয় সাবেক কিশোরগঞ্জ-৪ আসনের মিঠামইন উপজেলায় গোপদিঘী ইউনিয়নের ২নং ওয়ার্ডে অবস্থিত। গ্রামটি শতভাগ আওয়ামী লীগার হলেও সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচিসহ যাবতীয় নাগরিক সুবিধাদি থেকে বঞ্চিত। বণ্টন ন্যায্যতার কোনো বালাই নেই। বঞ্চিতদের অভিযোগ, ‘সবাই এসে খালি নাম নিয়া যায়, কিন্তুক কোনো তা পায় না!’ অথচ দুইডা চোখে দেখতাছি ‘তেলা মাথায় তেল দেওয়া অইতাছে। এহানে হিরকরাজা ভাগবান।’
‘জীবন যে চলে না আর, বাঁচার কোনো বাও নাই; আজ নিজভূমে পরবাসী আমি’। সীমাহীন দুর্দশাকে এভাবেই ব্যক্ত করেছেন, সম্প্রতি ছোট দুটি মেয়ে নিয়ে ঢাকাতে কাজ করতে আসা সুবিধাবঞ্চিত অসহায় বিধবা মোছা. হনুফা খাতুন (৩৩)।
তিনি বলেছেন, ‘সরকারি বিভিন্ন সহায়তা পাইতে কিমুন যোগ্যতা লাগে জানি না। তয় জানি, ১২ বছর অইলো কামাইয়ের লোকটা মইরা গেছেগা। থাকতাম পিতৃহারা ভাইদের ভিটাবাড়িতে। সেখানেও আর ঠাঁই মিলছে না, তাদেরও তো বউ আছে, পোলাপান বাড়তাছে। আমারও মাইয়া দুইডা ডাঙ্গর অইতাছে। নাই এক চিমডি মাডি। সহায়-সম্বলহীন, ভুখা-নাঙ্গা মানুষ আমি।’
এ অভাবী মুখের সংখ্যা দিনদিন বাড়ছে। তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, করোনায় মানবিক সহায়তার ক্ষেত্রে উপকারভোগীর তালিকায় তার নাম নেই। গত ২০১৭ সালের বিধ্বংসী বন্যার সময়ও ছিল না। তাছাড়া মুজিববর্ষের ভূমি ও ঘরপ্রাপ্তির বেলায় এখনও পর্যন্ত উপেক্ষিত।
আবাসন অধিকার বিশ্বব্যাপী প্রতিটি জাতির নাগরিক অন্যতম অধিকার। আমাদের সংবিধানে খাদ্য, বস্ত্র এবং বাসস্থানকে মৌলিক চাহিদা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এ দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে প্রতিটি নাগরিক তার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে বসবাসের জন্য একটি বাড়ি থাকা সাংবিধানিক অধিকার।
বিগত একযুগের হিসাব বাদ দিলেও গত ২০১৭ সালের বন্যায় উপকারভোগীদের সংখ্যা ছিল ৫১ জন; যা সম্পূর্ণ ব্যক্তি অনুগামী আশ্রিত। সম্প্রতি বৈশ্বিক করোনা মহামারিতে সরকার যে চাল ও অর্থ বরাদ্দ দিয়েছে, এর বিপরীতে গ্রামটিতে উপকারভোগীদের তালিকাটি ‘আমরা আর মামুরা’ দিয়ে ভরা। ত্রাণ বিতরণ ও বিভিন্ন সহায়তা দেওয়ার ক্ষেত্রে বণ্টনে কম গরিবের সঙ্গে অতি গরিবের মধ্যে বেজায় বৈষম্যপূর্ণ। ঈদ উপহার হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষিত ৫০ লাখ পরিবারের জন্য যে আড়াই হাজার করে টাকা দেওয়া হয়েছে, তা অতি অভাবীদের ঘরে না গেলেও স্বচ্ছল ও চাকরিজীবীদের ঘরে জুটেছে। তাছাড়া মুজিববর্ষ উপলক্ষ্যে ৮ লাখ ৮২ হাজার গৃহহীনকে সরকার যে ভিটাবাড়ি নির্মাণ করে দিচ্ছে বা তালিকাভুক্ত করা হচ্ছে, তাও ব্যক্তি অনুগামীতার পাশাপাশি স্বজনতন্ত্র, স্বজনাশ্রিত ও টাকা-কুঁড়িতে লেপটে আছে। অপাত্রে বরাদ্দকৃত ঘর বিক্রি হয়ে উঠেছে অন্যখানে গিয়ে। এসব এলাকার কারও অজানা না থাকলেও প্রভাব-প্রতিপত্তির কাছে বোবা। সরকারি প্রাইমারি স্কুলটিকে পর্যন্ত ‘শুয়োরের খোয়ারে’ ট্রিট করা হচ্ছে, শিক্ষার্থীরা হারাচ্ছে ৮৫ বছরের প্রাচীন স্কুল-মাঠটিও। শীর্ষ নেতৃত্বের কাছে বেস্ট ওয়ানের মেকাপে ‘হারা ধনের দশটি ছেলে’-এর মঞ্চায়ন হচ্ছে; যা জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শী ভাষণের সঙ্গে মিলে যায়।
সেই দৃশ্যপটে ৭০টির মতো হতদরিদ্র ও দরিদ্র পরিবার এ পর্যন্ত সরকারি যাবতীয় সহায়তা থেকে বঞ্চিত করে রাখার আহাজারি চলছে। এসবের অন্যতম আরেকটি কারণ ‘আত্মকেন্দ্রিক রাজনীতি’ প্রতিষ্ঠা লাভ। গ্রামটিতে মোট পরিবার ১৬৭টি। গরিব ৮৭টি ও অতি গরিব ৬৫টির মতো। এর মধ্যে ৪১ জন বিধ্বা, ৬৭ জন বয়স্ক ও প্রতিবন্ধী ৯ জন।
বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার দৃঢ় প্রত্যয়ে বর্তমান সরকার যে উদীপ্ত কর্মধারায় এগিয়ে চলছে তা দৃশ্যমান হতেও সময় লাগছে না বৈশ্বিক করোনা মহামারির নৃশংস ছোবলে গতি হারালেও। গণমানুষের নাগরিক অধিকার আর প্রত্যাশায় ৫টি মৌলিক কর্মযজ্ঞে সারাদেশকে যে মাত্রায় সাজানো-গোছানো হয়েছে তা আজ সারাবিশ্বকেও চমক লাগানোর অদম্য পথে সরকার।
কিন্তু একটিমাত্র গ্রামের এ কি হাল? অথচ এ গ্রামেই প্রতিটি মানুষ জন্ম নিচ্ছে প্রায় ২৬ হাজার টাকা রাষ্ট্রীয় ঋণের ভার নিয়ে।
দেশের মূলভিত্তি গ্রাম। রূপকল্প ২০৪১ বাস্তবায়ন করতে চায় শেখ হাসিনার সরকার। ওই নাগাদ ক্ষমতায় থাকার স্বপ্ন রয়েছে দলটির। নতুন বগাদিয়া গ্রামটির সামাজিক নিরাপত্তা সূচকের অধোগতি সরকার পরিচালনার মানদ-ে যায় না। গ্রামটি আমার-তোমার নয়, বাংলাদেশের।
সরকারি প্রকল্পের বাস্তবতা এবং কার্যক্রমের মাধ্যমে আর্থিক উন্নতি ঘটাতে সুদৃষ্টি রাখতে হবে। দরিদ্রদের দারিদ্র্য দূরীকরণে নির্ধারিত কাজ এবং বছরে সরকারি সমবায়ের মাধ্যমে খাদ্যদ্রব্য বণ্টন করে তাদের শারীরিক পুষ্টি বাড়াতে হবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ব্যক্তি স্বার্থপূর্ণ চেতনা ব্যক্তির চারিদিকে থাকা সমাজ নিয়ন্ত্রণ করে বলে এ দশা।
নাগরিক সুবিধাবঞ্চিত গ্রামটি শতভাগ আওয়ামী ও হামিদপ্রেমি। তাদের যাওয়ার জায়গা নেই আর। ব্যক্তি-পরিবার ও সমাজ-রাষ্ট্রের বৃহত্তর স্বার্থে বঙ্গভবনের নির্দেশিত গৌরবোজ্জ্বল সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে একটি জরিপ প্রার্থনা করা হয়েছে। এতে যদি বা শান্তির পায়রা উড়ে।